ঢাকা, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

আইন ও আদালত

জাহালমের মামলা

কী আছে দুদকের সেই প্রতিবেদনে?

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬২৬ ঘণ্টা, জুলাই ১২, ২০১৯
কী আছে দুদকের সেই প্রতিবেদনে?

ঢাকা: ‘এ মামলাগুলোতে প্রায় ১২ জন আইও (তদন্তকারী কর্মকর্তা) তদন্ত করে তদন্ত প্রতিবেদন কমিশনে জমা দিয়েছিলেন। কিন্তু তাদের কেউই আসামি জাহালমের বাড়ি পরিদর্শন করেননি। আমি আমার তদন্তকালে জাহালমের বাড়ি পরিদর্শন করেছি।

তার বাড়ির দৈন্যদশা এতটাই প্রকট যে, কোনো ব্যক্তির সন্দেহ হওয়া স্বাভাবিক যে, ১৮ কোটি টাকা আত্মসাতের জড়িত একজন ব্যক্তির বাড়ির এই দৈন্যদশা কেন? তার বাড়ি পরিদর্শন করলেই আইও-দের মনে সন্দেহ দেখা দিত। জাহালমকে যখন দুদকের আইও-গণ প্রথম দেখে তখন সে একজন পাটকল শ্রমিক এই প্রশ্নটি কেন আইওদের মনে আসলো না সেটি বোধগম্য নয়।

জাহালমকাণ্ডে দুদকের প্রতিবেদনে এমন মন্তব্য করেছেন কমিশনের পরিচালক (লিগ্যাল) ও এ সংক্রান্ত দুদকের তদন্ত কমিটির প্রধান আবুল হাসনাত মো. আব্দুল ওয়াদুদ।

‘দুর্নীতি দমন কমিশন কর্তৃক দায়েরকৃত ৩৩টি মামলায় মূল আসামির পরিবর্তে ভুল ব্যক্তি মো. জাহালম চার্জশিটভুক্ত হওয়া ও কারাগারে অন্তরীণ থাকা সংক্রান্ত ঘটনার বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদন’ শীর্ষক প্রতিবেদন বৃহস্পতিবার (১১ জুলাই) হাইকোর্টে দাখিল করে দুদক।
 
প্রতিবেদনটি দাখিলের পর বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের বেঞ্চ শুনানির জন্য মঙ্গলবার (১৬ জুলাই) দিন ঠিক করেছেন।
 
আদালতে দুদকের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী খুরশীদ আলম খান। জাহালমের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী অমিত দাশ গুপ্ত। আইনজীবী মো. আসাদুজ্জামান ব্র্যাক ব্যাংকের পক্ষে মামলার শুনানিতে অংশ নেন।  
 
গত জানুয়ারিতে একটি জাতীয় দৈনিকে ৩৩ মামলায় ‘ভুল’ আসামি জেলে ‘স্যার, আমি জাহালম, সালেক না...’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদন আদালতের নজরে আনেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অমিত দাশ গুপ্ত।

এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে দুদকের কর্মকর্তা, মামলার বাদীসহ চারজনকে তলব করেন হাইকোর্ট বেঞ্চ। এছাড়া রুলও জারি করেন আদালত।

পরে ৩ ফেব্রুয়ারি সংশ্লিষ্টরা হাজিরের পর হাইকোর্ট জাহালমকে মুক্তির নির্দেশ দেন এবং দুদকের কাছে ঘটনার বিষয়ে হলফনামা আকারে জানতে চেয়েছেন। সে আদেশ অনুসারে, দুদক হলফনামা আকারে তা উপস্থাপন করেন।

পরে জাহালম প্রশ্নে ব্যাংক ঋণ জালিয়াতির ৩৩ মামলার এফ আই আর, চার্জশিট, সম্পূরক চার্জশিট এবং সব ব্যাংকের এ সংক্রান্ত নথিপত্র দাখিল করতে দুদককে নির্দেশ দেন।  

এর ধারাবাহিকতায় হাইকোর্ট গত ১৭ এপ্রিল জাহালম কাণ্ডে কে বা কারা দায়ী তা দেখার জন্য এ বিষয়ে দুদক প্রতিবেদন চেয়েছিলেন। সে অনুসারে প্রতিবেদন দাখিল করেন।

আবুল হাসনাত মো. আব্দুল ওয়াদুদ প্রতিবেদনে বলেন, ‘সার্বিক বিবেচনায় আমার কাছে প্রতীয়মান হয়েছে যে, জাহালমকে আবু সালেক রূপে চিহ্নিত করার যে ভুলটি হয়েছে তা দুদকের তদন্তকারী কর্মকর্তাদের কারণেই ঘটেছে। আর তাদের ভুল পথে চালিত করতে সহায়তা করেছে ব্র্যাক ব্যাংক ও অন্যান্য ব্যাংকের কর্মকর্তা এবং অ্যাকাউন্টের ভুয়া ব্যক্তিকে পরিচয়দানকারীরা। তবে সঠিক ঘটনা তথা সত্য উদঘাটন করে আদালতের কাছে তা উপস্থাপন করাটাই তদন্তকারী কর্মকর্তাদের দায়িত্ব।

প্রতিবেদনে মামলাগুলোর তদারকি, অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা, বাদী, সাবেক মহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্টদের অবহেলাকে দায়ী করা হয়েছে। পাশাপাশি ব্যাংক কর্মকর্তাদেরও দায়ী করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ৩৩ মামলার আইও-রা সিরিয়াস ও সঠিকভাবে মামলার তদন্ত করেননি। প্রত্যেকেই একে অপরের উপর নির্ভরশীল ছিলেন। প্রত্যেকেই আশায় ছিলেন অন্যরা তদন্তে অগ্রগতি করলে তারা সেটি কপি করবে এবং সেটিই তারা করেছেন। এরমধ্যে শুধুমাত্র ব্যতিক্রম সেলিনা আখতার মনি। শুধুমাত্র সে-ই আবু সালেককে শনাক্ত করা বা খুঁজে বের করার জন্য তৎপর ছিলেন।

এতে আরও বলা হয়, ২০১২ সালের ৮ মার্চ ৩৩ টি মামলা করার সুপারিশ করে প্রতিবেদন জমা দেন। এরপর কমিশনের অনুমোদন নিয়ে ৩৩টি মামলা করা হয়। কিন্তু কেন অনুসন্ধান কর্মকর্তা একটি মামলায় স্থির না থেকে ৩৩টি মামলার দিকে ধাবিত হলেন, তার কিছুই অনুসন্ধান প্রতিবেদনে উল্লেখ করেননি।  

তিনি আগে তার একটি প্রতিবেদনে বলেছিলেন, একই ঘটনায় একাধিক এফআইআর দায়ের করা আইন সম্মত নয়। তাহলে ‘আইন সম্মত নয়’ কাজটি কেন তিনি পরবর্তীতে করলেন তার বিস্তারিত বিবরণ অবশ্যই তার প্রতিবেদনে থাকা উচিৎ ছিলো।

 
একটি মামলার পরিবর্তে ৩৩টি মামলা করা এবং মামলার ঘটনাস্থল পরিবর্তন করে ফেলা-এগুলোর সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ আইনগত প্রশ্ন জড়িত ছিলো। অভিযোগটির অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা বা তদারককারী কর্মকর্তা বা সংশ্লিষ্ট মহাপরিচালক কেউ-ই আইন অনুবিভাগের আইনগত মতামত নেননি।  

লিগ্যাল অনুবিভাগের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করলে কিংবা তাদের মতামত গ্রহণ করলে এই ভুলটি এড়ানো সম্ভব হতো। এই ভুলের দায় অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা (ইও) ও তদারককারী কিংবা সংশ্লিষ্ট মহাপরিচালক এড়াতে পারেন না।

প্রতিবেদনে তদন্তকালে বিচ্যুতির কথা উল্লেখ করে বলা হয়, আবু সালেকসহ অন্যদের ধরিয়ে দিতে ছবি দিয়ে পত্রিকা বা টিভিতে বিজ্ঞাপন দেওয়া যেত, তা দেওয়া হয়নি, জাহালমের সঙ্গে মামলার অন্য আসামিদের মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি।  

এছাড়া জাহালমের সামাজিক ও আর্থিক সঙ্গতি বিবেচনায় না নেওয়া, ব্যাংক কর্মকর্তাদের দায়-দায়িত্ব সঠিকভাবে নিরূপণ না করা, আত্মসাৎকৃত টাকার গন্তব্যের পর্যাপ্ত তথ্য সংগ্রহ না করা, আইন অনুযায়ী ব্যাংক কর্মকর্তাদের অভিযুক্ত না করা।

প্রতিবেদনে বলা হয়, সঠিক ঘটনা তথা সত্য উদঘাটন করে আদালতের নিকট তা উপস্থাপন করাটাই তদন্তকারী কর্মকর্তাদের দায়িত্ব। এক্ষেত্রে ব্যাংক কর্মকর্তাদের ওপর বা অন্য কারো ওপর এই দায়িত্ব অর্পণ করার সুযোগ নেই। বিশেষ করে তদন্তকারী কর্মকর্তাদের এটা লক্ষ্য করা উচিৎ ছিল যে, প্রথমে কিন্তু ব্যাংক কর্মকর্তারা কিংবা অ্যাকাউন্টের শনাক্তকারীরা আবু সালেককে শনাক্ত করতে কিংবা তাকে খুঁজে বের করতে তৎপর হননি।

সব শেষে কিছু অনুসন্ধান ও তদন্তে পদ্ধতিগত কিছু সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, অনুসন্ধান ও তদন্তকাজে কার্যকর তদারকি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা (অনুসন্ধান তদারকি প্যানেল) করা।

ট্রেইল দ্য মানি (কোনো দুর্নীতির অপরাধ সংঘটনের পর ওই ঘটনার প্রকৃত সুবিধাভোগী নির্ধারণ এবং আইনের আওতায় আনার জন্য) প্রতিষ্ঠা করা। অপরাধলব্ধ অর্থ বা সম্পদের গতিবিধি অনুসরণ করে মূল অপরাধী শনাক্ত করার লক্ষ্যে ফরেনসিক অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্ট প্রতিষ্ঠা করা সাক্ষী ও আসামিদের ব্যক্তিগত তথ্য যাচাই করা।  

এর জন্য নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি করে নির্বাচন কমিশনের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) প্রকল্পের তথ্য ভাণ্ডার ব্যবহার করা যেতে পারে।

অনুসন্ধান নোটবই ও কেস ডায়রি যথাযথভাবে লেখা ও সংরক্ষণ করা। গুরুত্বপূর্ণ আসামিদের রিমান্ডে এনে ব্যাপক ও নিবিড় জিজ্ঞাসাবাদ করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি রেকর্ডের ব্যবস্থা করা। একই ঘটনায় একাধিক মামলা দায়ের না করা।  

সাক্ষী হারিয়ে যাওয়া এবং আসামিরা পালিয়ে যেতে পারে এ কারণে মামলার তদন্ত গোপনে দ্রুত শেষ করা, দুদক আইনজীবীদের সঠিকভাবে মামলা পরিচালনা করা।  

আদালতে গুরুত্বপূর্ণ আদেশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা কমিশনকে অবহিত করা। একই ঘটনায় একাধিক মামলা করার বিষয়ে লিগ্যাল অনুবিভাগের মতামত নিতে হবে ইত্যাদি।

বাংলাদেশ সময়: ১৪২১ ঘণ্টা, জুলাই ১২, ২০১৯
ইএস/এমএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।