ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৭ কার্তিক ১৪৩২, ২৩ অক্টোবর ২০২৫, ০১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৭

আন্তর্জাতিক

আল জাজিরার এক্সপ্লেইনার

ট্রাম্প-পুতিন বৈঠক কেন ভেস্তে গেল, ইউক্রেনে এর প্রভাব কী

আন্তর্জাতিক ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১:৩৪, অক্টোবর ২২, ২০২৫
ট্রাম্প-পুতিন বৈঠক কেন ভেস্তে গেল, ইউক্রেনে এর প্রভাব কী

আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মুখোমুখি বৈঠকের পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু ট্রাম্প রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে বর্তমান যুদ্ধরেখায় যুদ্ধবিরতি দিয়ে ‘স্থগিত’ করার প্রস্তাব দেওয়ার পর মঙ্গলবার সেই পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।

হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ট্রাম্প ইঙ্গিত দেন, আপাতত কোনো বৈঠক হবে না। তিনি বলেন, “আমি কোনো সময় নষ্ট করতে চাই না। ফলহীন বৈঠকে বসে লাভ কী? দেখি, কী হয়। ”

ইউরোপের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় ও প্রাণঘাতী সংঘাতের অবসান ঘটানোর যে শান্তি-আলোচনার প্রক্রিয়া চলছিল, সেটি আবারও ব্যাহত হলো। ৪২ মাস ধরে চলা এই যুদ্ধ ইতোমধ্যে দুই পক্ষেরই কয়েক হাজার মানুষের প্রাণ নিয়েছে।

এর আগে গত আগস্টে যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কায় ট্রাম্প ও পুতিনের মধ্যে এক বৈঠক হয়েছিল, কিন্তু তাতেও কোনো বাস্তব ফল আসেনি।

তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, কেন আবারও এই আলোচনা ভেস্তে গেল? রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থামাতে হলে কী দরকার হবে?

ট্রাম্পের সর্বশেষ প্রস্তাবটা কী ছিল?

গত বছরের নির্বাচনী প্রচারে ট্রাম্প বলেছিলেন, ইউক্রেন যুদ্ধ থামাতে তার মাত্র ‘২৪ ঘণ্টা’ লাগবে। কিন্তু এখন, দ্বিতীয় মেয়াদের দশ মাস পেরিয়ে গেলেও তিনি স্পষ্টতই হতাশ।

পুতিনের অবস্থান বরাবরই কঠোর, তিনি চান ইউক্রেন সম্পূর্ণভাবে নিরস্ত্র হোক এবং রাশিয়া যেসব এলাকা দখল করেছে, সেগুলোর নিয়ন্ত্রণ তার হাতেই থাকুক। ইউক্রেন অবশ্য কোনো ভূখণ্ড ছেড়ে দিতে রাজি নয়। এই দুই চরম অবস্থানের মধ্যে ট্রাম্প কোনো সমঝোতা আনতে পারেননি।

রোববার রাতে ট্রাম্প নতুন প্রস্তাব দেন: যুদ্ধকে বর্তমান ফ্রন্টলাইনে ‘স্থগিত’ রাখা হোক। পরে ভূখণ্ডসংক্রান্ত বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। তিনি বলেন, “আমার কথা হলো, এখনই যুদ্ধ থামাও, সবাই ঘরে ফিরে যাও, মানুষ হত্যা বন্ধ করো, এটুকুই। ”

বর্তমান ফ্রন্টলাইন দনবাস অঞ্চলের মধ্য দিয়ে গেছে, এ অঞ্চলেই সবচেয়ে বেশি যুদ্ধ চলছে। দনবাস প্রসঙ্গে ট্রাম্প বলেন, “এখন যেমনভাবে বিভক্ত আছে, তেমনই থাকুক। প্রায় ৭৮ শতাংশ জায়গা এখন রাশিয়ার দখলে। আপাতত সেটাই থাকুক, পরে যা হওয়ার হবে। ”

ইউক্রেন ও ইউরোপীয় মিত্ররা কি এই প্রস্তাবে সমর্থন দিয়েছে?

হ্যাঁ। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিসহ ইউরোপীয় নেতাদের এক যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, তারা ট্রাম্পের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব ‘জোরালোভাবে’ সমর্থন করছেন। বিবৃতিতে বলা হয়, “বর্তমান যুদ্ধরেখাই ভবিষ্যৎ আলোচনার সূচনা বিন্দু হোক। ”

তারা পুতিনের ওপর শান্তি প্রক্রিয়া বিলম্বিত করার অভিযোগও তোলেন। “রাশিয়া বারবার দেখিয়েছে, ইউক্রেনই একমাত্র পক্ষ যে সত্যিকার অর্থে শান্তি চায়,” বিবৃতিতে বলা হয়।

এ ছাড়া তারা প্রতিশ্রুতি দেন, “রাশিয়ার অর্থনীতি ও প্রতিরক্ষা শিল্পের ওপর চাপ আরও বাড়ানো হবে, যতক্ষণ না পুতিন সত্যিকারের শান্তির পথে আসেন। ”

রাশিয়ার অবস্থান কী?

বৈঠক বাতিল হওয়ার আগেই সোমবার ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ স্পষ্ট জানান, পুতিন এই ‘স্থগিত যুদ্ধ’ প্রস্তাবে রাজি নন। তিনি বলেন, ‘রাশিয়ার অবস্থান অপরিবর্তিত’ অর্থাৎ যুদ্ধ শেষ করার শর্ত হিসেবে রাশিয়া দাবি করছে, ইউক্রেনের সৈন্য প্রত্যাহার ও রাশিয়ার দাবিকৃত অঞ্চলগুলোর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ।

মঙ্গলবার বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্রকে এক গোপন বার্তা পাঠিয়েছে, যেখানে তারা পুরো দনবাস অঞ্চলের ওপর নিয়ন্ত্রণ দাবি করেছে, শুধু দখলকৃত অংশ নয়।

রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ মঙ্গলবার মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওর সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। পরে মস্কোয় সাংবাদিকদের জানান, “আলাস্কা বৈঠকে যে বোঝাপড়া হয়েছিল, রাশিয়ার অবস্থান এখনো সেখানেই আছে। ”

তিনি পুনর্ব্যক্ত করেন, রাশিয়া যুদ্ধ শেষ করবে কেবল তখনই, যখন ‘সংঘাতের মূল কারণগুলো’ দূর হবে। অর্থাৎ ইউক্রেন নিরস্ত্র হবে এবং রাশিয়ার দখলকৃত ভূখণ্ডগুলো রাশিয়ারই থাকবে।

অবশ্যই, এটি কিয়েভের কাছে অগ্রহণযোগ্য।

আলোচনার সময় ট্রাম্পের অবস্থান কি পরিবর্তিত হয়েছে?

হ্যাঁ, বারবার। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধবিরতি নিয়ে মধ্যস্থতা করতে গিয়ে ট্রাম্প নিজের অবস্থান বহুবার বদলেছেন।

আগের প্রশাসন, প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সময়, ইউক্রেনের প্রতি নিঃশর্ত সমর্থন জানিয়েছিল। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন শুরু থেকেই জেলেনস্কির সঙ্গে কঠোর আচরণ করে। গত ফেব্রুয়ারিতে হোয়াইট হাউসে এক বৈঠকে ট্রাম্প ও ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স জেলেনস্কিকে তিরস্কার করেন—“যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া সাহায্যের জন্য তুমি যথেষ্ট কৃতজ্ঞতা দেখাওনি। ”

মার্চে ট্রাম্প রাশিয়ার ওপর কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার হুমকি দেন, যা তিনি আগস্টেও পুনরাবৃত্তি করেন। কিন্তু সেই আগস্টেই আলাস্কা বৈঠকে তিনি উল্টো জেলেনস্কির ওপর চাপ দেন, যেন ইউক্রেন কিছু ভূখণ্ড ছেড়ে দিয়ে চুক্তিতে রাজি হয়।

সাংবাদিকদের ট্রাম্প বলেন, “দুই পক্ষকেই কিছু ভূমি ছাড় দিতে হবে, কিছুটা আদান-প্রদান হবে। ”

এরপর পরের মাসে তিনি আবার অবস্থান বদলে বলেন, “ইউক্রেন নিজের ভূমি পুনরুদ্ধার করতে পারে, হয়তো আরও কিছু। ”

এর অর্থ কী দাঁড়ায়?

মূলত, আরও অনিশ্চয়তা। বৈঠক বাতিল হওয়ায় আপাতত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কোনো সমাপ্তি দেখা যাচ্ছে না।

গত সপ্তাহেই জেলেনস্কি আবারও হোয়াইট হাউসে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে টমাহক মিসাইল চেয়েছিলেন, যা রুশ ভূখণ্ডের গভীরে আঘাত হানতে পারে। কিন্তু ট্রাম্প তাতে সম্মতি দেননি।

যদিও আগে তিনি এ বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছিলেন, শুক্রবারের বৈঠকে তিনি আবার পিছু হটেন।

জেলেনস্কি সামরিক সহায়তা বাড়ানোর অনুরোধও জানিয়েছেন, তবে ট্রাম্প ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, এখন ইউক্রেনের ইউরোপীয় ন্যাটো মিত্রদেরই ‘বেশি সক্রিয় ভূমিকা নেওয়া উচিত’।

এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।