মধ্যপ্রাচ্যে ইরান ও ইসরায়েলের চলমান সংঘাত ক্রমেই বিস্তৃত হচ্ছে। এই দুই দেশের সামরিক শক্তি নিয়ে বিশ্বজুড়ে চলছে নানা বিশ্লেষণ।
সক্রিয় সামরিক সদস্যের দিক থেকে ইরানের রয়েছে ছয় লাখেরও বেশি সেনা, যেখানে ইসরায়েলের সক্রিয় সদস্য সংখ্যা মাত্র এক লাখ ৬৯ হাজারের মতো। তবে রিজার্ভ সেনা সংখ্যায় ইসরায়েল অনেকটা এগিয়ে, যার সংখ্যা প্রায় সাড়ে চার লাখ, আর ইরানের রিজার্ভ সদস্য সংখ্যা সাড়ে তিন লাখ। অর্থাৎ, যুদ্ধ শুরুর পর দ্রুত সেনা তলবের দিক থেকে ইসরায়েলের সক্ষমতা বেশি।
প্রতিরক্ষা বাজেটে দুই দেশের ব্যবধান বিশাল। ইসরায়েল এক বছরে প্রতিরক্ষায় ব্যয় করে প্রায় ২৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ইরানের ১০ বিলিয়নের চেয়ে প্রায় তিনগুণ বেশি। এই অর্থ দিয়ে তারা উন্নত প্রযুক্তির যুদ্ধাস্ত্র, গোয়েন্দা সরঞ্জাম ও আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে।
যুদ্ধবিমানের সংখ্যায় দুই দেশ প্রায় সমান, তবে মানে রয়েছে বিশাল ফারাক। ইসরায়েলের হাতে রয়েছে উন্নত মার্কিন তৈরি এফ-৩৫ স্টিলথ বিমান, যা রাডারে ধরা পড়ে না। অন্যদিকে ইরানের বেশিরভাগ যুদ্ধবিমানই পুরনো সোভিয়েত আমলের সুখোই ও মিগ মডেলের, যেগুলোর কার্যকারিতা তুলনামূলকভাবে কম।
বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায়ও ইসরায়েল অনেকটা এগিয়ে। আকাশে আক্রমণ ঠেকাতে তাদের রয়েছে আয়রন ডোম, ডেভিড’স স্লিং এবং অ্যারো সিস্টেমের মতো বিশ্বখ্যাত প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি। অপরদিকে ইরান ব্যবহার করছে নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি বাভার-৩৭৩, রাশিয়ার দেওয়া এস-৩০০ ও খোরদাদ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা।
মর্টার ও কামানসহ আর্টিলারির দিক থেকে ইরান অনেক এগিয়ে—তাদের রয়েছে প্রায় সাত হাজার ইউনিট, যেখানে ইসরায়েলের সংখ্যা মাত্র পাঁচ শতাধিক। তবে এখানে প্রশ্ন থেকে যায়—এই আর্টিলারি কতটা কার্যকর এবং কতটা আধুনিক।
হেলিকপ্টার ও সাবমেরিনের সংখ্যাতেও ইরান এগিয়ে। তাদের রয়েছে উনিশটি সাবমেরিন এবং ৩৪টির বেশি হেলিকপ্টার। ইসরায়েলের হাতে রয়েছে পাঁচটি সাবমেরিন এবং ৪৬টি হেলিকপ্টার। তবে এখানে আবারও প্রযুক্তির বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ইসরায়েল পশ্চিমা দেশের সহযোগিতায় উন্নততর প্রযুক্তির যুদ্ধযান ব্যবহার করে।
এই সামরিক শক্তির তুলনাতেই উঠে এসেছে বড় প্রশ্ন—এই সংঘাতের শেষ কোথায়? ইসরায়েলের সাবেক কূটনীতিক এবং বর্তমান ‘দ্য ইনডিপেনডেন্ট’ পত্রিকার কলাম লেখক আলন পিনকাস বলেছেন, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি থেকে উদ্ভূত হুমকির কারণে অধিকাংশ ইসরায়েলি নাগরিক ইরানে হামলাকে সমর্থন করেন।
আল জাজিরাকে তিনি বলেন, অধিকাংশ ইসরায়েলির মানসিকতা এমনভাবে গড়ে তোলা হয়েছে যেন ইরান একটি আসন্ন ও অস্তিত্বগত হুমকি, যাকে সামরিকভাবে মোকাবিলা করাই শ্রেয়—কূটনৈতিকভাবে নয়। তিনি আরও বলেন, একদিকে ইসরায়েলিরা মনে করছেন, তারা যা করছে তা সঠিক। আবার জাতীয় মানসিকতার দিক থেকে দেখতে গেলে, এটি ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের বিপর্যয়ের (হামাসের হামলার) এক ধরনের প্রতিশোধমূলক প্রতিক্রিয়া।
তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, এসবের পরও বিষয়টি এখনও স্পষ্ট নয়—এই অভিযানের শেষ লক্ষ্য কী? এক্সিট স্ট্র্যাটেজি বা বহির্গমন কৌশল কী? রাজনৈতিকভাবে অর্জনযোগ্য কোনো স্পষ্ট লক্ষ্য কি আছে? কারণ, কেবল বিমান হামলা চালিয়ে তো কোনো শাসনব্যবস্থা বদলে দেওয়া সম্ভব নয়।
এই বাস্তবতায় একটি বিষয় স্পষ্ট—সংখ্যায় ইরান এগিয়ে থাকলেও প্রযুক্তি ও পশ্চিমা সহায়তায় ইসরায়েলের হাতে রয়েছে ভয়ংকর সব প্রতিরক্ষা ও আক্রমণ ক্ষমতা। কিন্তু তীব্র সংঘাতে এই দুই দেশের লড়াই কেবল মধ্যপ্রাচ্য নয়, গোটা বিশ্বের অর্থনীতি ও নিরাপত্তার ওপরই ফেলছে গভীর প্রভাব। পরিস্থিতি যদি এভাবেই চলতে থাকে, তাহলে তা একটি দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ বা বিস্তৃত আঞ্চলিক সংঘাতে রূপ নিতে পারে।
আরএইচ