ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১০ অক্টোবর ২০২৪, ০৬ রবিউস সানি ১৪৪৬

ইসলাম

জীর্ণ দশায় দশ টাকার আতিয়া মসজিদ

সৈয়দ ইফতেখার আলম, নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৩৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ২২, ২০১৪
জীর্ণ দশায় দশ টাকার আতিয়া মসজিদ ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

টাঙ্গাইল থেকে ফিরে: টাঙ্গাইল জেলা শহর থেকে ৭/৮ কিলোমিটার দূরে দেলদুয়ার উপজেলা। এ উপজেলার দক্ষিণে আরো ৫ কি ৭ কিলোমিটার রিকশা বা ভ্যানের পথ পেরিয়ে আতিয়া গ্রাম।

গ্রামে রয়েছে লৌহজং নদী। আর ছোট্ট এই নদীর পূর্ব পাড়ে অবস্থিত বাংলাদেশের মুসলিম ঐতিহ্যের প্রাচীন একটি নিদর্শন। নাম তার আতিয়া জামে মসজিদ। যা স্থানীয়দের ভাষায় ‘আটিয়া মসজিদ’ নামে পরিচিত।

লুৎফর রহমান সরকার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর থাকাকালীন ১৯৯৬-১৯৯৭ সালে মুদ্রিত দশ টাকার নোটে স্থান পায় এই বিখ্যাত মসজিদের ছবি। স্থানীয়রা একে দশ টাকার নোটের ‘আটিয়া’ (আতিয়া) মসজিদও বলে থাকেন। নানা কারণে ঐতিহাসিক ও বাঙালি মুসলমান সমাজের প্রচীন পুরাকীর্তি সংযুক্ত সৃষ্টিকর্মের ধারক-বাহক এই মসজিদটি যত না বিখ্যাত, বর্তমানে এর অবস্থা ঠিক ততটাই জীর্ণ!

মসজিদের বাইরের প্রাচীরের দুই পাশে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে পোস্টার সংবলিত দড়ি। সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, একটি স্থানীয় ওয়াজ মাহফিলের প্রচারণা চালানো হয়েছে বিখ্যাত আতিয়া মসজিদের ভেতরে দড়িতে পোস্টার লাগিয়ে।

আর এ বিষটি যেন দেখার কেউ নেই।

স্থানীয় কয়েক জনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এরকম বিভিন্ন পোস্টার মাঝে মধ্যেই লাগানো হয়। কখনো মসজিদের ভেতরে রশি বেঁধে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়, নয়তো, একদম দেওয়ালেই সেঁটে দেওয়া হয়! এ নিয়ে কেউই কিছু বলেন না। যে যার ইচ্ছে মতো এ কাজ করেন।

১৯৬৮ সালের পুরাকীর্তি সংরক্ষণ আইনের আওতায় এই ঐতিহ্যবাহী মসজিদটি সংরক্ষিত। আর এ আইনেরই চতুর্দশ ধারার অধীনে বলা হয়েছে, প্রাচীন ঐতিহ্য কেউ বিনষ্ট করতে পারবে না। এর ব্যাতয় ঘটলে এক বছরের জেল সঙ্গে জরিমানাও ভোগ করতে হবে।

কিন্তু এখানে কে শোনে কার কথা! নেমপ্লেটে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা দিয়ে এর কোনো একটি অংশে আচড় কাটলেও আইনানুগ শাস্তি পেতে হবে এমন কথা বলা থাকলেও, বাস্তব চিত্র একেবারেই ভিন্ন।

এদিকে, আড়াই কি তিন ফুটের প্রাচীর দিয়ে প্রাচীন এ মসজিদটির নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। যা টপকে হর-হামেশা কুকুর, বিড়ালসহ নানা প্রাণী তো যাচ্ছেই, রয়েছে মানুষেরও অবাধ যাতায়াত। আর এতে ন্যুনতম নিরাপত্তা বলয় নেই সুবিখ্যাত এ মসজিদে।

মসজিদের গেটে নেই কোনো নিরাপত্তাকর্মী বা বিশেষ ব্যবস্থা। ফলে এই ঐতিহাসিক পুরাকীর্তি আগামীতে কেবল ইতিহাসেই পাতাতেই রয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন স্থানীয় সচেতন বাসিন্দারা।

ইতোমধ্যে নষ্ট হয়ে গেছে, দেওয়ালের ওপরের যে চিত্রফলক ছিল সেগুলোর বেশিরভাগ অংশ। জনসাধারণের অবাধ যাতায়াতে থাকছে না মসজিদর পবিত্রতাও। আর দূর-দূরান্ত থেকে ভ্রমণে আসা জনসাধারণও পাচ্ছেন না কাঙ্ক্ষিত ভ্রমণানন্দ।

শুধু তাই-ই নয় কেন এবং কিজন্য এ মসজিদ বিখ্যাত, নির্মাণ হয়েছে কোন আমলে কেই বা নির্মাণ করছেন সে বিষয়ে বিস্তারিত দিকনির্দেশনা পর্যন্ত নেই! শুধু ইংরেজিতে পাওয়া গেলো সাঈদ খান পন্নীর নাম।

এছাড়াও, মসজিদের মেঝেতে গজিয়েছে ঘাস, দেওয়ালের রঙ চলটে উঠে নষ্ট হচ্ছে পোড়ামাটির ঐতিহ্য। চলছে চলুক মনভাব নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন মসজিদ কর্তৃপক্ষও। নামাজ অনুষ্ঠিত হলেও তাদের কাছে এটি শুধুই একটি মসজিদ, ইতিহাস কিংবা ঐতিহ্যের অংশ নয়!

বিষয়টি নিয়ে কথা হলো উপজেলা দেলদুয়ার থেকে ঘুরতে আসা রফিক উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, প্রায়ই বিকেলে আবসরে এখানে আসি ঘুরতে। আমি ব্যবসায়ী মানুষ আমার দিনক্ষণ নেই, তবে ছুটির দিন আমার মতো অসংখ্য দর্শনার্থী এখানে আসেন। আতিয়া মসজিদের সংরক্ষণ ব্যবস্থার ঘাটতি ও কর্তৃপক্ষের অসহযোগিতামূলক আচরণে এখানে ভ্রমণে আসাটাই বৃথা হয়ে যায়।

তিনি বলেন, অযত্ন, অবহেলায় এ মসজিদ এখন এক জরাজীর্ণ। যে যার মতো দেওয়াল লিখন, পোড়ামাটির দেওয়ালে কাটা-ছেঁড়া করাসহ অবাধ ঘোরাঘুরি, ছবি তোলাসহ নানা কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। যা একটি সিস্টেমের মধ্যে আনতে হবে। না হলে যতই দিন যাবে এই রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও প্রাচীন ঐতিহ্য শুধু ধ্বংস হতেই থাকবে।

রফিক উদ্দিন বাংলানিউজকে আরো বলেন, প্রতিটি প্রাচীন ঐতিহ্যের একটি ইতিহাস থাকে। এসব ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত অংশ ঐতিহ্যবাহী নিদর্শনগুলোর বাইরে ফলক আকারে দেওয়া থাকে। কিন্তু এই বাংলার মুসলিম ইতিহাসের অন্যতম প্রাচীন নিদর্শন, পুরাকীর্তি আতিয়া মসজিদের ভেতরে, বাইরে তেমন কোনো সংক্ষিপ্ত ইতিহাস বা দিকনির্দেশনার উল্লেখ নেই। যা সত্যিই হতাশার। বাংলা ভাষায় জনসাধারণের জন্য এই মসজিদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস সংযুক্ত করা দরকার।

আর এতো সব অব্যবস্থাপনা থাকলে ভ্রমণ পিয়াসী মানুষ এখানে কেনই বা আসবেন এ নিয়ে রয়েছে হাজারটা প্রশ্ন।

এবিষয়ে, কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মেজবাহ কামালের সঙ্গে। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, এ ধরনের বিখ্যাত পুরাকীর্তি সংরক্ষণে জাতীয় পর্যায়ের কমিটি গঠন করা দরকার। না হলে দিন যেতে থাকবে, এগুলোর আর সংরক্ষণ বলে কিছুই হবে না। ধীরে ধীরে শুধু নষ্টই হতে থাকবে।

তিনি আরো বলেন, আমাদের একটি নির্দিষ্ট অধিদফতর রয়েছে এই বিখ্যাত পুরাকীর্তিগুলো সংরক্ষণে। কিন্তু বাস্তবে তাদের কোনোই কাজ নেই। তারা একেবারেই ইতিহাস সচেতন নয়। আর তাই তো তারা সব জেনে শুনে ঘুমিয়ে।

অধ্যাপক মেজবাহ কামাল বলেন, আমাদের সবার জাতীয় দায়িত্ব এই নিদর্শনগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করা। আর এ জন্য যদি জাতীয় পর্যায়ের একটি কমিটি করা হয় তা হলে তারা সমস্যা নির্ণয় করে, সংশ্লিষ্ট অধিদফতরকে চাপ প্রয়োগ করতে পারবেন। এতে করে বর্তমানে যে পরিস্থিতি- অযত্ন, অবহেলার সংমিশ্রণ তা অন্তত দূর হবে।

মধ্য যুগের মুসলমান সমাজের ইতিহাস ঐতিহ্যে আতিয়া জামে মসজিদের একটি বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, মধ্য যুগের ইসলাম সেইসঙ্গে ঢাকা এবং তার আশপাশের এলাকার এ প্রচীন নিদর্শনের গুরুত্ব প্রচুর। সুষ্ঠু ইতিহাসের চর্চায় এই বিখ্যাত মসজিদটি প্রয়োজন মতো সংস্কার ও নিরাপত্তার দাবি জানাচ্ছি।

লাল ইটে তৈরি এ মসজিদে রয়েছে অত্যন্ত চমৎকার স্থাপত্যশৈলীর ছাপ। আতিয়া মসজিদটি বর্গাকৃতির গম্বুজবিশিষ্ট। এর পূর্ব দিকে অপেক্ষাকৃত ছোট তিন গম্বুজবিশিষ্ট আয়তাকার বারান্দা আর সে বারান্দা থেকে মসজিদে প্রবেশ করার জন্য রয়েছে ৩টি দরজা। নামাজ কক্ষে সর্বোচ্চ ছয় কাতার মুসল্লি এক সঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারেন।

মসজিদের কেবলা দেয়ালে রয়েছে ৩টি অলঙ্কৃত মেহরাব। আতিয়া মসজিদের পূর্ব ও উত্তর দেয়ালে রয়েছে চমৎকার সব পোড়ামাটির নকশা। যা পঞ্চদশ শতকের।

মুসলিম স্থাপত্যের ঐতিহ্য আর কালের সাক্ষী হয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে যে মসজিদগুলো রয়েছে তারই মধ্যে অন্যতম ষোড়শ শতাব্দীতে নির্মিত আতিয়া মসজিদ।

এই মসজিদের পূর্ব আঙ্গিনার মধ্যে একটি পাকা কবর আছে এবং কবরের পাশে একটি পাকা করা সুড়ঙ্গ পথও রয়েছে। যার স্থানীয় নাম ‘আন্ধার মানিক’। এ সুড়ঙ্গ পথটি বর্তমানে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। মসজিদ এলাকায় প্রবেশের আগেই রয়েছে ঢেউ খেলানো স্বচ্ছ পানির বড় একটি পুকুর।

বেশ কয়েকটি শিলালিপি থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে বোঝা যায়, খুব সম্ভবত ১৬০৮-১৬১১ শতকের মাঝামাঝি কোনো এক সময় আতিয়া মসজিদটি নির্মিত হয়েছে।

আরবি ‘আতা’ থেকে ‘আতিয়া’ শব্দের উদ্ভব। যার অর্থ ‘দান করা’। আলী শাহান শাহর বাবা আদম কাশ্মিরী (র.) কে সুলতান আলাউদ্দিন হুসায়েন শাহ টাঙ্গাইল জেলার জায়গিরদার নিয়োগ দিলে এ অঞ্চলে তিনি থাকতে শুরু করেন। সে সময় ইসলাম ধর্ম প্রচারের এবং আনুষঙ্গিক ব্যয় নির্বাহের জন্য আফগান শাসক সোলাইমান কররানীর কাছ থেকে সংলগ্ন এলাকা দান বা ওয়াকফ হিসেবে লাভ করেন। সেই থেকেই এ অঞ্চলটির নাম আতিয়া হয়ে থাকতে পারে বলে ধারণা করেন ইতিহাসবিদরা।

পরবর্তীতে বাবা আদম কাশ্মিরীর পরামর্শক্রমে সাঈদ খান পন্নী নামক সূফিজীর এক ভক্তকে মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীর আতিয়া পরগণার শাসন কর্তা হিসেবে নিয়োগ দেন। এই সাঈদ খান পন্নীই ১৬০৮ সালে বাবা আদম কাশ্মিরীর কবরের সন্নিকটে আতিয়া মসজিদ নির্মাণ করেন।

মুহাম্মদ খাঁ নামক তৎকালিন এক প্রখ্যাত স্থপতি এই মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনা ও নির্মাণ কাজে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। এছাড়া, রওশন খাতুন চৌধুরাণী ১৮৩৭ সালে এবং আবুল আহমেদ খান গজনবী ১৯০৯ সালে মসজিদটির সংস্কার করেন।

লাল ইটের তৈরি এ মসজিদটি আকারে বেশ ছোট এবং এতে সুলতানি ও মুঘল, এই দুই আমলেরই স্থাপত্যরীতির সুস্পষ্ট ছাপ রয়েছে। এটি দৈর্ঘ্যে মাত্র ১৮ দশমিক ২৯ মিটার (৫৯ ফুট), প্রস্থে ১২ দশমিক ১৯ মিটার (৪০ ফুট) এবং দেয়ালের পুরুত্ব ২ দশমিক ২৩ মিটার বা সাড়ে ৭ ফুট)। মসজিদের চারকোণে ৪টি আটকোনা মিনার রয়েছে, যার ওপরের অংশটি ছোট গম্বুজের আকৃতি ধারণ করেছে।

আবুল কালাম মো. জাকারিয়া সম্পাদিত ‘বাংলাদেশের প্রাচীন কীর্তি’ (মুসলিম যুগ) ও মো. মোশাররফ হোসেন সম্পাদিত ‘বেড়াই বাংলাদেশ’ বইয়ে এমনই তথ্য মেলে।

৪০০ বছরেরও বেশি সময়ের প্রাচীন ঐতিহ্যমণ্ডিত এই মসজিদটি বর্তমানে যেমন দরকার সংস্কারের ঠিক তেমনি সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের আওতায়ও আনতে হবে বলে দাবি স্থানীয়দের। তাদের দশ টাকার নোটের সেই বিখ্যাত আতিয়া সমজিদটি আজ একবারেই জীর্ণ। আর এ বিষয়টি মাথায় নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ খানিক দৃষ্টিপাত করবেন এটাই তাদের প্রত্যাশা। নয় তো ইতিহাসের এই নিদর্শন কালের বিবর্তনে ওই ইতিহাসেরই আস্তাকুঁড়ে চলে যাবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৪৩৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ২২, ২০১৪

** তাঁতের রাজধানীতে, লাল শাড়ির দেশে (ভিডিও)
** এবার বই লিখছেন লতিফ সিদ্দিকী!
** আসল পোড়াবাড়ির মিষ্টি খেতে টাঙ্গাইল শহরে
** জৌলুস কমেছে ঐতিহ্যমণ্ডিত পোড়াবাড়ির মিষ্টির
** দেশেও অস্তিত্ব হারাচ্ছেন লতিফ সিদ্দিকী!
** লতিফ সিদ্দিকী ক্যাডারের রাজনীতি করতেন
** মসজিদটি লতিফ সিদ্দিকীর বানানো!
** লতিফ সিদ্দিকীর শাস্তি চান না এলাকাবাসী!
** ৬০ বছরের রাজনীতি ৬ মিনিটেই শেষ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।