ইসরায়েল নিজে পারমাণবিক অস্ত্রের মালিক বলে ধারণা করা হলেও তারা এক্ষেত্রে ‘কৌশলগত অস্পষ্টতা’ নীতিতে চলে, অর্থাৎ কখনও আনুষ্ঠানিকভাবে অস্ত্র থাকার কথা স্বীকার বা অস্বীকার করে না। তবে ইসরায়েল নিশ্চিত করতে চায় যেন কোনো বৈরী রাষ্ট্র পারমাণবিক সক্ষমতা অর্জন না করতে পারে।
এই উদ্বেগ থেকেই ইসরায়েল কয়েক দশক ধরে গোপন অভিযান ও সামরিক হামলা চালিয়ে আসছে, যার লক্ষ্য ছিল প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর পারমাণবিক কর্মসূচি থামিয়ে দেওয়া যা ‘বেগিন মতবাদ’ হিসেবে পরিচিত।
ইসরায়েলিদের এমন একটি গোপন অভিযানের নাম অপারেশন ড্যামোক্লিস। মূলত ১৯৬২ থেকে ৬৩ সাল পর্যন্ত মিসরের রকেট কর্মসূচিকে লক্ষ্যবস্তু এই অভিযান গুলো পরিচালিত হয়। ১৯৬০-এর দশকের শুরুর দিকে মিসর, তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গামাল আবদেল নাসেরের নেতৃত্বে, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও জেট বিমান কর্মসূচিতে বিপুল বিনিয়োগ শুরু করে। মিসর তখন নাৎসি জার্মানির সাবেক বিজ্ঞানীদের সাহায্যে দীর্ঘপাল্লার রকেট বানানোর কাজ করছিল।
ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ এ কর্মসূচি দমনে এক অভিযান শুরু করে। গোপন এই অভিযানে পার্সেল বোমা, হুমকি ও ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে বিজ্ঞানীদের হত্যা বা কর্মসূচি থেকে সরে যেতে বাধ্য করা হয়। এই অপারেশনে মিসরের রকেট কর্মসূচি বড় ধরনের ধাক্কা খায়, যা মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের ভবিষ্যৎ কৌশলের রূপরেখা স্থির করে দেয়।
এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৮১ সালের ৭ জুন, ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান ইরাকের বাগদাদের কাছে ওসিরাক পারমাণবিক চুল্লিতে হামলা চালায়। যা ‘অপারেশন অপেরা’ নামে পরিচিত। ইরাক দাবি করেছিল এটি শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে নির্মিত, কিন্তু ইসরায়েল আশঙ্কা করছিল যে এর মাধ্যমে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করা হবে।
হামলার দুই দিন পর তেল আবিবে এক নাটকীয় সংবাদ সম্মেলনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগিন অভিযানের সম্পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করেন, এর বাস্তবায়নকে অসাধারণ বলে প্রশংসা করেন এবং নৈতিক ও আইনি উভয় দিক থেকেই এটিকে ন্যায্যতা দেন। বেগিন এই হামলাকে ‘সর্বোচ্চ আত্মরক্ষার পূর্বাভাসমূলক পদক্ষেপ’ হিসেবে উল্লেখ করেন। বেগিন যে বার্তাটি দিয়েছিলেন তা হল ওসিরাকের উপর অভিযান এককালীন অভিযান নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদী জাতীয় অঙ্গীকার।
এই হামলা ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা নীতিতে ‘বেগিন মতবাদ’ চালু করে। যার মূলনীতি হলো শত্রু রাষ্ট্রগুলোকে পারমাণবিক শক্তি অর্জন করতে না দেওয়া। এই মতবাদের ভিত্তিতে পরবর্তীতেও ইসরায়েল একই ধরনের পদক্ষেপ নেয়।
এরপর ২০০৭ সালে ইসরায়েল আরও একটি গোপন হামলা চালায় সিরিয়ার ডেইর আজ-জোর অঞ্চলের আল-কিবার পারমাণবিক স্থাপনায়। ইসরায়েলের আশঙ্কা ছিল, প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ গোপনে একটি পারমাণবিক চুল্লি নির্মাণ করছেন।
৬ সেপ্টেম্বর রাতে চালানো হামলায় চুল্লিটি পুরোপুরি ধ্বংস হয়। ইসরায়েল এ হামলার কথা ২০১৮ সালের আগে প্রকাশ করেনি। পরে জাতিসংঘের তদন্তে সাইটে ইউরেনিয়ামের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। সিরিয়া বিষয়টি নিয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি এবং ওই স্থানটি বুলডোজ দিয়ে মাটি চাপা দেওয়া হয়।
ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউট ফর নিয়ার ইস্ট পলিসির বিশেষজ্ঞ অ্যান্ড্রু ট্যাবলার বলেন, বেগিন মতবাদ ইরাক ও সিরিয়ার ক্ষেত্রে খুবই কার্যকর ছিল। তবে ইরানের ক্ষেত্র ভিন্ন।
তিনি বলেন, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে হামলা পুরো কর্মসূচিকে ধ্বংস নাও করতে পারে। এতে ইরান পাল্টা হামলা চালাতে পারে, বিশেষ করে উপসাগরীয় অঞ্চলের মার্কিন মিত্রদের তেল পরিকাঠামোয়, যা বিশ্বজুড়ে জ্বালানি বাজারে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, অতীতে ইসরায়েলের যেসব অভিযান সফল হয়েছে, তা ভবিষ্যতের জন্য একটি রূপরেখা হিসেবে কাজ করতে পারে। তবে ইরানের মতো উচ্চ নিরাপত্তাসম্পন্ন এবং ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কর্মসূচির বিরুদ্ধে সফল অভিযান চালানো অনেক বেশি জটিল ও বিপজ্জনক।
তাছাড়া মিশর, সিরিয়া কিংবা ইরাক হামলার শিকার হওয়ার পর কেউ সেই অর্থে ইসরায়েলকে প্রত্যাঘাত করতে ব্যর্থ হয়। যা ইরানের ক্ষেত্রে ছিল সমপূর্ণ উল্টো। ইরান যে মাত্রায় ইসরায়েলে ক্ষয়ক্ষতি করেছে তা প্রতিষ্ঠার পর থেকে ইসরায়েলিরা কখনো দেখেনি।
সূত্র: ডয়চে ভেলে
এমএম