ইরানে হামলা চালানো নিয়ে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে উত্তেজনা ক্রমেই বাড়ছিল। সেই উত্তেজনা এখন স্পষ্ট হয়ে এলো।
ট্রাম্প বারবার নেতানিয়াহুকে বলে আসছিলেন, এখন ইরানে হামলা চালানোর উপযুক্ত সময় নয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট তাকে অপেক্ষা করতে বলেন, কারণ যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন এখনো ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক আলোচনার মধ্যেই রয়েছে।
তবে স্পষ্টতই ইসরায়েল মনে করছিল, এখনই তাদের জন্য উপযুক্ত সময়। তাদের বিশ্বাস, এ মুহূর্তে ইরান আঞ্চলিকভাবে যতটা দুর্বল, তার চেয়ে বেশি আর হবে না।
বিশেষ করে গত বছর লেবাননে হিজবুল্লাহ দুর্বল হওয়ার পর ইসরায়েলের বিরুদ্ধে থাকা একটি বড় প্রতিবন্ধকতা সরে গেছে। আর এটিই ইসরায়েলের জন্য ‘উপযুক্ত সুযোগ’ তৈরি করেছে। নেতানিয়াহুর মনে হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের অপছন্দ হলেও এখনই সময়—ইরানে হামলা চালানোর জন্য।
ইরানে সামরিক হামলার খবর ছড়িয়ে পড়ার পরপরই যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও এক সংক্ষিপ্ত বিবৃতি দেন, যেখানে তিনি ইসরায়েলের এ হামলার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো সম্পৃক্ততা নেই বলে সাফ জানিয়ে দেন এবং একে ‘একতরফা অভিযান’ হিসেবে উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, ‘আমরা ইরানে হামলার সঙ্গে যুক্ত নই। আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হলো, আঞ্চলিক অঞ্চলে অবস্থানরত মার্কিন সেনাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। ’
রুবিও আরও জানান, ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রকে জানিয়েছে, ‘ইরানে এই হামলা তাদের আত্মরক্ষার স্বার্থে প্রয়োজনীয়। ’
এই মুহূর্তে হোয়াইট হাউস প্রকাশ্যেই ইসরায়েলের সামরিক অভিযান থেকে নিজেদের আলাদা রাখছে। তারা স্পষ্টভাবে বোঝাতে চাচ্ছে যে, অন্তত আপাতত যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধে জড়াতে চাচ্ছে না।
গত বছরও একই ধরনের পরিস্থিতি দেখা গিয়েছিল, যখন ইসরায়েল আঞ্চলিক সংঘাতকে আরও বড় পরিসরে নিয়ে যায়, আর যুক্তরাষ্ট্র তখন ক্ষয়ক্ষতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করে, ইসরায়েলকে প্রতিরক্ষা সহায়তা দেয়, তবে মূল লক্ষ্য ছিল যুদ্ধের ঘূর্ণিতে যুক্তরাষ্ট্রকে না জড়ানো।
বৃহস্পতিবারের হামলার কয়েক ঘণ্টা আগেই মার্কিন কর্মকর্তারা ব্রিফিংয়ে জানিয়ে দেন, ইসরায়েল যদি ইরানে হামলা চালায়, তাহলে তাতে কোনো মার্কিন সহায়তা থাকবে না। এমনকি তারা স্পষ্ট করে বলেন, আকাশপথে জ্বালানি সরবরাহেও তারা সহায়তা করবে না।
এই বার্তা ছিল মূলত তেহরানকে উদ্দেশ্য করে, যেন তারা বুঝে নেয়, এই হামলায় যুক্তরাষ্ট্র সম্পৃক্ত নয়।
রুবিওর বক্তব্যে যুক্তরাষ্ট্রের ‘দূরত্ব’ দেখানোর কৌশলটি ঠিক কতটা কৌশলগত, আর কতটা ট্রাম্প ও নেতানিয়াহুর মধ্যকার সাম্প্রতিক টানাপোড়েনের প্রতিফলন, তা এখনও স্পষ্ট নয়।
তিনি যে বিবৃতি দিয়েছেন, সেখানে ইরানের পাল্টা হামলা মোকাবিলায় ইসরায়েলকে যুক্তরাষ্ট্র সহায়তা করবে কি না—তা নিয়ে কোনো উল্লেখই ছিল না। যদিও বাস্তবে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে প্রতিরক্ষা সহায়তা দেবে বলেই ধরে নেওয়া হয়, তারপরও এমন ‘নীরবতা’ বেশ অস্বাভাবিক।
অন্যদিকে ইসরায়েল বলেছে, হামলার আগে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ‘সম্পূর্ণ ও পূর্ণাঙ্গ সমন্বয়’ ছিল। তবে ওয়াশিংটন থেকে এখনো সেই বক্তব্যের প্রতিধ্বনি আসেনি।
তবে রুবিও এক পর্যায়ে ইরানকে হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন, ‘একথা স্পষ্ট করে বলছি—ইরান যেন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ বা মার্কিন নাগরিকদের লক্ষ্য করে কোনো হামলা না করে। ’
এখন ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কতটা কার্যকর, বিষয়টি সেই প্রশ্নও সামনে এনেছে। কারণ ইরান যদি পাল্টা হামলা চালায়, যা এখন প্রায় নিশ্চিত—তাহলে ইসরায়েলকে তা মোকাবিলা করতে হবে। ইতোমধ্যে ইরান তেল আবিব লক্ষ্য করে শতাধিক ড্রোন পাঠিয়েছে বলে খবর এসেছে।
ইসরায়েল যখন ইরানে হামলা চালায়, তখনই দেশজুড়ে সাইরেন বেজে ওঠে, যেন মানুষ জেগে উঠে নিরাপদ আশ্রয় নিতে পারে। এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, যুক্তরাষ্ট্র এখন ইসরায়েলকে কতটা সহায়তা করবে।
এর আগে দুবার এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি জড়াতে হয়। এবারও সেই আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। কারণ পরিস্থিতি খুব দ্রুত জটিল হয়ে উঠতে পারে এবং নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
গতবারের মতো এবার ইসরায়েলের মিত্রদের কাছ থেকে আগেভাগে কোনো সমন্বিত উদ্যোগের আভাস পাওয়া যায়নি। বরং এবারের হামলা অনেক বেশি হঠাৎ, তাড়াহুড়া করে ও সমন্বয়হীনভাবে চালানো হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
পরবর্তী কয়েক ঘণ্টা এবং দিনগুলো মধ্যপ্রাচ্যে বড় কোনো সংঘাতের দিকেই ইঙ্গিত দিচ্ছে। পরিস্থিতির মোড় কোনদিকে যায়, তা নির্ভর করছে পাল্টা-পাল্টি বিভিন্ন প্রতিক্রিয়ার ওপর।
আরএইচ
