ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

ইসলাম

কোরআনে কারিমের দশটি অধিকার

আতাউর রহমান খসরু, অতিথি লেখক, ইসলাম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৫০ ঘণ্টা, জুন ১১, ২০১৫
কোরআনে কারিমের দশটি অধিকার ছবি: সংগৃহীত

আল্লাহতায়ালা মানবজাতির প্রতি অনুগ্রহস্বরূপ এবং সত্যপথের দিশা হিসেবে কোরআন দান করেছেন। এ প্রসঙ্গে কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, "হে মানবজাতি! তোমাদের নিকট এসেছে তোমাদের প্রভুর পক্ষ থেকে উপদেশ।

যা আরোগ্য অন্তরের ব্যাধির জন্য এবং পথনির্দেশ ও অনুগ্রহ মুমিনের জন্য। " -সূরা ইউনুস : ৫৭

কোরআনের কারিমের কল্যাণ সাধারণভাবে সবার জন্য উন্মুক্ত। তবে কল্যাণ অর্জন করতে হলে তাকে নূন্যতম কিছু শর্তপূরণ করতে হবে। তবে প্রথম শর্ত হলো, কোরআন পাঠকের হৃদয় হতে হবে নিষ্কলুষ ও কল্যাণকামী; সত্যগ্রহণে সদা প্রস্তুত। তার চেয়ে বড় কথা হলো, কোরআন তার অফুরন্ত কল্যাণের দুয়ার পাঠকের জন্য ততক্ষণ পর্যন্ত খুলে দেন না, যতক্ষণ না সে কোরআনকে তার প্রাপ্য অধিকার ও মর্যাদা প্রদান করে। বরং কেউ যদি অন্তরের বক্রতা নিয়ে তা পাঠ করে, তবে তার পথভ্রষ্ট হওয়ার সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে তোলে। এ জন্য বলা হয়েছে, "অস্বীকারকারীগণ বলে, আল্লাহতায়ালা এই উপমা দ্বারা কী উদ্দেশ্য নিয়েছেন। আল্লাহ এর মাধ্যমে বহু মানুষকে পথভ্রষ্ট করেন এবং বহু মানুষকে পথ দেখান। আর তিনি পথভ্রষ্ট করেন না পাপী ব্যতীত। " -সূরা বাকারা : ২৬

সুতরাং কোরআন তেলাওয়াতের পূর্বে আমাদের হৃদয়কে প্রস্তুত করতে হবে। বিশেষত তার মর্যাদা ও অধিকারের প্রতি সচেতন হতে হবে। এখানে কোরআন ও হাদিসের আলোকে পবিত্র কোরআনে কারিমের ১০টি অধিকারের কথা তুলে উল্লেখ করা হলো-

১. কোরআনের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা : কোরআনের প্রতি পাঠকের বিশ্বাস পরিশুদ্ধ না হলে পাঠক কোনোক্রমেই কোরআন দ্বারা যথাযথ উপকার লাভ করতে পারবে না। এ প্রসঙ্গে কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, "হে মুমিনগণ! তোমরা বিশ্বাস স্থাপন কর, আল্লাহর প্রতি, তার রাসূলের প্রতি এবং যে গ্রন্থ তার রাসূলের ওপর অবতীর্ণ হয়েছে তার প্রতি। এবং যা অবতীর্ণ হয়েছে পূর্ববর্তীদের প্রতি। " -সূরা  নিসা : ১৩৭

২. শুদ্ধভাবে কোরআন পড়তে শেখা : কোরআন তেলাওয়াত শুদ্ধ করা মুমিনের জন্য ফরজ। কেননা বিশুদ্ধ কোরআন তেলওয়াত ব্যতীত নামাজ শুদ্ধ হয় না। মুমিন বান্দার প্রতি কোরআনের অধিকার হলো, কোরআনে কারিম বিশুদ্ধভাবে তেলওয়াত করা। কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘তুমি কোরআনকে তারতিলের সঙ্গে অর্থাৎ ধীরস্থীরভাবে তেলাওয়াত কর। ’ -সূরা মুজ্জাম্মিল : ৪

পরিভাষায় তারতিল বলা হয় কোরআন যথাযথ নিয়ম রক্ষা করে পাঠ করাকে। হজরত রাসূলল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে কোরআন সুন্দর উচ্চারণে পড়ে না, সে আমার উম্মতের মধ্যে শামিল নয়। ’ -সহিহ বোখারি : ৭৫২৭

৩. আমল করা : কোরআন হলো মানবজাতির জীবনসমস্যার সমাধানে আল্লাহপ্রদত্ত ব্যবস্থাপত্র। সুতরাং কোরআনের প্রকৃত কল্যাণ লাভ করতে হলে তার আদেশ, নিষেধ ও বিধি-বিধান মান্য করে চলতে হবে। উপাদেয় খাবারের ঘ্রাণ নেয়ার মতো যদি শুধু তার তেলাওয়াতকেই যথেষ্ট মনে করা হয়, তবে কোরআনের প্রকৃত স্বাদ ও কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হতে হবে। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের প্রতি তোমাদের রবের পক্ষ থেকে যা নাজিল করা হয়েছে, তা অনুসরণ কর এবং তাকে ছাড়া অন্য অভিভাবকদের অনুসরণ কর না। তোমরা সামান্যই উপদেশ গ্রহণ কর। ’ -সূরা আরাফ : ৩

৪. শেখা এবং শেখানো : মুমিনের প্রতি কোরআনের অধিকার হলো, সে নিজে কোরআন শিক্ষা করবে এবং অন্যকেও শিক্ষা দিবে। বিশেষত সন্তান-সন্তুতিকে কোরআন শেখানো, পরিবারে কোরআনের চর্চা করা মুমিনের দায়িত্ব। মূলত এর মাধ্যমেই পবিত্র কোরআনের সংরক্ষণ ও চর্চা কেয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম সে ব্যক্তি যে নিজে কোরআন শিখে এবং অন্যকে শেখায়। ’ -সহিহ বোখারি : ৫০২৭

৫. অধিক পরিমাণ তেলাওয়াত করা : এক হাদিসে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) কোরআন তেলাওয়াতকে সর্বোত্তম ইবাদত আখ্যা দিয়েছেন। অন্য হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা কোরআন তেলাওয়াত কর, কেননা কেয়ামতের দিন তা আপনবাহকের জন্য সুপারিশকারী হবে। ’ -সহিহ মুসলিম : ১৯১০

অর্থ ও মর্ম বুঝে কোরআন তেলাওয়াত করা ঈমানের দাবী ও ইসলামের শিক্ষা। তবে অর্থ ও মর্ম না বুঝে তেলাওয়াত করলেও সওয়াব হবে।

৬. অনুধাবন ও উপলব্ধির চেষ্টা করা : পবিত্র কোরআন জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্তহীন উৎস। আল্লাহতায়ালা কোরআন অনুধাবনে গভীর মনোযোগ প্রদানের নির্দেশ দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘তবে কি তারা কোরআন নিয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনা করে না? নাকি তাদের অন্তরসমূহে তালা রয়েছে। ’ -সূরা মুহাম্মদ : ২৪

৭. কোরআনের প্রচার ও প্রসার : কোরআনের শিক্ষা ও কোরআনি শিক্ষার প্রচার ও প্রসারে কাজ করা কোরআনের অন্যতম অধিকার। যারা কোরআনের প্রচারে কাজ করবে আল্লাহতায়ালা তাদেরকে দুনিয়া ও আখেরাতে সম্মানিত করবেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে রাসূল! আপনি পৌঁছে দিন আপনার নিকট যা অবতীর্ণ হয়েছে। ’ -সূরা মায়েদা : ৬৭

হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বিদায় হজের ভাষণে বলেছেন, ‘আমার পক্ষ থেকে একটি আয়াত হলেও পৌঁছে দাও। ’ -সহিহ বোখারি : ৩৪৬১

৮. কোরআন হিফজ করা : আল্লাহতায়ালা নিজে কোরআন সংরক্ষণের দায়িত্বগ্রহণ করেছেন। কোরআন সংরক্ষণের একটি দিক হলো তা মানুষের অন্তরে অবিকৃত অবস্থায় সংরক্ষণ করা। যারা কোরআন হিফজ করলো, তারা মূলত কোরআন সংরক্ষণে আল্লাহর মহান মিশনে অংশগ্রহণ করলো। হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘কোরআনের হাফেজকে বলা হবে কোরআন পড়ে যাও, আর ওপরে উঠতে থাক। ধীর-স্থিরভাবে তারতিলের সঙ্গে পাঠ কর, যেমন দুনিয়াতে তারতিলের সঙ্গে পাঠ করতে। কেননা জান্নাতে তোমার অবস্থান সেখানেই হবে, যেখানে তোমার আয়াত পড়া শেষ হয়। ’ -সুনানে তিরমিজি : ২৯১৪

৯. কোরআনের প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশ : কোরআন আল্লাহতায়ালার অমূল্য দান। এ দানে আল্লাহতায়ালা উম্মতে মুহাম্মাদিকে ধন্য করেছেন। সুতরাং মানুষের দায়িত্ব হলো, তা পাঠ, অনুধাবন ও অনুসরণের মাধ্যমে সন্তুষ্টি ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। ইরশাদ হয়েছে, ‘বলুন! এটা আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া। সুতরাং তারা যেনো এ ব্যাপারে সন্তুষ্ট হয়। এটা তাদের জন্য উত্তম যা তারা জমা করে তা থেকে। ’ -সূরা ইউনুস : ৫৮

হজরত আবু সাঈদ (রা.) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘অনুগ্রহ’ হলো কোরআন এবং ‘দয়া’ হলো তার ধারক ও বাহক হওয়ার সুযোগ দান। ’ সুতরাং কোরআনের যতটুকু শিক্ষা আল্লাহতায়ালা আমাদের দান করেছেন সে ব্যাপারে অবশ্যই সন্তুষ্ট হতে হবে।

১০. কোরআনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা : কোরআনকে যথাযথ সম্মান প্রদান করা মুমিনের দায়িত্ব ও কর্তব্য। আর কোরআনের সম্মান দানের ৩টি দিক রয়েছে। সেগুলো হলো-

ক. পবিত্র হয়ে কোরআন স্পর্শ করা : মুসলমানের জন্য অপবিত্র অবস্থায় কোরআন স্পর্শ করা বৈধ নয়।
 
খ. যথাযথ সম্মান দেয়া : কোরআনকে যথাযথ সম্মান প্রদান করা। সম্মান প্রদানের অর্থ হলো, কোরআন, কোরআনের সূরা ও আয়াতসমূহ, কোরআনের ব্যাখ্যাগ্রন্থ, এক কথায় কোরআন সংশ্লিষ্ট গ্রন্থাবলীকে এমন স্থানে না রাখা যাতে অসম্মান হয়। সেই সঙ্গে কোরআনের বিধি-বিধানকে উপেক্ষা না করা, কোরআনের ধারক ও বাহকদের সম্মান প্রদান করা ইত্যাদি।

গ. অবজ্ঞা ও উপহাস না করা : কোরআন, কোরআনের বিধি-বিধান ও বর্ণনাসমূহের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন এবং তা নিয়ে উপহাস করা ঈমানবিধ্বংসী কাজ। আল্লাহতায়ালা কোরআন নিয়ে উপহাস করতে নিষেধ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহর আয়াতসমূহকে উপহাসের পাত্র হিসেবে গ্রহণ করো না। ’ -সূরা বাকারা : ২৩১

হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভী (রহ.) পবিত্র কোরআনের অধিকার আলোচনায় ৩টি অধিকারের কথা বলেছেন। সেগুলো হলো-

এক. বিশুদ্ধভাবে কোরআন তেলাওয়াত করা,
দুই. কোরআনের অর্থ ও মর্ম অনুধাবন করা ও
তিন. জীবনের সর্বস্তরে কোরআনের অনুসরণ করা।

বাংলাদেশ সময়: ১২৫০ ঘন্টা, জুন ১১, ২০১৫
এমএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।