ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

আইন ও আদালত

কেন বাড়ছে বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা

এরশাদুল আলম প্রিন্স, ল’ এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪০২ ঘণ্টা, আগস্ট ২২, ২০১৪
কেন বাড়ছে বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা

আইন কমিশন বিচারপতিদের অবসর গ্রহণের বয়স ৭৫ বছর করার সুপারিশ করেছে। একই সাথে বিচারপতি হিসেবে নিয়োগের বয়স কমপক্ষে ৫০ বছর করারও সুপারিশ করেছে কমিশন।



এ প্রস্তাবানুসারে বিচারপতিরা সর্বোচ্চ ৫০ থেকে ৭৫ বছর পর্যন্ত বিচারকাজ পরিচালনা করতে পারবেন। কমিশন এর পক্ষে যুক্তি হিসেবে বলছে যে, এতে করে অভিজ্ঞ বিচারকরা দক্ষতার সঙ্গে অধিক সময় বিচারিক দায়িত্ব পালন করতে পারবেন।

একথা সত্যি যে বিচারকরা অধিক সময় ধরে বিচারিক দায়িত্ব পালন করলে তাতে বিচারের মান বৃদ্ধি পেতে পারে। সেই সাথে দক্ষতা অর্জনের বিষয়টিও প্রাসঙ্গিক। তবে, সেই বয়স ৭৫ পর্যন্তই হতে হবে এমন নজির আমাদের হাতে নেই। যুক্তরাষ্ট্রসহ আরো দুএকটি দেশে ৭৫ বা তার কাছাকাছি বয়সের কথা বলা থাকলেও তার নীতিটি ভিন্ন। ‘অবসরকালীন বয়স’ শব্দটি বা বিষয়টি সেই সব ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়নি। বরং আদালতের বিচারকদের সুযোগ-সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্র বয়স সীমা নির্ধারণ করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু আমরা সেই নীতিটি গ্রহণ না করে অবসরকালীন বয়সর ওপর জোর দিয়েছি আমাদের সংবিধানে।  

বাংলাদেশের বিচারপতিদের দক্ষতা, জবাবদিহিতা ও সুনাম সারা বিশ্বেই সমাদৃত ছিল। তাদের সেই সুনাম এখনো বিলীন হয়ে যায়নি। বরং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থাকতে পারলে ও সেই সাথে বিচারকরা স্বাধীন মনোভাবাপন্ন হলে জনগণ একটি স্বাধীন বিচার বিভাগের সুফল ভোগ করতে পারবে। কারণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কেবল বাহ্যিক প্রভাবমুক্ত কোনো বিষয় নয়, বরং অভ্যন্তরীণ স্বাধীনতা কতুটুকু আছে সে বিষয়টি আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
 
একটি গণতান্ত্রিক দেশে স্বাধীন বিচার বিভাগের কোনো বিকল্প নেই। অধ্যাপক এন্থনি এলট বলেছিলেন, বিচারবিভাগ অনেক উন্নত গণতান্ত্রিক দেশেও হুমকির মধ্যে পড়তে পারে।   এমনকি যুক্তরাজ্যের মতো আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেও এমনটি হতে পারে। সেজন্য এক্ষেত্রে রাষ্ট্রকেই নিরপেক্ষ ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়।     

আমাদের মতো গণতন্ত্রে রাষ্ট্রীয় নিরপেক্ষতার বিষয়টি আরো বেশি প্রাসঙ্গিক। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা যদি নিশ্চিৎ করা না যায়, তবে বিচার বিভাগ তার ওপরে ন্যাস্ত দায়িত্ব পালন সক্ষম হবে না।  

বিচারকদের স্বাধীনতার বিষয়টি জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি বিষয়। জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক দলিলের মাধ্যমেই এর স্বীকৃতি রয়েছে।  

বিচারবিভাগের স্বাধীনতার ওপর যে কয়েকটি মৌলিক দলিল আছে তার মধ্যে অন্যতম হলো বেইজিং স্বারক/সনদ, বিচারকদের সার্বজনিন সনদ ও লাটিমার গাইডলাইন বা নীতিমালা ইত্যাদি।

সবগুলো সনদেই বিচারকদের স্বাধীনতার বিভিন্ন বিষয়ের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। সবক্ষেত্রেই বিচারপতিদের চাকুরিকালের নিরাপত্তার ওপর অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এছাড়া  বিচারক নিয়োগে দলীয় ও ভ্রান্ত নীতি প্রয়োগও বিচার বিভাগ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, জনগণ বঞ্চিত হতে পারে বিচারের সুফল থেকে।   

কিন্তু আমাদের দেশে দলীয় বিবেচনায় বিচারপতি নিয়োগ, পদোন্নতি ও নিম্ন আদালতে বদলি সবকিছুইর চর্চ্চা হয়। সব সরকারের আমলেই আমরা বিচার বিভাগের ওপর এমন হস্তক্ষেপ লক্ষ করেছি।

এমনকি আমরা দেখেছি এখানে বিচার বিভাগ কেন্দ্রিক সংবিধানের যতোগুলো সংশোধনী আনা হয়েছে তার কোনোটিরই উদ্দেশ্য বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা নয়। বরং বিচার বিভাগকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারেই ছিল এসব সংশোধনীর শানে নুজুল।

বিচারপতির কেএম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে রাখার জন্য বিএনপি’র আমলে বিচারকদের বয়স ২ বছর বাড়িয়ে দেয়া হলো। হতে পারে, বিএনপি বিচার বিভাগের ওপর অতিশয় সদয় হয়ে বিচারকদের বয়স দুই বছর বাড়িয়েছে। কিন্তু তারপরও এতে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের উদ্দেশ্যের সন্ধান পেয়েছে আওয়ামী লীগ। আর বিএনপি তাদের সেই মহৎ উদ্দেশ্য প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে, ব্যর্থ হয়েছে আওয়ামী লীগকে আস্থায় নিতে।

এর পরে ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ৯৬ ধারা পুন:স্থাপন করে বিচারপতিদের বয়স করা হলো ৬৭ বছর। তার আগে সংবিধানের সপ্তম সংশোধনীতে বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা ৬২ থেকে করা হয়েছিল ৬৫।

সংবিধানমতে, ৬৭ বছর হওয়ার আগেও কোনো বিচারককে তাদের পদ থেকে অপসারণ করা যায়। সেক্ষেত্রে ৯৬(৩) অনুচ্ছেদ মোতাবেক গঠিত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কমিশনের মাধ্যমে বিচারকদের অপসারণ করা যেতে পারে।

বিচারকদের বয়স বাড়ানো পেছনের কারণ হিসেবে সরকার বলছে, এতে করে দক্ষ ও যোগ্য বিচারকরা অধিক সময় ধরে বিচার কাজ পরিচালনা করতে পারবে। ফলে, জনগণ বিচার বিভাগের সুফল পাবে।

গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় আইন করে বিচার বিভাগকে বিশেষ করে নিম্ন আদালতকে স্বাধীন করা হয়েছে। মূলত এটিকে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা হিসেব আখ্যায়িত না করে বরং তাত্ত্বিকভাবে একে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ বলা যেতে পারে। তবে একই সাথে নিম্ন আদালতের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও দক্ষতা বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। সেই সাথে নিম্ন আদালতের প্রতি উচ্চ আদালতের মনিটরিংও বৃদ্ধি পেয়েছে যা একটি ইতিবাচ দিক। মোদ্দা কথা, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী স্বাধীন বিচার বিভাগের সুফল পাচ্ছে।   

ভারতের বিচারকদের অবসর গ্রহণের সময়সীমা ৬৫ বছর করা হয়েছে। কিছু দিন আগেও ৬২ বছর ছিল। তবে সেখানে হাইকোর্ট বিভাগ ও সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের মধ্যে বয়সের মধ্যে ওই ব্যবাধানটি ছিল। ৬৫ বছর করার ফলে এখন দুই ধরনের আদালতের বিচারকদেরই বয়স সীমা ৬৫ হলো বছর। ভারতের প্রাক্তন আইনমন্ত্রী কপিল শিবাল আইনটি সংসদে পাশ করিয়ে নেন।

ভারতের সরকারও তখন যুক্তি হিসেবে অধিক সংখ্যক মামলা নিষ্পত্তির বিষয়টি সামনে এনেছিল। বয়স বাড়ানোর ফলে উচ্চ আদালতে মামলা নিষ্পত্তির হার কমেছে কিনা তার পরিসংখ্যান জানা জায়নি। তবে আইনটি পাশ হয়েছে। তিনি বলেছিল, "This will have a clear impact on reduction of pendency of cases in high courts,"। তবে, বিচারকদের বয়স বাড়ানো হলে মামলা নিষ্পত্তির হার বৃদ্ধি পায় এমন যুক্তি বাস্তবসম্মত নয়। নজীরও নেই।

এর পর আবার অবসরের বয়স বৃদ্ধি নিয়ে একটি মামলা আদালতে গড়ায়। প্রধান বিচারপতি পি সাতাসিভ ও বিচারপতি রঞ্জন গগজী বিচারকদের বয়স ৬৫ থেকে ৬৮তে উন্নীত করার মামলা পরিচালনা করেন। তবে, সর্বশেষ হাইকোর্টের বিচারকদের বয়স ৬০ থেকে ৬২ বছর করা হয়েছিল ১৯৬৩ সালে। চার দশক পর বিষয়টির পর্যালোচনা এক্ ইতিবাচক দিক। এটি যখন করা হয়েছিল তখন ভারতে নাগরিকদরে সাধারণ life Expectancy ছিল ৬০ বছর। সাধারণভাবে বলা হয় একজন ব্যক্তি ৬৮ থেকে ৭০ বছর পর্যন্ত সাধারণত শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে পারে।
তাই আমাদের দেশে ৭৫ বছর করার বিষয়টি পুন:বিবেচনার দাবী রাখে। বর্তমানে ৬৭ আছে সেখান থেকে ৭৫ করাটা কতটা যৌক্তিক তা ভেবে দেখা প্রয়োজন। ভারত, পাকিস্তান, নেপাল এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের নজীরও আমরা পর্যালোচনা করতে পারি। সেখানে কোথাও বিচারকদের বয়স ৭৫ বছর করা হয়নি। আমেরিকায় ৮০ বছর পর্যন্ত অবসরকালীন ভাতার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে তা বিচারকদের অবসরকালীন বয়স নয়, ভাতার বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।  

নেপালের সংবিধানেও বিচারকদের অবসরের বয়স সীমা করা হয়েছে ৬৫ বছর। সংবিধানের ১০৩ অনুচ্ছেদের (৫) উপঅনুচ্ছেদে বিষয়টি বিধৃত আছে।

পক্ষান্তরে, আমেরিকার সংবিধানে বিষয়টিকে পুরো ভিন্নভাবে দেখছে। তারা বিচারপতিদের কোনো অবসরের বয়স নির্ধারণ করেনি। তার বদলে তারা বলছে, বিচারপতিরা আজীবন অবসরকালীন ভাতা পাবেন যা কিনা সর্বোচ্চ পুরো বেতনের সমান।

তবে, এই সুযোগ সুবিধা পেতে হলে সর্বনিম্ন ১০ বছর বিচারকের দায়িত্ব পালন করতে হবে। সেই সাথে আরো একটি শর্তও জুড়ে দেয়া হয়েছে। ওই সুযোগ সুবিধা পাওয়ার জন্য তাদের নিজ বয়স ও চাকুরির বয়স এ দুটো মিলে ৮০ বছর হতে হবে। তার মানে সাধারণভাবে বলতে গেলে ৭০ বছর পর্যন্ত তাদের বয়স বিবেচনা করা হয়েছে।

সুপারিশটি মন্ত্রীসভায় পাশ হওয়া বা সংসদ কর্তৃক প্রণীত হওয়ার আগেই এর প্রাসঙ্গিকতা বিবেচনা করা প্রয়োজন। প্রয়োজন অন্যান্য দেশের প্রাসঙ্গিকতাও নজরে আনা। সেই সাথে বিচার বিভাগের সামগ্রিক অবস্থাও বিবেচ্য।

বাংলাদেশ সময়: ১৪২০ ঘণ্টা, আগস্ট ২২, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।