ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৬ আষাঢ় ১৪৩২, ১৯ জুন ২০২৫, ২২ জিলহজ ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

ইরান নিয়ে ৩০ বছর ধরে একই বুলি আওড়াচ্ছেন নেতানিয়াহু

আন্তর্জাতিক ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০:৪৮, জুন ১৮, ২০২৫
ইরান নিয়ে ৩০ বছর ধরে একই বুলি আওড়াচ্ছেন নেতানিয়াহু ২০১২ সালে জাতিসংঘের অধিবেশনে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু একটি কার্টুন দেখিয়ে ইরানের পরমাণু বোমার বানানোর অগ্রগতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। ছবি: এপি

বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। কূটনীতিক, সংসদ সদস্য থেকে শুরু করে মন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা হয়ে প্রধানমন্ত্রী।

জায়নবাদী রাষ্ট্র ইসরায়েলে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি ইরান নিয়ে আওড়ে যাচ্ছেন একই বুলি। বলে আসছেন, ইরান শিগগির পরমাণু বোমা তৈরি করে ফেলবে। এই জুজুকেই সামনে এনে তিনি বারবার ইরানের ওপর আগ্রাসন চালিয়েছেন। সবশেষ গত ১৩ জুন নতুন করে ইরানে হামলা চালিয়েছে যুদ্ধবাজ নেতানিয়াহুর দখলদার বাহিনী।  

সংবাদমাধ্যমের খবর বলছে, ১৯৯২ সালে সংসদ সদস্য হিসেবে ইসরায়েলের সংসদে বক্তব্য রাখেন বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। তখন থেকেই তিনি নিয়মিতভাবে দাবি করে আসছেন, কয়েক বছরের মধ্যে তেহরান পারমাণবিক বোমা অর্জনের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যাবে।  

সে সময় নেতানিয়াহু বলেছিলেন, আগামী তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে ইরান পারমাণবিক বোমা তৈরি এবং উৎপাদনের ক্ষেত্রে স্বনির্ভর হয়ে উঠবে। পরে ১৯৯৫ সালে তার ‘ফাইটিং টেরোরিজম’ বইয়ে একই ভবিষ্যদ্বাণীর কথা পুনরাবৃত্তি করেন।

নেতানিয়াহুর বয়ানে ‘আসন্ন হুমকির’ অনুভূতি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক ও সিদ্ধান্তকে বারবারই প্রভাবিত করেছে।  

১৯৯৬ সালের ১০ জুলাই ওয়াশিংটনে মার্কিন কংগ্রেসে এক যৌথ অধিবেশনে দেওয়া বক্তব্যে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সতর্ক করে বলেন, ইরাক ও ইরান তাদের পারমাণবিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করছে, এটি ধ্বংস ডেকে নিয়ে আসবে। সে সময় তিনি ইরান এবং ইরাককে পারমাণবিক সক্ষমতা অর্জন থেকে বিরত রাখতে ইউরোপ এবং এশিয়াকে সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালানোর আহ্বান জানান।

২০০২ সালে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু মার্কিন কংগ্রেসের একটি কমিটির সামনে বলেন, ইরাক ও ইরান উভয়ই পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের প্রতিযোগিতায় নেমেছে। সে সময় তিনি ইরাক আক্রমণের পরামর্শ দেন।  

এর কিছুদিন পরেই যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ইরাক আক্রমণ করা হয়। সে সময় পশ্চিমারা তাদের মিডিয়াগুলোর সহায়তায় ব্যাপক প্রচারণা চালায় যে, ইরাকে গণবিধ্বংসী অস্ত্র আছে। যদিও পরবর্তীতে সেখানে কোনো গণবিধ্বংসী অস্ত্র খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে সেদেশের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়। বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে ইরাক।

২০০৯ সালে উইকিলিকস প্রকাশিত মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের এক তার বার্তায় জানা যায়,  বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু মার্কিন কংগ্রেস সদস্যদের বলেছিলেন, ইরান মাত্র এক বা দুই বছরের মধ্যে পারমাণবিক সক্ষমতা অর্জন করতে পারে।  

তার তিন বছর পর ২০১২ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে নেতানিয়াহু তার বিখ্যাত একটি পারমাণবিক কার্টুন বোমার ছবি দেখিয়ে দাবি করেন, ইরান আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে পারমাণবিক সীমার আরও কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। সে সময় তিনি বলেছিলেন, পরবর্তী বসন্তে, সর্বোচ্চ পরবর্তী গ্রীষ্মে ইরান মাঝারি মাত্রার ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ সম্পন্ন করে এবং বোমা তৈরির চূড়ান্ত ধাপে প্রবেশ করবে।

বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর প্রথম সতর্কবার্তার ৩০ বছরের বেশি সময় পর গত ১৩ জুন ইসরায়েল ইরানে একই সন্দেহের বশে হামলা চালিয়েছে। এখনো ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী দাবি করছেন, ইরানের পারমাণবিক বোমা বানানোর বিষয়ে তার ‘সতর্কতা’ খুবই জরুরি। নেতানিয়াহু এখনো বলছেন, যদি থামানো না হয়, ইরান খুব স্বল্প সময়ের মধ্যেই হয়তো কয়েক মাস, এমনকি কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই একটি পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে পারবে।

যদিও সম্প্রতিই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার পরিচালক তুলসী গ্যাবার্ড বলেছেন, ইরান পারমাণবিক বোমা তৈরি করছে, তাদের কাছে এমন কোন প্রমাণ নেই।  

এমনকি যে বৈশ্বিক সংস্থা তদারকির দায়িত্বে, সেই জাতিসংঘের পরমাণু পর্যবেক্ষক সংস্থাও (আইএইএ) কখনো বলেনি, তেহরানের পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচির কোনো প্রমাণ আছে।

মিথ্যার জন্য উপহাসের পাত্র নেতানিয়াহু
নেতানিয়াহুর এই কর্মকাণ্ডে ইরান এক সময় তাকে ‘নেকড়ে এল বলে চিৎকার করা ছেলেটি’—বলে উপহাস করেছিল।  

২০১১ সালে তখনকার ফরাসি প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজি যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সঙ্গে কথা বলার সময় বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন, যা মাইক্রোফোনে ধরা পড়ে যায়। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি আর ওকে সহ্য করতে পারি না, ও একজন মিথ্যাবাদী’।

২০১৮ সালে নেতানিয়াহু যখন আবারও ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণের পরিকল্পনার অভিযোগে অভিযুক্ত করেন, তখন ইরানের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ জাওয়াদ জারিফ বলেছিলেন, ‘আপনি মানুষকে বারবার বোকা বানাতে পারেন না’।

কোন উন্মাদনায় নেতানিয়াহু এমন বেপরোয়া?
সমর্থকদের কাছে ‘কিং বিবি’ নামে পরিচিত নেতানিয়াহু গত কয়েক বছর ধরে কঠিন সময় পার করেছেন। ৭৫ বছর বয়সী এই রাজনীতিকের ‘ইহুদী জাতির জন্য কিছু করে যাওয়ার’ সময়ও ফুরিয়ে আসছে।

২০২৩ সালের হামাসের আক্রমণের মাধ্যমে তার হঠকারী ও শক্ত অবস্থানের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জনমত জরিপ অনুযায়ী, অধিকাংশ ইসরায়েলি এই নজিরবিহীন নিরাপত্তা ব্যর্থতার জন্য তাকেই দায়ী করছেন—যে ব্যর্থতার ফলে দেশটির ৭৫ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রাণঘাতী হামলাটি সংঘটিত হয়।

এসব পরিস্থিতি বিবেচনায় নেতানিয়াহু তার ভাবমূর্তি উদ্ধারে ইরানে হামলার মতো আগ্রাসী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে।

এমইউএম/এমএম/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।