ঢাকা, সোমবার, ২২ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ মে ২০২৪, ২৬ শাওয়াল ১৪৪৫

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে

গিরিখাদ পেরিয়ে রহস্যময় আলীর সুড়ঙ্গে

জাকারিয়া মন্ডল, সিনিয়র আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০২৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ২০, ২০১৬
গিরিখাদ পেরিয়ে রহস্যময় আলীর সুড়ঙ্গে ছবি: সোহেল সরওয়ার

আলীকদম (বান্দরবান থেকে): গিরিখাদের ওপর কাঠের সাঁকোটা ভাঙ্গা। গোটা দু’তিন গাছের ডাল কোনক্রমে সেঁটে আছে দু’পাড়ের পিচ্ছিল মাটিতে।

প্রতিটিতে গেঁথে থাকা চোখা তার কাঁটাগুলো বিপদের বার্তা দিচ্ছে যেনো। টোয়াইন খাল পার হয়ে প্রথমে প্রায় ৭০ ফুট উঁচু চড়াইয়ে ওঠার পর পিচ্ছিল পথ বেয়ে নেমেই এই বিপদ।

এক পা দু’পা করে ভাঙা সাঁকো পার হতেই দরদরিয়ে ঘাম ছুটলো। পাহাড়ের গায়ে ঝুলে আছে এক চিলতে সরু পথ। বাঁয়ে কিছু দূর এগুতেই পাওয়া গেলো ঝিরির মুখ। এবার ঝিরি ধরে এগুতে হবে।

ঝিরির মেঝেতে বিছিয়ে আছে নানা আকৃতির পাথর আর নুড়ি। মাঝেমধ্যে পচা, আধাপচা গাছের গুঁড়ি। এগুলো কি প্রবল বর্ষায় ভেসে এসেছে? তাহলে বৃষ্টি হলে কতোটা প্রমত্ত হবে এই ঝিরি?

মুখের দিকে ফুট দশেক চওড়া হলেও ধীরে ধীরে কমতে লাগলো জিরির প্রশস্ততা। অন্তত ষাট ফুট উঁচু পাথুরে দেওয়াল যেনো দু’দিক থেকে চেপে আসছে। ঠিক যেনো কেউ কুঠারের কোপে চিরে দিয়েছে পাহাড়টা। খাড়া দেওয়ালের মাথায় জংলি আগাছা আর নানা প্রজাতির গাছ ঝুঁকে এসে ডালপালার ছাদ গড়ে দিয়েছে মাথার ওপর। ঠেকিয়ে দিয়েছে রবির প্রবেশাধিকার।

ঝিরির মেঝেটা তাই স্যাঁতস্যাঁতে। তার ভেতরেই এখানে ওখানে জমা হওয়া জলে ছোট ছোট পাহাড়ি মাছ। পড়ে থাকা পচা গাছে অচেনা পোকা। খাড়া দেওয়াল বেয়ে চুইয়ে নামছে পানি। কোথাও কোথাও যেনো ধারালো ছুরির প্রান্ত হয়ে উঠেছে দেওয়াল থেকে বেরিয়ে থাকা পাথরের পাত।
এক স্থানে বিভিন্ন সাইজের বাঁশ কেটে রাখা। অভিযাত্রীদের লাঠির প্রয়োজন হতে পারে ভেবে কেউ কি এগুলো কেটে রেখেছে?

আর একটু এগুতে আরো সরু হলো গিরিখাদ সদৃশ ঝিরির মেঝে। কোনোক্রমে একজন মানুষ যেতে পারে সেখান দিয়ে। পানির তোড়ে তাই গভীরতা বেড়েছে এখানকার। সরু খাদের নিচে কয়েক ইঞ্চির বেশি জায়গা হবে না। বৃষ্টিহীন সময়েও সেখানে উরু সমান পানি। এ পানি মাড়াতে না চাইলে এ স্থান পার হতে হবে দু’পাশের খাড়া দেওয়ালে একেক দিকে এক রেখে।

কোথাও বেশি, কোথাও কম পানি মাড়িয়ে আর একটু এগুলে দু’ভাগ হয়ে গেছে গিরিখাদ। বাঁয়ের সরু খাদটাকে পাশ কাটিয়ে পাথরের চাঙ্গর আর গাছের গুঁড়ির ওপর দিয়ে আর একটু এগুতেই একটা লোহার সিঁড়ি, উপরের এক অন্ধকার সুড়ঙ্গ থেকে বিপরীত পাশের দেওয়ালের সঙ্গে সাঁটা। স্থানটা সংকীর্ণ বলে ঝিরির মেঝে পর‌্যন্ত নামানো সম্ভব হয়নি সেটা।

ঝুলন্ত খাড়া সিঁড়িটার নিচের দিকে এক পাশ ভাঙ্গা, ওঠার সময়ে পাথুরে দেওয়ালে বাড়ি খেয়ে ঠক ঠক শব্দ তুলছে।

সিঁড়ির মাথায় ওঠার পর কয়েক ফুট উঁচু পিচ্ছিল একটা চড়াই। পা হড়কালেই নিচের পাথুরে মেঝেতে নিশ্চিত শরীর আর মাথা থেঁতলে যাবে।

হাঁচড়ে পাঁচড়ে কোনোমতে পিচ্ছিল পথ বেয়ে উপরে উঠতেই গ্রাস করলো নিকষ অন্ধকার। সামনে কি যেনো ডানা ঝাপটাচ্ছে। সার্চ লাইটের আলো ফেলেও অন্ধকার খুব একটা দূর করা গেলো না। সুড়ঙ্গের পাথুরে দেওয়ালে অদ্ভূত এক রূপ নিয়েছে আলোর প্রতিফলন।

সুরঙ্গের শরীর মৃসন নয়, এবড়োথেবড়ো। মাঝেমাঝে গর্ত। মেঝেতে পিচপিচে কাদা। দীর্ঘ দিন ধরে জমা হওয়া বাদুড়ের মলই কি এমন কাদায় রূপ নিয়েছে? তাহলে বাদুড়গুলো গেলো কোথায়? পা টিপে টিপে আর একটু এগুতেই একটা বড় পাথর পড়লো সামনে। ওপরটা অপেক্ষাকৃত মসৃণ। এখানে কোনো যোগী বা দরবেশ বশে ধ্যান করতেন কি? কে যেনো একছড়া সাদা তসবিহ রেখে গেছে পাথরটার ওপর।

সরুপথে কোনোক্রমে পাথরটাকে পাশ কাটিয়ে আর একটু এগুতেই সুরঙ্গের ছাদটা যেনো আরো নেমে এলো মেঝের দিকে। হামাগুড়ি দিয়ে আরো সামনে হয়তো যাওয়া যাবে, কিন্তু সেখানে দু’ভাগ হয়ে গেছে সুড়ঙ্গটা। কোনো সুড়ঙ্গেই মানুষ গলতে পারবে না।

ওই দুই সরু সুড়ঙ্গের শেষ কোথায়? বাদুড়গুলো কি ওই সরু পথেই লুকিয়ে পড়লো? কোথায় বেরিয়েছে ওই দুই সরু সুড়ঙ্গ? কতো দীর্ঘ ওগলো? ওই দুই সুড়ঙ্গ গলে একটু একটু বাতাস আসছে কি? মূল সুড়ঙ্গের এতো ভেতরে তো অক্সিজেনের অভাব বোধ হচ্ছে না।

কেনো আলীর সুড়ঙ্গ নাম এই ভৌতিক গুহার? কে এই আলী? এই সুড়ঙ্গ কি প্রাকৃতিক? নাকি মানুষের কাটা? কাটা হলে এতো শক্ত পাথর কাটলো কি দিয়ে? কতো সময় লাগলো পাহাড়ের শরীর থেকে এতোটা পাথর কেটে সরাতে? চলবে

আরও পড়ুন: 

** সবচেয়ে উঁচু রাস্তায় হাতের মুঠোয় প্রাণ
** পায়ের নিচে ছবির মতো বলি পাড়া
** পাহাড়ের উপরে দেবতার পুকুর 
** পাহাড়ের খাদে রাম-সীতার ধুমনিঘাটে
** বাঁশের রাজবাড়িতে এক চক্কর
** বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া ভারতীয় বাঁকে
** বয়সী বটের নিচে বিশ্বাসের বাসা 
** গিরিখাদের হাজারছড়ায় সীমাহীন বিস্ময়

** দুর্গম বন-পাহাড়ের সুন্দর ঝরনায়

বাংলাদেশ সময়: ১০১৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ২০, ২০১৬
জেডএম 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।