ঢাকা, শুক্রবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

আইন ও আদালত

ভার্চ্যুয়াল আদালত কি নিয়মিত আদালতের বিকল্প হতে পেরেছে?

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮০৪ ঘণ্টা, জুন ২৫, ২০২০
ভার্চ্যুয়াল আদালত কি নিয়মিত আদালতের বিকল্প হতে পেরেছে?

ঢাকা: রাজধানীর উত্তর খান থানায় বখাটেদের উৎপাতের প্রতিবাদ করতে গিয়ে মামলার আসামি হন সত্তরোর্ধ্ব অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্য। আদালতে আত্মসমর্পণ করার সুযোগ না থাকায় থানায় আত্মসমর্পণ করে দুদিন কারাভোগ করে গত সপ্তাহে তিনি জামিন পান। ময়মনসিংহের ভালুকা থানার মাহমুদুল হাসান ও তার পরিবার জমিজমা নিয়ে বিরোধের জেরে হয়রানিমূলক মামলায় ময়মনসিংহ আদালত থেকে একইভাবে জামিন নেন তারও ক’দিন আগে।

যারা গ্রিন সিগনাল পান, তারা এভাবে থানায় আত্মসমর্পণ করে জামিন নেন। আবার লক্ষ্মীপুরের বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ফরহাদ আহমেদ জমিজমা নিয়ে বিরোধের জেরে একইভাবে আসামি হয়ে পলাতক রয়েছেন।

আদালতে আত্মসমর্পণ করতে তার এখন অপেক্ষা। তবে আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন আবেদনের সুযোগ না থাকায় তাকে পলাতকই থাকতে হচ্ছে। এর মাঝে তার ক্ষতি হচ্ছে ক্যারিয়ারের।  

শুধু আত্মসমর্পণ নয়, একইভাবে সিআর মামলা ফাইলিং, দেওয়ানী মামলা ও বিচারাধীন মামলার কার্যক্রমও চলছে না। শুধু হাজতি আসামির জামিন শুনানির মধ্যে নিম্ন আদালতে ভার্চ্যুয়াল কার্যক্রম সীমাবদ্ধ। সম্প্রতি হস্তান্তরযোগ্যর দলিলের (চেক ডিজঅনার) মামলার ফাইলিং গ্রহণ করা হচ্ছে অনলাইনে। ফাইলিং হলেও বাদীর জবানবন্দি গ্রহণের মাধ্যমে মামলার পরবর্তী কার্যক্রমের জন্য অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে। ভার্চ্যুয়াল আদালতের কার্যক্রম যেহেতু মোটামুটি হাজতি আসামির জামিনের মধ্যে সীমাবদ্ধ, তাই অধিকাংশ বিচারপ্রার্থীই তাদের প্রতিকার পাচ্ছেন না।

বিশেষ করে যেসব মামলা বাধ্যেতামূলকভাবে আদালতেই ফাইল করতে হয়, তারা পড়েছেন বিপাকে। তাছাড়া কিছু ক্ষেত্রে মামলা ফাইলিংয়ে তামাদির মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। পরবর্তী মামলা দায়েরে এই তামাদির হিসাব কীভাবে হবে তাও পরিষ্কার নয়। তাই এ নিয়ে খোদ আইনজীবীদের মধ্যেই ধোঁয়াশা আছে।

বিচারপ্রার্থীদের এই অপেক্ষা ও জামিন কেন্দ্রিক কিছু আইনজীবী ছাড়া বাকিদের দুর্দশা তাই দিনে দিনে বাড়ছে। সে কারণেই এখন স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিয়মিত আদালতের কার্যক্রম চালুর দাবি আইনজীবীদের মধ্যে জোরালো হচ্ছে। ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগতভাবে অনেক আইনজীবীই এখন নিয়মিত আদালত চালুর দাবিতে সোচ্চার হচ্ছেন।

গত রোববার সাধারণ আইনজীবী পরিষদের পক্ষ থেকে প্রধান বিচারপতি বরাবর একটি আবেদন করা হয়। সংগঠনের আহ্বায়ক ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক মমতাজ উদ্দিন আহমেদ মেহেদী এই আবেদন করেন। আবেদনে বলা হয়েছে, গত ১৩ মার্চ থেকে সুপ্রিম কোর্ট ও ২৬ মার্চ থেকে দেশের সব আদালতের স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। গত ৩ মাস আইনজীবীরা নিয়মিত কোর্ট করতে না পারায় অধিকাংশ আইনজীবী চরম অর্থ সংকটে পড়েছেন ও বিচারপ্রার্থী জনগণের চাপ সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন।

আবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, অধিকাংশ আইনজীবী স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিয়মিত কোর্ট চালুর পক্ষে। বর্তমানে করোনা পরিস্থিতির কারণে নিয়মিত কোর্ট না থাকায় সাজাপ্রাপ্ত আসামি, যাদের আপিল দায়রা জজ আদালতে ও হাইকোর্ট বিভাগে বিচারাধীন; তারা আইনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত। হাজারও আসামি পলাতক, তারা আইনের আশ্রয় লাভের সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে ফেরারি জীবন-যাপন করছেন। হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইন ব্যতীত অন্য কোনো আইনে নতুন কোনো মামলা ফাইলিং হচ্ছে না। এ অবস্থায় আইনজীবীদের মাঝে মারাত্মক অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে।

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান খন্দকার মাহবুব হোসেনও সম্প্রতি একই দাবি জানান।

একই দাবিতে ঈদুল ফিতরের ছুটির পর ঢাকা আইনজীবী সমিতির একদল সদস্য বিক্ষোভও করেন। স্বাস্থ্যাবিধি মেনে নিয়মিত আদালতের দাবিতে গণস্বাক্ষর কর্মসূচিও পালন করেন তারা। সেই কর্মসূচির সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে সংহতি জানান ঢাকা আইনজীবী সমিতির দপ্তর সম্পাদক এইচ এম মাসুম।

করোনার এই সময়ে কেন নিয়মিত আদালত চাইছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভার্চ্যুয়াল কোর্টে শুধু হাজতি আসামিদের জামিন শুনানি হয়। সম্প্রতি চেক ডিজঅনারের মামলা ফাইলিং শুরু হয়েছে। নতুন সিআর মামলা ফাইলিং, পলাতক আসামিদের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে জামিন শুনানি, বিচারিক কার্যক্রম ও দেওয়ানী মামলার কাজ পুরোপুরি বন্ধ। তাই বেশিরভাগ আইনজীবীই বলা যায় কর্মহীন। বিচারপ্রার্থীরাও আছে হয়রানি ও ভোগান্তিতে। সে কারণেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিয়মিত আদালত চালু করা উচিত।

অনেক আইনজীবীই দুই একটি কাজের জন্য ঢাকায় এলেও এখন আর ঢাকায় থাকার উপায় দেখছেন না। আবার ঢাকা থেকে চলে গেলে কোনো মক্কেল ফিরে যায় কি না সেই দুশ্চিন্তায় সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন।

তেমনই একজন আইনজীবী এম কাওসার আহমেদ। তিনি বলেন, ঈদের পর মাদারীপুর থেকে ঢাকায় এসে দুটি জামিন আবেদন শুনানি করেছি, একটিতে জামিন পেয়েছি, অপরটিতে পাইনি। আপাতত তেমন কাজ নেই। মহানগর দায়রা জজ আদালতে একটি জামিন আবেদন আবেদন করেছি, কবে শুনানি হবে সেটাও জানি না। এখন না পারছি ঢাকা ছাড়তে, না পারছি থাকতে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক আইনজীবীই নিজেদের দুর্দশার কথা জানাচ্ছেন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিয়মিত আদালত চালুর পক্ষে এসব প্লাটফর্মে দাবি তুলছেন তারা।  

ঢাকা আইনজীবী সমিতির নেতারা বলছেন, সঙ্কট সমাধানে বার থেকে নানামুখী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সমিতির সভাপতি মো. ইকবাল হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, আইনজীবীদের সমস্যাা আমরাও উপলব্ধি করছি। তাই ঈদের আগে প্রায় ৫ হাজার আইনজীবীকে সুদমুক্ত ঋণ দিয়েছি। এখন বার কাউন্সিল থেকে প্রাপ্ত পৌনে দুই কোটি টাকা বিতরণে আবেদন গ্রহণ করছি।

তিনি আরও বলেন, আমরা আলোচনা করে এনআই অ্যাক্টের মামলার ফাইলিংয়ের ব্যবস্থা করেছি। এখন পরিবেশ পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হলে নিয়মিত আদালতের কার্যক্রম চালুর বিষয়ে আমরা আবার দাবি জানাব। আশা করছি দ্রুতই এই সঙ্কট কেটে যাবে।

বাংলাদেশ সময়: ০৮০৩ ঘণ্টা, জুন ২৫, ২০২০
কেআই/এজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।