ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

ইচ্ছেঘুড়ি

গল্প

খেজুরিয়া

সোহেল রহমান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪১৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৬, ২০১১
খেজুরিয়া

ঘন কুয়াশা। ধূসর ফসলের ক্ষেত।

উটের পিঠের মত আকাঁবাঁকা আলপথ দিয়ে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে খেজুরিয়া। কোমরে ঝুলছে বেশ কয়েকটি মাটির হাঁড়ি। শীতের তীব্র কাপঁনে একটুও কাপঁছেনা ও।
 
‘ও খেজুরিয়া! আমাদের গাছে আগে এসো। আমাদের রস পেড়ে দিয়ে তারপর তুমি ওদেরটা পাড়ো। ’ তুলির ডাকে খেজুরিয়া আলের মাঝখানে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকায়। চারপাশটা তখনো কুয়াশার চাদরে মোড়া। আড়মোড়া ভেঙ্গে ঘুম ছেড়ে ওঠা লাল ঝুঁঠিওয়ালা মোরগটা ডেকে ওঠছে কুক্-কু-রে-কুক্। কুয়াশাভেজা কাঁচা সবুজ ঘাসের উপর তিড়িং বিড়িং করে ছুটাছুটি করছে কয়েকটা গরুর বাছুর ও  ছাগল ছানা। নীল বেগুনি ও সাদা রঙের শিমের ফুল ঝরে পড়েছে ভেজা সোদাঁ মাটিতে। তুলি ও অন্তু কে ঝাপসা  দেখতে পায় খেজুরিয়া।

আজ একটু তাড়াতাড়ি ওঠেছে ওরা। ঘুম থেকে। ওঠেই ঘুমচোখে চলে এসেছে খেজুর গাছের তলায়। সন্ধ্যেয়ও একবার এসেছিল। খেজুরিয়া যখন গাছ কেটে রসের জন্য হাড়ি বেঁধেছিল, তখন। সকাল বেলাটা ওদের জন্য এখানে অন্যরকম। দাদু ভাইয়ের রস আর শীতের ভাপা পিঠার নিমন্ত্রণে গ্রামে এসেছিল তুলি ও অন্তু। আরও সপ্তাহখানেক থাকবে। ওদের ডাকে খেজুরিয়া আর কোথাও না গিয়ে সোজা চলে এসেছে ওদের কাছে। রস পেড়ে দিল। খেজুর রসের সে কি তৃপ্তি জাগানিয়া গন্ধ! চারপাশজুড়ে সে গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। তুলি ও অন্তুর হাতে রসের হাড়ি। এক চোট চেখে দেখল তুলি। ওয়াউ! খেজুর রস তো দেখছি ভারি মজা। অন্তু! একটু টেস্ট করে দেখো না! তুলির কথায় এবার অন্তুও একবার হাড়িতে হাত দিয়ে রস চেখে দেখে। উম... সত্যিই তো! খেজুরিয়া তুলি ও অন্তুর দিকে তাকিয়ে হাসে। শহুরে এই তুলতুলে শিশুদুটোকে বড় আদুরে লাগে খেজুরিয়ার কাছে।

ডিম ভেঙ্গে বেরিয়ে আসা লাল হলদে কুসুমের মত করে আকাশের পূর্ব দিকে খেজুর গাছের ঠিক মাথার উপরে উঠেছে সূর্যটা। কচি নরম রোদ্দুর এসে লুটোপুটি খাচ্ছে উঠনে। ঘরে ততক্ষণে ভাপা পিঠা ও গরম খেজুরের রস প্রস্তুত। তুলি ও অন্তু কে খুব  যত্ন করে খেতে দেয় দাদুমনি। তারা মজা করে খাওয়া শুরু করে। পাশে বসেছেন দাদু ভাই। একটা খাওয়া শেষ হতে না হতেই দাদুভাই আরেকটা তুলে দিচ্ছে। উহ্! এত আদর যে দাদুভাই কোথায় পায়! দাদুভাইটাকে যদি শহরের বাসায় নিয়ে যাওয়া যেত! তুলি পিঠা খেতে খেতে ভাবে।
 
কোথাও এখন আর একবিন্দু কুয়াশা নেই। ঝকঝকে রোদে চারপাশটা এখন  বড়ো  পরিচ্ছন্ন দেখাচ্ছে। নারকেল সুপারির ডাল হতে আসা ঝিরিঝিরি বাতাসে জুড়িয়ে যাচ্ছে সবকিছু। তুলি আর অন্তু বের হয় সমুদ্রে যেতে। দাদু বাড়ির অল্প কিছুদূর পেছনে পারকী সমূদ্র সৈকত। খাল পার  ঘেষে খালি পায়ে হেঁটে হেঁটে সমূদ্রে যেতে থাকে ওরা।

ছোট্ট দুই ভাইবোন। তুলির এগার আর অন্তুর বয়স আট। অযতে বেড়ে ওঠা হেলেঞ্চা শাকের উপর দিয়ে আলতো পায়ে হেঁটে পৌঁছে যায় সমুদ্রপাড়ে। তুলি আর অন্তু।   সমুদ্রের ঢেউয়ের শব্দ কানে আসে ওদের। বালির উপর আছড়ে পড়ছে সমুদ্র বুক হতে তেড়ে আসা প্রকান্ড ঢেউ। সমুদ্রের হাঁটু পানিতে নামে ওরা। দূরন্ত শৈশব এসে তাদের আকঁড়ে ধরে। ভাইবোন মিলে হারিয়ে যায় ঢেউ খেলায়। সে কি অপূর্ব ঢেউ ঢেউ খেলা। এবার তাদের পথে কে আর বাঁধ সাধে? ঝাউয়ের রি রি শব্দ সাঁ করে চলে যাচ্ছে কানের পাশ দিয়ে। সমুদ্র জলে একটু পর পর ঠোকর দিচ্ছে সমুদ্র পাখীরা।

পৌষের বিকেল মরে আসছে গোধূলী সন্ধ্যের কোলে। তুলি আর অন্তু হাত ধরাধরি করে হাঁটতে থাকে। সমুদ্র ছেড়ে ঝাউবনটা পেরিয়ে ওরা চলে যায় গ্রামের মেঠোপথের দিকে। কিন্তু দাদুবাড়ি কই? খুঁজে পায় না ওরা। সন্ধ্যের ছুঁই ছুঁই অন্ধকার। ওরা বুঝে পায় না এখন কোন দিকে যাবে? সবুজ শ্যামলিমার আচঁড়ের উপর সন্ধ্যের মরা আলো মাঠজুড়ে। কোথাও কেউ নেই। নিস্তব্ধ শূন্যতা। দূর থেকে ভেসে আসছে ঝিঁ ঝিঁর ডাক। ভয়ে আঁতকে ওঠে তুলি আর অন্তু। গ্রামের এই মেঠোপথ তাদের কাছে সম্পূর্ণ নতুন। দাদুভাই! দাদুভাই! করে চেচাঁমেচি করতে থাকে। অন্তু কান্নায় একাকার। তুলি আমতা আমতা করে অন্তুকে শান্ত হতে বলে। এক পর্যায়ে সে নিজেও কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। অচেনা সব গাছগাছালির মাঝে হঠাৎ তাদের চোখে পড়ে একটা খেজুর গাছ। তা থেকে নামছে এক খেজুরিয়া। তুলির  মনটা অকাস্মাৎ নেচে উঠল। সাহস পেল সে। খেজুরিয়া বলে সজোরে হাঁক দিল। কিন্তু কাছে গিয়ে দেখে এ তাদের সেই পরিচিত খেজুরিয়া নয়, যাকে সে ডাক দিয়েছে। কি করবে? কাচঁমাচু করে তারা সেই খেজুরিয়ার সামনে গিয়ে দাড়াঁয়। গ্রামের খেজুরিয়া এই ভর সন্ধ্যেয় তাদের দুজনকে দেখে তো অবাক। ব্যাপার কী? বেশভূষায় বুঝতে পারে এই দুই ছোট্ট খোকা খুকী শহর থেকে আসা। তোমরা কই যাও? খেজুরিয়ার প্রশ্ন। দাদুবাড়ি। তুলিরা বলে। দাদু বাড়ি কই? সে প্রশ্নের আর উত্তর দিতে পারে না তারা। চুপচাপ দাড়িঁয়ে থাকে। শেষে খেজুরিয়া বলল, চল তোমরা। আমার বাড়ি চল।

এদিকে তুলির দাদুভাই তো হয়রান। তন্ন তন্ন করে খুজে বেড়িয়েছে। কোথাও পেল না। তুলি আর অন্তুকে।

খেজুর গাছে ঘেরা ছোট্ট একটা বাড়ি। খেজুরিয়ারা সব এখানে এক পাড়ায় থাকে। তুলি আর অন্তুকে দেখে তাদের বয়সী অনেক ছেলেমেয়েরা এসে ভীড় জমিয়েছে। খেজুরিয়ার উঠোনে। বাড়ির পেছনে খেজুর গাছের উপরে দেখা যাচ্ছে বাঁকা চাঁদ। তুলি আর অন্তুকে দেখতে আসে পাড়ার অনেকে। এদের মধ্যেই দেখা যায় তুলিদের সেই খেজুরিয়া। পুরো ঘটনা শুনে ঐ খেজুরিয়া তুলি ও অন্তুকে তার ঘরে নিয়ে যায়। খেজুরের গুড় দেয় খেতে ওদের। সঙ্গে মুড়ি ভাজা। তুলি ও অন্তু দেখে নতুন এক জগত। মাটির ঘর। বড় বড় খেজুর রসের কলস। ঘরময় খেজুরের ঘ্রান। দেয়ালে লাগানো বাশের সঙ্গে ঝুলছে ছেড়া কাথা কম্বল। খেজুরিয়াটা শুদ্ধ বাংলা ভাষায় কথা বলতে না পারায় তুলি ও অন্তুর সঙ্গে কিছু বলতে পারে না। কিন্তু খেজুরিয়ার অকৃত্রিম  আদর যত্নে ওরা বুঝতে পারে।

পরদিন ঠান্ডায় নিথর ভোরে ঘুম থেকে জেগে ওঠে তুলি ও অন্তু। খেজুরিয়ার বউ গরম পানি দেয় ওদেরকে হাত মুখ ধুতে।

কুয়াশায় কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। খুব যত্ন করে খেজুরিয়া ওদের নিয়ে দাদুবাড়ির দিকে এগোয়। ওদের খেজুর গাছের পাশে এসে খেজুরিয়া ওদেরকে নিচে দাঁড় করিয়ে গাছে ওঠে। রসের হাড়ি নামায় গাছ থেকে। তারপর সেই হাড়ি তুলে দেয় ওদের হাতে। তুলি ও অন্তু দাদুবাড়ির দরজায় গিয়ে কড়া নাড়ে। দাদু বের হয়ে ওদের দেখে তো অবাক। তুলি বলে, ‘কী দেখছো দাদুভাই? আমরা রস আনতে গিয়েছিলাম খেজুরিয়ার বাড়িতে। এই নাও রসের হাড়ি। ’

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।