ঢাকা, শনিবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

ইসলাম

বজ্রপাত, পরিবেশ বিপর্যয় ও ইসলাম

মুফতি এনায়েতুল্লাহ, বিভাগীয় সম্পাদক, ইসলাম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯২০ ঘণ্টা, মার্চ ৩১, ২০১৫
বজ্রপাত, পরিবেশ বিপর্যয় ও ইসলাম

গতকাল সোমবার (৩০ মার্চ) দেশের কয়েকটি জেলায় বৃষ্টিপাতের সঙ্গে বজ্রপাতের ঘটনা ঘটেছে। এতে ৩ জেলায় ব্রজপাতের শিকার হয়ে নিহত হয়েছেন শিশুসহ অন্তত ৭ জন।

আহত হয়েছেন বেশ কয়েকজন। প্রতিবছরই বজ্রপাতে হতাহতের কথা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। গত বছরের ২৩ মে শুধু একদিনে সারাদেশে বজ্রপাতে নিহত হয়েছিল ৪০ জন। এর আগে ২০১২ সালে সুনাগঞ্জের দুর্গম হাওর এলাকা ধর্মপাশার সরস্বতীপুর গ্রামে তারাবির নামাজ পড়ার সময় বজ্রপাতে নিহত হয় ১৩ জন। এভাবে বজ্রপাতে একসঙ্গে মারা যাওয়ার ঘটনা বাংলাদেশে এটাই প্রথম। এবারও ঝড়ো মওসুম শুরুর আগেই একদিনে ৭ জনের মৃত্যুর ঘটনা সাধারণ মানুষের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে তুলেছে। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, গাছপালা কমে যাওয়ার কারণে মূলত এমনটি হচ্ছে।

বজ্রপাত নিয়ে নানা ধরনের ধর্মীয় ও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা রয়েছে। আমরা সেদিকে যেতে চাই না। আমরা মনে করি এটা একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এটা যে কোনো সময় ঘটতে পারে, এই অমোঘ সত্যবাণী অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। তবে, আবহওয়াবিদরা বলেন, বেশি গাছপালা থাকলে বজ্র গাছের মধ্যে পড়লে জানমালে ক্ষতি কম হতো। বিষয়টি যে পরিবেশ বিপর্যয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আমরা পরিবেশের প্রতি যত্নবান হলে নিশ্চয়ই পরিবেশ আমাদের সঙ্গে এমন বিরূপ আচরণ করত না। আশা করি সমূহ বিপদ থেকে রক্ষা পেতে আমরা পরিবেশের প্রতি যত্নবান হবো।

বস্তুত প্রকৃতি, পরিবেশ, প্রকৃতির উপকরণ ইত্যাদি আল্লাহতায়ালার কুদরতের নিদর্শন। পৃথিবীতে কোনো কিছু অনর্থক সৃষ্টি করা হয়নি। সবকিছু মানুষ এবং অন্যান্য সৃষ্টির কল্যাণে সৃষ্টি করা হয়েছে। দুনিয়ায় সবকিছু পরিমিতভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে। প্রাকৃতিক পরিবেশ মানুষের জন্য অপূর্ব নিয়ামত। এই পরিবেশ ধ্বংস করার কোনো ক্ষমতা মানুষকে দেওয়া হয়নি। মানুষ প্রকৃতির কোনো উপাদান বিনষ্ট করতে পারবে না। এর ধ্বংস বা অযৌক্তিক ব্যবহার করতে পারবে না। প্রকৃতিতে বিচ্যুতি ঘটানো অথবা পরিবর্তন আনা যাবে না।

প্রাকৃতিক পরিবেশ বিষয়ে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত ইতিবাচক। ইসলামী জীবনদর্শনে প্রকৃতি, পরিবেশ, প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের আচরণ, পরিবেশ সংরক্ষণ ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে করণীয় সম্পর্কে যা বলা হয়েছে তার ব্যাপক আলোচনা প্রয়োজন। নিঃসন্দেহে সমকালীন প্রেক্ষাপটে নানা ধরনের পরিবেশ বিপর্যয় ও দূষণ একটি সমস্যাও বটে। পরিবেশ সংরক্ষণে ইসলামের শিক্ষা ও মূল্যবোধই পরিবেশ বিপর্যয় রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম।

গাছপালা, ফলমূল, নদীনালা, পাহাড়-পর্বত, পশুপাখি ও নানা ধরনের খাদ্যশস্য আল্লাহতায়ালার অন্যতম নিয়ামত। আরও লক্ষ্য করলে দেখা যায়, চন্দ্র-সূর্যের আবর্তন, বাতাস, বৃষ্টি, মেঘ-ছায়া রৌদ্র ও নদীর পানি ইত্যাদি নিদর্শন জ্ঞানীদের চিন্তার খোরাক জোগায়। দুনিয়ায় আল্লাহর এত নিয়ামত রয়েছে, যা হিসাব করে শেষ করা যাবে না। এ বিষয়ে কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ গণনা করলে তার সংখ্যা নির্ণয় করতে পারবে না। ’ -সূরা ইবরাহিম : ৩৯

কোরআনে আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘অতএব, তোমরা উভয়ে তোমাদের প্রতিপালকের কোন কোন নিয়ামত অস্বীকার করবে?’ -আর রাহমান : ১৩

মানবজাতি এ কারণে অনেক সৌভাগ্যবান যে, দুনিয়ার সব প্রাকৃতিক সম্পদ ও পরিবেশ ভোগ-ব্যবহার করার এখতিয়ার তাদের দেওয়া হয়েছে। আল্লাহতায়ালা মানবজাতি ও অন্যান্য সৃষ্টির কল্যাণে সবকিছু সৃষ্টি করেছেন। প্রকৃতির সব সম্পদ ও উপকরণ সঙ্গত ব্যবহারের অধিকার দিয়েছেন। আল্লাহতায়ালা কোনো কিছু অনর্থক সৃষ্টি করেননি। কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী এবং তাদের মধ্যে কোনো কিছুই অনর্থক সৃষ্টি করিনি। ’ -সূরা আদ দোখান : ৩৮

আল্লাহতায়ালা মানুষ, প্রাণী, উদ্ভিদ, পশুপাখি, জীবজন্তু, গাছপালা, পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা, খাল-বিল সৃষ্টি করে প্রকৃতিতে এক শৃঙ্খলাময় ব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন। এই ব্যবস্থাপনার কোনো একটি উপকরণের কোনোরূপ ক্ষতি, বিনাশ, ধ্বংস, অপচয় হলে প্রকৃতির এই ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি দেখা দেয়; পরিবেশে সংকট সৃষ্টি হয়।

মনে রাখতে হবে- প্রকৃতিতে সব প্রাণী, জীব ও উদ্ভিদের বসবাস করার অধিকার রয়েছে এবং এ অধিকার আল্লাহ প্রদত্ত। পরিবেশের কোনোরূপ ক্ষতি করা হলে অর্থাৎ বন-জঙ্গল উজাড় করা, পাহাড় কাটা, নদী-নালা ভরাট করা ও বাঁধ দেওয়া ইত্যাদি জাতীয় কাজের দ্বারা প্রকৃতিতে বসবাসকারী মানুষসহ অন্যান্য জীব, প্রাণী ও উদ্ভিদের বসবাসের ক্ষেত্রে অসুবিধা সৃষ্টি করা হয়। সৃষ্টির স্বাভাবিক গতি ব্যাহত হয়। ইসলামী শরিয়তে এসব কাজ কঠিন অন্যায় ও মারাত্মক অপরাধ বলে বিবেচিত। তাই এসব কাজ থেকে মানুষকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে। না হলে পরিবেশ আমাদের সঙ্গে এমন বৈরী আচরণ করতেই থাকবে; আর এটাই স্বাভাবিক। অন্যভাবে বলা যায়, এটা আমাদের পাওনাও বটে, যা আমরা নিজ হাতে কামাই করেছি।

এ কথা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই, প্রকৃতির সব উপাদান ও সম্পদ, বন-জঙ্গল, নদীনালা ও খালবিল, মরুভূমি ও পাহাড়-পর্বত এমনভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে- যা কিনা প্রকৃতিতে একটি চমৎকার ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থার সৃষ্টি করেছে। মানুষ ও অন্যান্য সৃষ্টির জন্য এরূপ সুষম ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থা প্রয়োজনীয়। আল্লাহতায়ালা প্রতিটি জিনিসের গুণগত মান ও পরিমাণ এমনভাবে নির্ধারণ করেছেন, যা তাদের স্বাচ্ছন্দ্যময় বসবাসের জন্য উপযুক্ত। আল্লাহ প্রদত্ত এই সুন্দর ব্যবস্থাপনায় মানুষের লোভাতুর দৃষ্টিভঙ্গিই বর্তমান পরিবেশ বিপর্যয়ের জন্য দায়ী।

তাই সব ধরনের প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণ, যুক্তিপূর্ণ ভোগ-ব্যবহার, বিজ্ঞানভিত্তিক উন্নয়ন ও উৎপাদন আবশ্যক। কোনো অবস্থায় প্রাকৃতিক পরিবেশের ধ্বংস বা বিনাশ করা যাবে না, এমনকি অপচয়ও করা সমীচীন হবে না। পর্যাপ্ত এই প্রাকৃতিক পরিবেশের অনৈতিক ও বেআইনি ব্যবহার হ্রাস করতে হবে। ক্ষতিকর নানা উপাদান থেকে বায়ু ও পানি দূষণমুক্ত রাখতে হবে। কোনোভাবেই প্রকৃতিতে পরিবর্তন বা বিচ্যুতি ঘটানো যাবে না। প্রকৃতি, প্রাকৃতিক সম্পদ আল্লাহর অপূর্ব নিয়ামত। এসব নিয়ামতের সম্পূর্ণ সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। তবেই এসব প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাওয়া সহজ হবে। আল্লাহতায়ালা আমাদের সবাইকে সব ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা করুন। আমীন।

** ৩ জেলায় বজ্রপাতে নিহত ৭

বাংলাদেশ সময়: ১৯২০ ঘন্টা, মার্চ ৩১, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।