ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

আইন ও আদালত

আবরার ফাহাদ হত্যা: জিজ্ঞাসাবাদ শেষ, অভিযোগপত্র শিগগির

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৩৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৩, ২০১৯
আবরার ফাহাদ হত্যা: জিজ্ঞাসাবাদ শেষ, অভিযোগপত্র শিগগির

ঢাকা: বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডে গ্রেফতার আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ শেষ হয়েছে। ঘটনা তদন্তে আসামিদের দফায় দফায় রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে তদন্তকারী সংস্থা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। মঙ্গলবার (২২ অক্টোবর) সব আসামির জিজ্ঞাসাবাদ শেষ হয়েছে। শিগগিরই চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দাখিল করা হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।  

সবশেষ মঙ্গলবার (২২ অক্টোবর) এএসএম নাজমুস সাদাত ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সারাফুজ্জামান আনছারী তার জবানবন্দি রেকর্ড করেন।

এরপর সাদাতকে কারাগারে পাঠানো হয়। তিনিসহ নির্মম এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার বিষয়ে মোট আটজন স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। তাদের সবাই এজাহারভুক্ত আসামি।

গত ৬ অক্টোবর রাতে বুয়েটের শেরেবাংলা হলে ছাত্রলীগের কিছু বেপরোয়া নেতাকর্মীর হাতে নির্দয় পিটুনির শিকার হয়ে মারা যান বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদ। এই ঘটনায় পরদিন নিহতের বাবা বরকত উল্লাহ বাদী হয়ে ১৯ জনকে আসামি করে চকবাজার থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলাটির তদন্ত করছেন ডিবির লালবাগ জোনের পরিদর্শক মো. ওয়াহিদুজ্জামান।  

এই মামলায় এজাহারভুক্তসহ মোট ২০ জনকে গ্রেফতার করেছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তারা সবাই বুয়েটের শিক্ষার্থী, যার মধ্যে ১৬ জনই মামলার এজাহারভুক্ত আসামি। গ্রেফতার ব্যক্তিদের মধ্যে মিজানুর রহমান মিজান ছাড়া বাকি সবাইকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা। অসুস্থ থাকায় মিজানকে গ্রেফতারের পরপরই কারাগারে পাঠানো হয়।  

এই মামলায় গত ৮ অক্টোবর প্রথম দফায় ছাত্রলীগের ১০ নেতাকর্মীকে পাঁচদিনের রিমান্ডে পাঠান আদালত। তারা হলেন বুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল, সহ-সভাপতি মুহতাসিম ফুয়াদ, সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান রবিন, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক অনিক সরকার, ক্রীড়া সম্পাদক মেফতাহুল ইসলাম জিওন, উপ-সমাজসেবা সম্পাদক ইফতি মোশাররফ, সদস্য মুনতাসির আল জেমি, মুজাহিদুর রহমান মুজাহিদ এবং খন্দকার তাবাখখারুল ইসলাম তানভির ও ইসতিয়াক আহম্মেদ মুন্না।

রিমান্ডে থাকা অবস্থায় ১০ অক্টোবর ইফতি মোশাররফ সকাল, ১১ অক্টোবর মেফতাহুল ইসলাম জিওন, ১২ অক্টোবর অনিক সরকার, ১৩ অক্টোবর মুজাহিদুর রহমান ও ১৪ অক্টোবর মেহেদি হাসান রবিন ঘটনায় সম্পৃক্ততার বিষয়ে আদালতে স্বীকারোক্তিমুলক জবানবন্দি দেন। এছাড়া ১৩ অক্টোবর কারাগারে পাঠানো হয় বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল, সহ-সভাপতি মুহতাসিম ফুয়াদ, গ্রন্থ ও প্রকাশনা সম্পাদক ইশতিয়াক আহমেদ ওরফে মুন্না, সদস্য মুনতাসির আল জেমি ও খন্দকার তাবাখখারুল ইসলাম ওরফে তানভীরকে। এতে প্রথম দফায় রিমান্ডে থাকা ১০ জনের পাঁচজন স্বীকারোক্তি দেন ও পাঁচজনকে কারাগারে পাঠানো হয়। অবশ্য কারাগারে পাঠানো পাঁচজনের মধ্যে তাবাখখারুল ইসলাম তানভীরকে দ্বিতীয় দফায় রিমান্ডে নেওয়ার পর গত সোমবার (২১ অক্টোবর) আদালতে স্বীকারোক্তি দেন।

এই মামলায় ৯ অক্টোবর আরও তিনজনকে পাঁচদিনের রিমান্ডে পাঠান আদালত। তারা হলেন শামসুল আরেফিন রাফাত (২১), মনিরুজ্জামান মনির (২১) ও আকাশ হোসেন (২১)। ১৫ অক্টোবর মনির আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। ওইদিনই রাফাতকে দ্বিতীয় দফায় চারদিনের রিমান্ডে ও আকাশকে কারাগারে পাঠানো হয়। দ্বিতীয় দফায় রিমান্ড শেষে ২০ অক্টোবর রাফাতকেও কারাগারে পাঠানো হয়।

গত ১১ অক্টোবর তৃতীয় দফায় আরও দু’জনকে পাঁচদিনের রিমান্ডে পাঠান আদালত। এই দু’জন হলেন বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত উপ-আইন সম্পাদক অমিত সাহা ও বুয়েটের আরেক শিক্ষার্থী হোসেন মোহাম্মদ তোহা। রিমান্ড শেষে ১৭ অক্টোবর তোহাকে কারাগারে পাঠানো হয়। একই দিনে অমিত সাহাকে আদালত ফের তিনদিনের রিমান্ডে পাঠান। দুই দফা জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ২০ অক্টোবর অমিতকেও কারাগারে পাঠানো হয়।

১২ অক্টোবর মাজেদুর রহমান, ১৩ অক্টোবর শামীম বিল্লাহ (২০) ও মোয়াজ আবু হুরায়রা এবং ১৬ অক্টোবর এএসএম নাজমুস সাদাতকে পাঁচদিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। রিমান্ড শেষে ১৮ অক্টোবর মাজেদ, ১৯ অক্টোবর শামীম ও মোয়াজ এবং ২০ অক্টোবর রাফাতকে কারাগারে পাঠানো হয়।  

সবশেষ রিমান্ডে থাকা নাজমুস সাদাত মঙ্গলবার (২২ অক্টোবর) স্বীকারোক্তি দিলে তাকেও কারাগারে পাঠানো হয়। এনিয়ে এই ঘটনায় গ্রেফতার ২০ জনের সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে কারাগারে পাঠানো হলো। এর মধ্যে ইসতিয়াক আহম্মেদ মুন্না, অমিত সাহা, মিজানুর রহমান মিজান ও শামসুল আরেফিন রাফাত ছাড়া বাকি সবাই এজাহারভুক্ত আসামি।  

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, প্রথম স্বীকারোক্তি দেওয়া সকাল বলেছেন, ৬ অক্টোবর রাত ৮টার কিছু পর ফাহাদকে শেরেবাংলা হলের ২০১১ নম্বর কক্ষে নিয়ে আসা হয়। এসময় তার মোবাইল ও ল্যাপটপ চেক করে কারা শিবির করে, তা বের করার চেষ্টা করেন উপস্থিত ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। কিন্তু, তথ্য না পেয়ে রাফাত ক্রিকেটের স্টাম্প এনে সকালের হাতে দেন। সকাল ফাহাদকে স্টাম্প দিয়ে চার-পাঁচটি আঘাত করেন। এতে স্টাম্পটি ভেঙে যায়। এরপর একে একে ফাহাদকে মারেন অনিক, জিওন, রবিন, মুজাহিদ ও তানভীর। মেসেঞ্জারে মারার জন্য নির্দেশনা দেন অমিত সাহাও।

মেহেদি হাসান রবিন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেন, সকাল, জিসান, তানিম, সাদাত, মোরশেদ বিভিন্ন সময়ে ওই কক্ষে আসেন ও ফাহাদকে মারেন। মোয়াজ, বিটু, তোহা, বিল্লাহ ও মুজাহিদও ঘুরে ফিরে এসে তাকে মারধর করেন। ব্যাপক মারধরের কথা আদালতে স্বীকার করেছেন ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেওয়া অন্যরাও।

তবে, কারাগারে থাকা অমিত সাহা আদালতে হাজির হয়ে বলেছিলেন, পূজার ছুটিতে তিনি বাড়িতে ছিলেন। তাই, এই হত্যাকাণ্ডে তিনি জড়িত নন। গত ১৭ অক্টোবর দ্বিতীয় দফায় রিমান্ড শুনানির সময় আদালতে কয়েক দফায় কান্নাকাটি করেন অমিত সাহা। এসময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ঘটনার দিন আমি সেখানে ছিলাম না। রাত দেড়টার দিকে খবর পেয়েছি। আমি মিথ্যাভাবে ফেঁসে গেলাম।

হোসেন মোহাম্মদ তোহা রিমান্ড শুনানির আগে মারধরে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেন। তবে, কেন অন্যরা মারলেও তিনি ঠেকাননি- এ বিষয়ে আদালতে শুনানির আগে তিনি বলেন, ঠেকাতে গেলে বড় ভাইরা আমাদেরও মারধর করতো। বড় ভাই কারা জানতে চাইলে তিনি সকাল, জিওন, রবিনসহ কয়েকজনের নাম বলেন।

সবশেষ নাজমুস সাদাত গত ১৬ অক্টোবর রিমান্ড শুনানির দিন ফাহাদকে রুম থেকে ডেকে আনার কথা স্বীকার করেন। আদালতে আসামিপক্ষের কোনো আইনজীবী না থাকায় বিচারক সাদাতের কাছে তার কিছু বলার আছে কি-না জানতে চান। সাদাত আদালতকে বলেন, আমি ফাহাদকে মারিনি, বড়ভাইদের কথায় তাকে তার রুম থেকে ডেকে আনি।

এপর্যায়ে বিচারক আসামির কাছে জানতে চান, বড় ভাই কারা? জবাবে সাদাত বলেন, অনিক, সকাল, মুজাহিদ, রবিন ও মনির। ওরাই ফাহাদকে মেরেছে। আমি রাত সাড়ে ১২টার দিকে সেখান থেকে চলে আসি। এরপর কী হয়েছে তা জানি না।

আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ শেষ হয়েছে। এবার প্রাপ্ত তথ্য যাচাই-বাছাই করা হবে। এরপর দেওয়া হবে চার্জশিট। এই মামলায় চার্জশিট দাখিলের জন্য আগামী ১৩ নভেম্বর দিন ধার্য আছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই প্রতিবেদন দাখিলের জন্য কাজ চলছে বলে ডিবি সূত্রে জানা গেছে।

মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের অন্যতম আইনজীবী ও চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতের সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর হেমায়েত উদ্দিন খান হিরন বাংলানিউজকে বলেন, গুরুত্ব বিবেচনায় এই মামলায় অতিদ্রুত তদন্তকারী কর্মকর্তা চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দাখিল করতে পারবেন বলে আমরা আশা করছি। মামলায় এজাহারনামীয় ১৬ জনসহ গ্রেফতার মোট ২০ আসামিকেই জিজ্ঞাসাবাদ শেষ হয়েছে। অনেকে আদালতে স্বীকারোক্তিও দিয়েছেন। তদন্ত কর্মকর্তা এখন এসব জবানবন্দি পর্যালোচনা করে চার্জশিট দাখিল করবেন। জবানবন্দির বিস্তারিত চার্জশিটে উঠে আসবে। চার্জশিট দাখিলের পর দ্রুততম সময়ের মধ্যেই এই মামলার বিচার কার্যক্রম শুরু হবে বলে আশা করছি।  

এর আগে, ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার মো. মনিরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেছিলেন, আমরা আশ্বস্ত করতে চাই, আগামী মাসের শুরুতে বিজ্ঞ আদালত যে তারিখ দিয়েছেন, তার আগেই- অর্থাৎ আগামী মাসের শুরুর দিকে এই মামলার তদন্ত কাজ শেষ হবে। তখন আমরা একটা পূর্ণাঙ্গ চিত্র দিতে পারবো।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালও একই ধরনের কথা বলেছিলেন। গত শনিবার (১৯ অক্টোবর) তিনি সাংবাদিকদের বলেন, এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতার করেছি। মামলার নির্ভুল অভিযোগপত্র দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি। দ্রুততম সময়ের মধ্যে ফাহাদের পরিবার যেন ন্যায়বিচার পায়, তার ব্যবস্থা করা হবে।

বাংলাদেশ সময়: ০৮৩৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৩, ২০১৯
কেআই/একে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।