ঢাকা, মঙ্গলবার, ৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৯ মার্চ ২০২৪, ০৮ রমজান ১৪৪৫

আন্তর্জাতিক

সু চির অস্বীকার: রোহিঙ্গারা বললেন ‘মিথ্যুক’

আন্তর্জাতিক ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩৪৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১২, ২০১৯
সু চির অস্বীকার: রোহিঙ্গারা বললেন ‘মিথ্যুক’

মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যার মতো কোনো ঘটনাই ঘটেনি বলে দাবি করেছেন দেশটির স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চি।

নেদারল্যান্ডসের হেগে আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতে গাম্বিয়ার দায়ের করা মামলার দ্বিতীয় দিনের শুনানিতে তিনি এ দাবি করেন। এ সময় তিনি অতীতের মতো যাবতীয় অভিযোগ উড়িয়ে দেন এবং বিষয়টিকে তার দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে উল্লেখ করেন।

বুধবার (১১ ডিসেম্বর) শুনানির দ্বিতীয় দিনে মিয়ানমারের পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করতে গিয়ে তিনি বলেন, মামলার বাদী গাম্বিয়া গণহত্যার বিষয়ে অসম্পূর্ণ ও বিভ্রান্তিকর তথ্য তুলে ধরেছে।

রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর দুর্ভোগের কথা স্বীকার করে নিলেও আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির ওপর দায় চাপান তিনি। বলেন, স্থানীয় সশস্ত্র গোষ্ঠীকে শায়েস্তা করতেই ২০১৭ সালে সেনাবাহিনী রাখাইনে অভিযান চালিয়েছিল।

সু চির এমন বক্তব্যে হতাশা প্রকাশ করেছেন কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন শিবিরে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীরা। সু চিকে ‘মিথ্যুক’ বলে তারা তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তবে নিষেধাজ্ঞা থাকায় কোনো শিবিরে বিক্ষোভ বা প্রতিবাদ সমাবেশ করতে পারেননি তারা।

নোবেল শান্তিপুরস্কার জয়ী এ রাজনীতিক এবারই প্রথম নয়, এর আগেও রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর অভিযানের যৌক্তিকতা তুলে ধরে বারবার বক্তব্য দিয়েছেন। জাতিগত ঘৃণাও ছড়িয়েছেন একাধিকবার।

দীর্ঘ ১৫ বছর গৃহবন্দি থাকার পর ২০১০ সালে মুক্তি পাওয়া মিয়ানমারের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা জেনারেল অং সানের মেয়ে অং সান সু চি ছিলেন বিতর্কের উর্ধ্বে থাকা গণতন্ত্রের পক্ষে লড়াইয়ের প্রতীক। দাও সু (চাচী সু) নামে সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিত এ নেত্রী ছিলেন মিয়ানমারের সব জাতিগোষ্ঠী ও শ্রেণীর মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য এক নাম।

২০১২ সালে মিয়ানমারের উপ-নির্বাচনে অন্যদের মত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সমর্থনে মিয়ানমারের সংসদে প্রবেশ করেন অং সান সু চি। দীর্ঘদিন জাতিগত বিদ্বেষে জর্জরিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী আশায় বুক বেঁধেছিল, মিয়ানমারের সংসদে হয়তো তাদের পক্ষে কথা বলার জন্য কেউ এসেছেন।

কিন্তু তাদের এ ভুল ভাঙতে দেরি হয়নি বেশিদিন।

২০১২ সালে রাখাইনে রোহিঙ্গা বিরোধী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় সম্পূর্ণ নীরব থাকেন অং সান সু চি। এসময় টিভি সাংবাদিকদের কাছে এক সাক্ষাৎকারে তিনি মন্তব্য করেন, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক কিনা তিনি জানেন না।

২০১৭ সালের রাখাইনে কথিত রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীর হামলার পরিপ্রেক্ষিতে সামরিক বাহিনীর অভিযানের পর অং সান সু চির প্রতিক্রিয়ায় বিস্মিত হয় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। সামরিক বাহিনীর গণহত্যায় মিয়ানমানের গণতন্ত্রের প্রতীক খ্যাত এ নেত্রী শুধু নীরবই থাকেননি, পাশাপাশি রাখাইনে সামরিক বাহিনীর অভিযানকে তিনি যৌক্তিক প্রমাণেরও চেষ্টা চালান।  

এ সময় বিবিসির কাছে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের জাতিগত নিশ্চিহ্নকরণ চলার কথা অস্বীকার করে তিনি বলেন, রাখাইনে চলমান পরিস্থিতির ব্যাখ্যায় ’জাতিগত নিশ্চিহ্নকরণ’ বেশি জোরদার এক শব্দ।

রোহিঙ্গা নিধনে সু চির এরূপ ভূমিকায় বিভিন্ন সময় প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়েছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়।  

শান্তিতে পাওয়া সু চির নোবেল পুরস্কার কেড়ে নেওয়ার দাবিতে অনলাইনে এক পিটিশনে চার লাখের বেশি লোক স্বাক্ষর করেছেন।

পাশাপাশি বিভিন্ন সময় সুচিকে দেওয়া যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড সিটি কাউন্সিলের ‘ফ্রিডম অব অক্সফোর্ড’, যুক্তরাষ্ট্রের হলোকাস্ট মেমোরিয়াল মিউজিয়ামের এলি উইজেল অ্যাওয়ার্ড, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের অ্যাম্বাসেডর অব কনশেন্স অ্যাওয়ার্ড প্রত্যাহার করে নেয় পুরস্কার দানকারী কর্তৃপক্ষ।

২০১৮ সালের অক্টোবরে কানাডায় অং সান সুচির সম্মানজনক নাগরিকত্ব দেশটির পার্লামেন্টের সদস্যদের সিদ্ধান্তে বাতিল করা হয়।

বিশিষ্ট ব্যক্তিরাও বিভিন্ন সময় রাখাইনের পরিস্থিতি অস্বীকার করায় সু চির সমালোচনা করেছেন।

নোবেল শান্তিপুরস্কার বিজয়ী দক্ষিণ আফ্রিকার আর্চবিশপ ডেসমন্ড টুটু সুচির প্রতি এক খোলা চিঠিতে লিখেন, ‘যদি মিয়ানমারের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক কার্যালয়ের আসন আপনার নিরবতার কারণ হয়, তবে তার মূল্য সত্যিই বেশি চড়া।

এ দিকে হেগে চলমান রোহিঙ্গা গণহত্যা মামলার শুনানিতে অংশগ্রহণের আগে অং সান সু চিকে রাখাইনে রোহিঙ্গা বিরোধী গণহত্যার বিষয় স্বীকার করে নেওয়ার জন্য ১০ ডিসেম্বর এক যৌথ বিবৃতি দিয়েছিলেন শান্তিতে সাত নোবেল বিজয়ী।

ইরানের শিরিন ইবাদি, লাইবেরিয়ার লেমাহ গবোই, ইয়েমেনের তাওয়াক্কুল কারমান, উত্তর আয়ারল্যান্ডের মাইরেড মাগুয়ের, গুয়েতেমালার রিগোবার্টা মেনচ তুম, যুক্তরাষ্ট্রের জোডি উইলিয়ামস ও ভারতের কৈলাশ সত্যার্থীর স্বাক্ষরিত এ বিবৃতিতে তারা রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নৃশংসতার বিষয় সুচির ক্রমাগত অস্বীকার করে আসার বিষয়ে উদ্বেগ জানান।

২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমারের রাখাইনে সামরিক বাহিনীর নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার অভিযোগে রোহিঙ্গা বিরোধী অভিযানে নামে দেশটির সামরিক বাহিনী।

জাতিসংঘের বর্ণিত ‘পাঠ্যবইয়ের উদাহরণযোগ্য জাতিগত নিশ্চিহ্নকরণে’র এ অভিযানে ২৪ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা নিহত হয়। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর আগ্রাসন থেকে বাঁচতে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন।

রোহিঙ্গা বিরোধী এ আগ্রাসনের বিষয়ে এ বছর ১১ নভেম্বর আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়া নেদারল্যান্ডসের হেগের আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা করে। মঙ্গলবার (১০ ডিসেম্বর) আদালতে এ মামলার শুনানি শুরু হয়েছে।

আরও পড়ুন>> রাখাইনে সেনা অভিযান মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়: সু চি 
 
বাংলাদেশ সময়: ২২৪৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১১, ২০১৯
এবি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।