ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

আইন ও আদালত

প্রধানমন্ত্রীকে হত্যাচেষ্টা মামলার রায়ে যা বলেছেন হাইকোর্ট

ইলিয়াস সরকার,স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৫৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০২১
প্রধানমন্ত্রীকে হত্যাচেষ্টা মামলার রায়ে যা বলেছেন হাইকোর্ট

ঢাকা: ২০০০ সালে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় প্রধানমন্ত্রীকে হত্যাচেষ্টার ঘটনাকে কোনোভাবেই হালকা করে দেখার অবকাশ নেই বলে মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট।

ওই ঘটনায় আসামিদের আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের রায়ে বুধবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি মো. বদরুজ্জামানের ভার্চ্যুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চে এ মন্তব্য করেন।

রায়ে বিচারিক আদালতে মৃত্যদণ্ড পাওয়া ১০ আসামির দণ্ড বহাল রেখেছেন উচ্চ আদালত। যাবজ্জীবন দণ্ড পাওয়া এক আসমির দণ্ড বহাল রেখেছেন। এছাড়া ১৪ বছরের দণ্ডিত ৩ আসামির মধ্যে একজনের দণ্ড বহাল, আরেকজনকে খালাস এবং বাকি একজনের দণ্ড ভোগ শেষ হয়ে থাকলে তাকে মুক্তির নির্দেশ দেন।

রায়ে জাতির জনকের প্রসঙ্গ টেনে আদালত বলেন, ১৫ আগস্টের বিভিষীকাময় ঘটনার মধ্য দিয়ে এই সার্বভৌম দেশটি যতটুকু পিছিয়ে গিয়েছিল, ঠিক তেমনি আবারও একটি ঘটনা ঘটতে যাচ্ছিল।  

‘আদতে এই দেশটি দুর্ভাগা এই কারণে যে, যেখানে জাতির জনককে সপরিবারে বিনা দোষে নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছিল ঘাতকের দল। দুনিয়ার কোনো সভ্য দেশে এমনিভাবে জাতির জনককে সপরিবারে হত্যার ঘটনা বিরল। ’

বোমা পুঁতে রাখার ঘটনার বিষয়ে আদালত বলেন, ঘটনাকে কোনোভাবেই হালকা করে দেখার কোনো অবকাশ নেই। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই ধরনের ভয়াবহ কর্মকাণ্ড আসামিগণ করতে চেয়েছিলেন কেন? সাক্ষীদের সাক্ষ্য এবং আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, আসামিরা ঢাকাস্থ মোহাম্মদপুর ও মুগদাপাড়া অফিসে মিটিং করেছিলেন। মিটিংয়ে তারা মতামত প্রকাশ করে বলেন যে, আওয়ামী লীগ সরকার ইসলাম বিদ্বেষী এবং ভারতের দালাল হিসেবে ইসলাম ধ্বংসের কাজে লিপ্ত। সুতরাং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তার সরকারকে উৎখাত করতে হবে হত্যার মধ্য দিয়ে।

‘কিন্তু কী ধরনের ইসলাম বিরোধী কার্যক্রম তৎকালীন সরকার করেছিল বা ভারতের সাথে কী ধরনের আঁতাত করেছিল এরূপ কোনো বক্তব্য দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে কেউ উল্লেখ করেননি। ’

আদালত বলেন, আসামিদের দোষ স্বীকারুক্তিমূলক জবানবন্দি গভীরভাবে পর‌্যালোচনা করলে দেখা যায় আসামি একটি অবাস্তব এবং ভ্রান্ত ধারণার ওপর ভিত্তি করে এ ধরনের মানসিকতা সৃষ্টি করেছিলো।

আসামিরা দেশের বাইরে জঙ্গি প্রশিক্ষণ যোগ দিয়েছিলেন উল্লেখ করে আদালত বলেন, আবার ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে কেউ কেউ আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে গিয়েও বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের যোগদান করে বিভিন্ন জঙ্গি প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।

এই মামলার তদেন্তর বিষয়ে আদালতে বলেন, এই ধরনের জঙ্গি তৎপরতার আড়ালে যাদের বিচরণ ছিল, তাদের সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানার জন্য তদন্তকারি কর্মকর্তাদের তদন্তের আরও গভীরে যাওয়া উচিত ছিল। এ মামলার তদন্তেও আরও অধিকতর মনোযোগী হওয়া দরকার ছিল। আসামিদের ধর্মীয় ধারণার বিষয়ে উচ্চ আদালত বলেন, অবস্থা যাই হোক, আসামিরা ইসলাম সম্পর্কে ভুল ধারণা নিয়ে তৎকালীন সরকারকে দোষারোপ করেছিল। অথচ ইসলামের মূল্যবোধ এবং হযরত মুহাম্মদ (স.) আদর্শিক দিকগুলো এদেশের মুসলিম বাঙালিদের মধ্যে প্রতিষ্ঠা লাভের জন্য এবং আগত জেনারেশনকে এ ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করার জন্য বিভিন্ন ইসলামিক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। শুধু তাই নয়, তিনি অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের ব্যাপারেও সজাগ ছিলেন। সে অগ্রযাত্রা পরবর্তীকালে আরও দৃশ্যমান হয়ে উঠেছিলো।

‘আসামিরা যাদেরকে ইসলাম বিরোধী বা বিদ্বেষী হিসেবে চিহ্নিত করতে চেয়েছিল তারা ইসলামকে সুপ্রতিষ্ঠার কাজে লিপ্ত। ইসলামের মূল্যবোধ সম্পর্কে আসামিদের ভ্রান্ত ধারণা ও তাদের এহেন কর্মে পুরো দেশ ও সমাজ অশান্তিতে বিরাজমান ছিল। ইসলাম ভালো কাজের প্রশংসা করার জন্য বার বার তাগিদ দিয়েছে। আসামিদের এ ধরনের ধ্যান ধারণা এবং শক্তি প্রদর্শন ইসলাম কোনভাবেই সমর্থন করে না। কারণ ইসলাম শান্তির ধর্ম। ’

আসামিদের উদ্দেশ্যে সম্পর্কে আদালত বলেন, ষড়যন্ত্রকারী আসামিরা মূলত তাকে হত্যা করার জন্য এ ঘটনার অবতারণা করেছিলো। তিনি তখন বৈধ সরকার প্রধান হিসেবে ক্ষমতায় ছিলেন। একটি বৈধ সরকার প্রধান এবং তার সহযোগীদেরকে সহ হত্যার প্রচেষ্টা এবং তা বাস্তবায়ন করা কতখানি দেশ ও জাতির জন্য ক্ষতিকর তা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার পরবর্তীতে এ দেশের নিরীহ স্বধীনতাকামী জনগণ উপলব্ধি করেছে।  আসামিদের এ ধরনের ভ্রান্ত চিন্তা এবং ধারণা এ জাতির জন্য একটি কলঙ্কময় অধ্যায়। দেশের মানুষের কল্যাণের স্বার্থে জঙ্গিবাদ এবং জঙ্গি তৎপরতা চিরতরে এ দেশ থেকে বিলীন হওয়া প্রয়োজন।

‘আসামিগণ দেশের প্রচলিত আইন মানতে নারাজ। তারা জঙ্গি তৎপরতার মাধ্যমে তাদের নিজস্ব চিন্তার প্রতিফলন ঘটনাতে চায়। কিন্তু তাদের এ ধরনের চিন্তা দেশের প্রচলিত আইন কখনো সমর্থন করে না। কারণ তারা সকলেই জন্মগতভাবে এ দেশের নাগরিক। ষড়যন্ত্র ও দুটি বোমা পোঁতার মধ্য দিয়ে যে অপরাধ তারা সংগঠিত করেছে তা ছিল অত্যন্ত ভয়ংকর এবং জঘন্য’ বলে মন্তব্য করেছেন আদালত।

২০০০ সালে কোটালীপাড়া সফরের অংশ হিসেবে শেখ লুৎফর রহমান সরকারি আদর্শ কলেজ মাঠে ভাষণ দেওয়ার কথা ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। সমাবেশের দু’দিন আগে ২০ জুলাই কলেজ প্রাঙ্গণে জনসভার প্যান্ডেল তৈরির সময় শক্তিশালী বোমার অস্তিত্ব পাওয়া যায়।

পরে ওই কলেজের উত্তর পাশে সন্তোষ সাধুর দোকানঘরের সামনে থেকে সেনাবাহিনীর একটি দল ৭৬ কেজি ওজনের বোমাটি উদ্ধার করে। পরদিন ২১ জুলাই গোপালগঞ্জ সদর থেকে ৮০ কেজি ওজনের আরও একটি শক্তিশালী বোমা উদ্ধার করা হয়।

২০১৭ সালের ২০ আগস্ট ওই ঘটনায় করা মামলার ১০ আসামিকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন  আদালত।

এছাড়া একজন আসামির যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং তিনজনের ১৪ বছর করে কারাদণ্ড দেন ঢাকার ২ নম্বর দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মমতাজ বেগম।

রায় ঘোষণার এক সপ্তাহের মাথায় ২৭ আগস্ট বিচারিক আদালত থেকে পাঠানো ডেথ রেফারেন্স, রায় ও মামলার নথিপত্র হাইকোর্টে পাঠানো হয়।

এরপর নিয়ম অনুসারে প্রয়োজনীয় কাজ সম্পন্নের পর এ ডেথ রেফারেন্স শুনানির জন্য বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিমের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চের কার্যতালিকায় আসে। শুনানি শেষে বুধবার রায় দেন হাইকোর্ট।

বাংলাদেশ সময়: ১৯৫৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০২১
ইএস/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।