ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

আন্তর্জাতিক

সম্পর্কের গভীরতা ও ভারতের সীমানা বিতর্ক

আন্তর্জাতিক ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০২৭ ঘণ্টা, জুলাই ১২, ২০২০
সম্পর্কের গভীরতা ও ভারতের সীমানা বিতর্ক মানচিত্র

সম্প্রতি লাদাখে সীমান্ত বিরোধের জেরে মুখোমুখি অবস্থান নেয় ভারত ও চীন। উভয় দেশই প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখার (এলএসি) কাছে সেনা মোতায়েন করলে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। এক পর্যায়ে গত ১৫ জুন চীনা সেনাদের সঙ্গে হাতাহাতিতে নিহত হন ভারতের ২০ জওয়ান। দিল্লির দাবি, সংঘর্ষে চীনেরও অনেক সেনা নিহত হয়েছেন। কিন্তু চীন এ ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কিছু জানায়নি।

মূলত লাদাখের গালওয়ান উপত্যকা নিয়ে বিরোধ ভারত ও চীনের। চীন এটিকে নিজের বলে দাবি করছে।

অন্যদিকে ভারত সে দাবি উড়িয়ে দিচ্ছে।

ভারতের প্রতি চীনের এই আচরণকে ‘আগ্রাসী’ বলে অভিহিত করেছে আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। তারা বিতর্কিত এসব অঞ্চলের সীমানা নির্ধারণে উভয় দেশকেই আলোচনার ভিত্তিতে শান্তিপূর্ণ পথ বেছে নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে।

এ ঘটনায় ভারতের প্রতি বিশেষ সহমর্মিতা জানিয়েছে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে কৌশলগত অংশীদারীত্ব জোরদারের লক্ষ্যে গঠিত চতুর্দেশীয় সুরক্ষা সংলাপ ফোরাম- কোয়াড-এর (কোয়াড্রিল্যাটেরাল সিকিউরিটি ডায়ালগ) মিত্রদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়া। সামরিক, ভূ-রাজনৈতিকসহ বিভিন্ন কারণে এ ফোরাম গুরুত্বপূর্ণ।

সহমর্মিতা জানালেও ভারতের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা নির্ধারণে, অর্থাৎ জম্মু-কাশ্মীর ও লাদাখের বিতর্কিত বিভিন্ন অঞ্চলের সীমানা ও মালিকানা চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে কোয়াডভুক্ত তিন দেশের তিন রকমের অবস্থান রয়েছে।

ভারতের মানচিত্র তথা অখণ্ডতা চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে তিন দেশের এই ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান দূর হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন ভারতের অনেক কূটনীতিক।

বিশেষ করে চীন যে সময় ভারতের প্রতি ‘আগ্রাসী’ আচরণ করছে এবং লাদাখ সীমান্তে সাংঘর্ষিক অবস্থান নিয়েছে, সে সময় ভূ-রাজনীতি ও ভূ-কৌশলগত স্বার্থে এটি অনেক বেশি প্রয়োজন বলে মত তাদের।

সম্প্রতি এ ব্যাপারটি নিয়ে ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে পরিচালিত দেশটির শীর্ষস্থানীয় প্রতিরক্ষা অধ্যয়ন ও বিশ্লেষণ ইন্সটিটিউট ‘মনোহর পরিকর ইন্সটিটিউট ফর ডিফেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড অ্যানালেসিস’ (আইডিএসএ)-এর মহাপরিচালক সুজন আর. চিনয় এক লেখায় এ ব্যাপারে সারগর্ভ আলোচনা তুলে ধরেন। তার লেখাটি আইডিএসএর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়। সেখান থেকে তা অনুবাদ করে বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো:

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চতুর্দেশীয় সুরক্ষা সংলাপ ফোরাম- কোয়াড- এর (কোয়াড্রিল্যাটেরাল সিকিউরিটি ডায়ালগ) সূত্রে ভারতের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার কৌশলগত অংশীদারীত্ব আরও নিবিড় হয়েছে।

এ লেখায় কোয়াড মিত্ররা ভারতের অখণ্ডতার প্রশ্নে কে কোন ধরনের অবস্থান অবলম্বন করে তা পর্যালোচনা করে দেখা হয়েছে। চীন যখন ভারতীয় সীমান্তে আগ্রাসী হয়ে উঠেছে, যার সূত্রে গত ১৫ জুন রক্তক্ষয়ী এক সংঘর্ষের উদ্ভব হয়, ঠিক সে সময় এই পর্যালোচনা বিশেষ তাৎপর্যময়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
জানা যায়, চীনা আগ্রাসনের মুখে ১৯৬২ সালে তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু এক চিঠিতে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির কাছে সামরিক সহায়তা চান। চিঠিতে রাডার ও লোকবলসহ সব ধরনের আবহাওয়ায় কর্মক্ষম ১২ স্কোয়াড্রন সুপারসনিক যুদ্ধবিমান ও ২ স্কোয়াড্রন বি-৪৭ বোমারু বিমানের অনুরোধ জানান নেহরু। কিন্তু সে সময় দিল্লির প্রতি সহানুভূতিশীল যুক্তরাষ্ট্র সে সব সহায়তা দেওয়ার আগেই চীনের সঙ্গে যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছায় ভারত।

১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ মিত্র হওয়া সত্ত্বেও নিরপেক্ষ অবস্থান অবলম্বন করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সে সময় দুই দেশের ওপরই অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা দেয় তারা।

১৯৭১ সালের যুদ্ধকালে আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করে বঙ্গোপসাগরে পরমাণুচালিত বিমানবাহী সপ্তম নৌ-বহর পাঠায়।

১৯৯৮ সালের মে মাসে ভারতের পরমাণু অস্ত্র পরীক্ষা চালানোয় তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়া। ১৯৯৯ সালের কারগিল যুদ্ধে অপ্রতিরোধ্য ভারতীয় সেনাদের মুখোমুখি হয়ে শেষ মুহূর্তে পাকিস্তানের পিছু হটায় পর্দার আড়াল থেকে ভূমিকা রাখে যুক্তরাষ্ট্র।

বর্তমানে যৌথ সামরিক মহড়া ও সামরিক সরঞ্জাম বিক্রির ক্ষেত্রে ভারতের সবচেয়ে বড় প্রতিরক্ষা মিত্র হওয়া সত্ত্বেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক এর চেয়ে আলাদা কিছু হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি মানচিত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, আমেরিকা কাশ্মীরকে একটি বিতর্কিত অঞ্চল হিসেবে বিবেচনা করে। তারা কাশ্মীরকে ভারত, পাকিস্তান ও চীনের মধ্যে ৩ ভাগে বিভক্ত হিসেবে দেখে। শুধু তাই নয়, এর আগে ১৯৬৮ সালের দিকে মার্কিন সরকার কাশ্মীর প্রশ্নে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার নিয়ন্ত্রণ রেখা (এলওসি) এনজে৯৮৪২ পয়েন্ট থেকে সরাতে সরাতে কারাকোরাম পর্বতমালা পর্যন্ত নিয়ে যায়। তাতে করে সিয়াচেন হিমবাহ যেন পাকিস্তানের অংশ, ব্যাপারটি অনেকটা তেমন দাঁড়ায়। পরবর্তী সময়ে ১৯৮৭ সালের দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ওই বিচ্যুতি শুধরে নিয়ন্ত্রণ রেখাকে আগের জায়গায় নেয়।

এদিকে সিয়াচেন হিমবাহ ভারত নিয়ন্ত্রিত ও জম্মু-কাশ্মীরের অখণ্ড অংশ হলেও মানচিত্রে এটিকে ভারত-পাকিস্তানের বিরোধপূর্ণ এলাকা হিসেবে বর্ণনা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এ ব্যাপারে তারা নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছে।

উল্লেখ্য, মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ তাদের মানচিত্রে কাশ্মীরকে ১৯৪৭ পূর্ববর্তী অখণ্ড সীমানা দিয়ে চিহ্নিত করে। এর মধ্যে ভারত শাসিত জম্মু-কাশ্মীর, লাদাখ, পাকিস্তান শাসিত আজাদ কাশ্মীর, গিলগিত-বালতিস্তান, চীনশাসিত আকসাই চীন ও সংশ্লিষ্ট অঞ্চল অন্তর্ভুক্ত। এর মধ্যে ১৯৬৩ সালের ২ মার্চের সীমান্ত চুক্তি অনুসারে পাকিস্তান তাদের দখলে থাকা জম্মু-কাশ্মীর পরিবেষ্টনকারী কারাকোরাম-সাকসগাম ট্র্যাক্টটি চীনের কাছে সমর্পণ করে। মানচিত্রে সাকসগাম ট্র্যাক্ট চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে সিআইএ স্পষ্ট ভাষায় লিখেছে, ‘এটি ১৯৬৩ সালে পাকিস্তান চীনের কাছে সমর্পণ করে এবং ভারত কখনোই এ অঞ্চল নিজেদের বলে দাবি করেনি। ’

এছাড়া চীনের দখলে থাকা আকসাই চীনকে বিতর্কিত অঞ্চল হিসেবে অভিহিত করেছে সিআইএ। অন্যদিকে তাদের মানচিত্রে অরুণাচল প্রদেশকে ভারতের অখণ্ড অংশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

আজ বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে সম্ভাব্য সব ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিসরে কৌশলগত মিত্র ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র। এ দুই দেশের মধ্যে নিবিড় প্রতিরক্ষা সম্পর্ক বিদ্যমান। দিন দিন সামরিক তথ্য, অবকাঠামোগত সহায়তা ও যোগাযোগ ক্ষেত্রে আদান-প্রদান সংক্রান্ত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ চুক্তির মধ্য দিয়ে তা আরও ব্যাপকতা লাভ করছে।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে হওয়া সাম্প্রতিক ইন্ডাস্ট্রিয়াল সিকিউরিটি অ্যানেক্স (আইএসএ) চুক্তিও ভারতের প্রতিরক্ষা খাতকে স্বাবলম্বী হতে উদ্দীপনা যোগাবে।

সার্বিক প্রেক্ষাপটে সম্প্রতি লাদাখে চীনের সঙ্গে সীমান্ত উত্তেজনাকালে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের অবস্থানকে সমর্থন করে। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও ভারতীয় সেনাদের নিহত হওয়ার ঘটনায় সহমর্মিতা জানান এবং সীমান্ত বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান প্রত্যাশা করেন। যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব-এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় ব্যুরোর সহকারী সচিব ডেভিড আর. স্টিলওয়েল ভারত, দক্ষিণ চীন সাগর ও এ অঞ্চলে অন্যান্য ইস্যুতে চীনের অবস্থানের তীব্র সমালোচনা করেন।

অস্ট্রেলিয়া
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ক্রমবর্ধমানভাবে কাছাকাছি এসেছে ভারত ও অস্ট্রেলিয়া। চলতি বছরের ৪ জুন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসনের মধ্যে অনুষ্ঠিত ভার্চ্যুয়াল সম্মেলনের ফলাফলেও দেখা যায়, এ দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সম্পর্ক জোরদার হচ্ছে।

ব্যাপক কৌশলগত অংশীদারিত্বের প্রশ্নে দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত সিএসপি চুক্তিতে প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সম্পর্কের বিষয়টিতে জোর দেওয়া হয়েছে।

এছাড়া ভারত ও অস্ট্রেলিয়রা মধ্যে অজিনডেক্স ও কাকাডুর মতো যৌথ নৌ-মহড়া, অস্ট্রেলিয়ার পিচ ব্ল্যাক মহড়ায় ভারতীয় বিমান বাহিনীর অংশগ্রহণ ও বিশেষ করে এমএলএসএর মতো পারস্পরিক অবকাঠামোগত সহায়তা বিষয়ক চুক্তি দুই দেশের প্রতিরক্ষা সম্পর্ক জোরদারে ভূমিকা রাখবে।

ভারত-প্রশান্ত অঞ্চলে সামুদ্রিক সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে দুই দেশের সমন্বিত ঘোষণা এ অঞ্চলের মেরিটাইম ডোমেইন অ্যাওয়ারনেস (এমডিএ) বৃদ্ধিতেও ভূমিকা রাখবে।

এছাড়া এ দুই দেশের প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র মন্ত্রীদের মধ্যে ‘টু প্লাস টু’ সংলাপ আগামীতে পারস্পরিক সম্পর্ক জোরদারে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়।

সার্বিক বাস্তবতায় সম্প্রতি চীনের সঙ্গে সীমান্ত বিরোধের জেরে গালওয়ান উপত্যকায় নিহত ভারতীয় জওয়ানদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছে অস্ট্রেলিয়া।

কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার বৈদেশিক সম্পর্ক ও বাণিজ্য বিভাগের (ডিএফএটি) ওয়েবসাইটে জিওসায়েন্স অস্ট্রেলিয়ার তৈরিকৃত দেশটির সরকারি পর্যটন মানচিত্রে দেখা যায়, তারা পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরকে পাকিস্তানের অংশ বলে চিহ্নিত করেছে।

অন্যদিকে জম্মু-কাশ্মীর ও অরুণাচল প্রদেশকে ভারতের এবং আকসাই চীনকে চীনের অংশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আকসাই চীন অঞ্চলের প্রশ্নে অস্ট্রেলিয়ার অবস্থান আমেরিকা থেকে ভিন্ন।

আমেরিকা ওই অঞ্চলকে বিতর্কিত বলে চিহ্নিত করেছে। এছাড়া আমেরিকার সঙ্গে আরও একটি জায়গায় অস্ট্রেলিয়ার অমিল রয়েছে। ১৯৭২ সালে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে নির্ধারিত নিয়ন্ত্রণ রেখা এনজে৯৮৪২ পয়েন্ট থেকে কারাকোরাম পর্যন্ত ইচ্ছা মতো বাড়িয়েছে অস্ট্রেলিয়া। এতে করে সিয়াচেন হিমবাহের মালিকানা পাকিস্তানের হাতে চলে যায়।

জাপান
অর্থনীতি ও প্রতিরক্ষা সহায়তাসহ বিশেষ কৌশল ও বৈশ্বিক অংশীদারীত্বের ইস্যুতে জাপান প্রশ্নাতীতভাবে বর্তমানে ভারতের ঘনিষ্ঠতম মিত্র। ভারতের অন্যতম বৃহৎ বিনিয়োগকারী জাপান বলতে গেলে এ দেশের প্রত্যেক বড় অবকাঠামো ও উন্নয়ন প্রকল্পের অংশীদার। এছাড়া ২০১৫ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় মালাবার নৌ-মহড়া চুক্তির স্থায়ী অংশীদার এ দুই দেশ।

এর বাইরেও সামরিক অবকাঠামোগত সহায়তার অংশ হিসেবে বর্তমানে ভারত ও জাপানের মধ্যে ‘অ্যাকুইজিশন অ্যান্ড ক্রস-সার্ভিসিং অ্যাগ্রিমেন্ট’ নামে একটি চুক্তি আলোচনাধীন। জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ব্যক্তিগত সম্পর্কও দুই দেশের পারস্পরিক আস্থা আরও গভীর করেছে।

সম্প্রতি চীনের অর্থনীতি থেকে জাপানের অর্থনীতি আলাদা করা ও চীনের প্রতি জরুরি পণ্যের নির্ভরতা কমানোর লক্ষ্যে শিনজো আবে গৃহীত কিছু পদক্ষেপ সত্ত্বেও এ দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্কের বাস্তবতায় আগের চেয়ে খুব বেশি হেরফের আসবে না। নানা ক্ষেত্রে এ দুই দেশের অর্থনীতি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।

ফলে এ বাস্তবতা এমনই থাকবে, বিশেষ করে যখন করোনায় সব দেশের অর্থনীতিই আঘাতপ্রাপ্ত।

সার্বিক প্রেক্ষাপটে পূর্ব-চীন সাগরের সেনকাকু দ্বীপ নিয়ে বিরোধ সত্ত্বেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনের সঙ্গে জাপানের সম্পর্ক আগের চেয়ে অনেক সহজ হয়ে উঠেছে। এদিকে আফগানিস্তানে সোভিয়েত দখলদারীর যুগে পাকিস্তানের সঙ্গেও জাপানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। এমনকি এখনও রাজনৈতিক, আমলাতান্ত্রিক বিভিন্ন ইস্যুতে পাকিস্তান জাপানের সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টা
করে।

জাপানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সরকারি পর্যটন মানচিত্রে দেখা যায়, তারাও অস্ট্রেলিয়ার মতো ভুলভাবে এনজে৯৮৪২ পয়েন্টের বদলে ভারত-পাকিস্তান নিয়ন্ত্রণ রেখাকে কারাকোরাম পর্বতমালায় চিহ্নিত করেছে।

এছাড়া অস্ট্রেলিয়ার মতোই জাপানও আকসাই চীন অঞ্চলকে বিতর্কিত অভিহিত না করে এটিকে চীনের অখণ্ড অংশ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্র আকসাই চীনকে বিতর্কিত অঞ্চল বলে উল্লেখ করেছে।

১৫ জুন গালওয়ান উপত্যকায় সীমান্ত বিরোধের জেরে ভারতীয় ও চীনা সেনাদের সংঘর্ষের পর এক বিবৃতিতে জাপানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আশা প্রকাশ করেন, সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের আলোচনার ভিত্তিতে শান্তিপূর্ণভাবে এই পরিস্থিতির সমাধান হবে।

এরপর গত ৩ জুলাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টুইটারে ভারতে নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত এইচ. ই. সাতোশি সুজুকি এক বার্তায় লেখেন, জাপান আলোচনার মাধ্য শান্তিপূর্ণভাবে এ পরিস্থিতির সমাধান চায়। এ ইস্যুতে জাপান কোনো পক্ষের একপেশে পদক্ষেপ সমর্থন করে না বলেও জোর দিয়ে জানান তিনি।

উপসংহার
পারস্পরিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা খাতে দিন দিন ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার সম্পর্ক গভীরতর হচ্ছে। এ অবস্থায় ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের ভূ-কৌশলগত স্বার্থেই মিত্রদেশগুলো ভারতের সীমান্তকে কীভাবে চিহ্নিত করে তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়া ভারতের ঘনিষ্ঠ কৌশলগত অংশীদার। সন্ত্রাসবাদ, জম্মু-কাশ্মীর ইস্যুতে সাংবিধানিক পরিবর্তনসহ গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন ইস্যুতেই এসব দেশ ভারতের পাশে দাঁড়িয়েছে।

সার্বিক প্রেক্ষাপটে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার ক্রমবর্ধমান যৌথ ভূ-কৌশলগত স্বার্থের মুখে এ তিন দেশেরই উচিত এখনই ভারতের মানচিত্র নির্ধারণের ক্ষেত্রে নিজেদের দীর্ঘ দিনের ভুলগুলো শুধরে নেওয়া। বিশেষ করে জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার দিক দিয়ে যথাযথভাবে ভারত-পাকিস্তান নিয়ন্ত্রণ রেখা চিহ্নিত করার মধ্য দিয়ে এর শুরু হতে পারে। তাদের উচিত কারাকোরামের বদলে এনজে৯৮৪২ পয়েন্টে ভারত-পাকিস্তান নিয়ন্ত্রণ রেখা চিহ্নিত করা। তাতে করে তারা অন্তত এ ইস্যুতে আমেরিকার কাতারে গিয়ে দাঁড়াতে পারবে। সর্বোপরি জাতিসংঘের মানচিত্রেও এনজে-৯৮৪২ পয়েন্টকে এ দুই দেশের নিয়ন্ত্রণ রেখা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

লেখক: সুজন আর. চিনয়। তিনি বর্তমানে দিল্লিস্থ মনোহর পরিকর ইন্সটিটিউট ফর ডিফেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড অ্যানালেসিস-এর মহাপরিচালক। এর আগে ভারতের রাষ্ট্রদূত হিসেবে তিনি জাপানে দায়িত্ব পালন করেন।

(নোট: এ লেখায় তুলে ধরা মতামত ও বক্তব্য একান্তই সুজন আর. চিনয়ের। এটিকে মনোহর পরিকর ইন্সটিটিউট ফর ডিফেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড অ্যানালেসিস বা ভারত সরকারের অভিমত হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। ) 

বাংলাদেশ সময়: ১০২৬ ঘণ্টা, জুলাই ১২, ২০২০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।