ঢাকা, শুক্রবার, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

তথ্যপ্রযুক্তি

অনলাইনে কনটেন্ট চুরি ঠেকাতে ডিএমসিএ

মাহমুদ মেনন, হেড অব নিউজ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯২০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৪, ২০১৭
অনলাইনে কনটেন্ট চুরি ঠেকাতে ডিএমসিএ ডিএমসিএ

ডিএমসিএ বা ডিজিটাল মিলেনিয়াম কপিরাইট অ্যাক্ট নামে একটি আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় অনলাইনে প্রকাশিত সকল আধেয় (কনটেন্ট) কে সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব।

অনলাইনের কনটেন্টে কপিরাইটের সিম্বল (©) না থাকলেও এই সুরক্ষা পাওয়া যাবে। সে জন্য প্রয়োজন স্রেফ নিবিড় পর্যবেক্ষণ এবং এতদসংক্রান্ত কিছু জ্ঞান ও ধারনা।



যে কোনও কনটেন্ট, হোক তা অনলাইনের, প্রিন্ট কিংবা অন্য কোনও মিডিয়ার, কপিরাইট আইন দিয়ে সুরক্ষিত। কপিরাইটের লঙ্ঘন প্রতিহত করতে চাই সারাক্ষণের নজরদারি। কিছু ব্যবস্থা নিলেই এই অপরাধ প্রতিহত করা সম্ভব। আর এটা এতটাই কঠোর ও কার্যকর যে, আপনি যদি নিজের কনটেন্ট অনলাইনের দুই জায়গায় হুবহু ব্যবহার করেন, কিংবা কপি-পেস্ট করেন নিজেও বিপাকে পড়ে যেতে পারেন।
অনলাইন কনটেন্ট চুরি প্রতিহত করা কেনো জরুরি?

মূলত সকল মিডিয়াতেই কপিরাইট গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, এর মধ্য দিয়েই যিনি কনটেন্ট তৈরি করেন তাতে তার নিজের একটা বৈধ মালিকানা নিশ্চিত হয়। লেখক, শিল্পী সকলের ক্ষেত্রেই বিষয়টি প্রযোজ্য। এই কপিরাইটের মাধ্যমেই তারা তাদের লেখাটি বা চিত্রকর্মটি কোথায় ব্যবহার হচ্ছে না হচ্ছে তার ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেন। এখানে কপিরাইট সংরক্ষিত না থাকলে অন্য কেউ আপনার কাজটিকে চুরি করে নিতে পারে কিংবা ব্যবহার করতে পারে। এতে যিনি সৃষ্টি করেছেন তার ভাগ্যে কিছুই জোটে না, অন্য কেউ বড় মুনাফা হাতিয়ে নেয়, এমনটাও দেখা গেছে। কপিরাইট যাতে কেউ লঙ্ঘন করতে না পারে সে দায়িত্ব কপিরাইট হোল্ডারের নিজেরই। সুতরাং ইন্টারনেটে আপনার কনটেন্ট অন্য কেউ ব্যবহার করছে কি করছে না তার ওপর নজরদারির দায়িত্বও আপনারই।

অনলাইন কনটেন্টেন্টের জন্য কপিরাইট বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ‘কপি’ বাটনে স্রেফ একটি ক্লিক করেই একটি সাইট থেকে অন্য সাইটে কনটেন্ট চুরি করে নেওয়া সম্ভব। ডিজিটালের এই যুগে এই কপি পেস্টের মতো অপরাধ হরহামেশাই ঘটছে।

অনলাইনের টেক্সট কপি করার বিষয়টি এই আলোচনায় গুরুত্ব দিতে চাই। আগেই বলেছি মনিটরিং বা নজরদারিই সব।

মনিটরিংয়ের এ কাজে গুগল পান্ডা হতে পারে আপনার বড় উপকারী বন্ধু। আপনি যদি গুগল পান্ডার শরণাপন্ন হন কাজ অনেকটাই সহজ হয়ে যাবে।

প্রশ্ন থাকবেই- গুগল পান্ডা কী? এটি গুগল সার্চের একটি অ্যালগরিদম। ২০১১ সালে এটি ভার্চুয়াল জগতে ছাড়ে গুগল। ২০১৬তে একটি আপডেটেড ভার্সনও এসেছে। মূলত মানসম্মত কনটেন্টের সার্চ রেজাল্টকে উন্নত করা আর নিম্নমানের বিশেষ করে যারা কপি-পেস্ট করে তাদের সনাক্ত করাই এই গুগল পান্ডার কাজ।

কেবল তাই নয়, কনটেন্টগুলো সনাক্ত করে তা সার্চ ইঞ্জিন থেকে হটিয়ে দিতেও গুগল পান্ডা ভূমিকা রাখে। কেউ যদি আপনার কনটেন্ট নিয়ে নিজের ওয়েব সাইটকে উচ্চতর র্যাংকিংয়ের ধান্ধায় থাকে গুগল তাকে ধরে ফেলে আর কপিরাইট লঙ্ঘণকারী হিসেবে চিহ্নিত করে।
বিশেষজ্ঞরা ওয়েব কনটেন্টের কপিরাইট সংরক্ষণের জন্য কয়েকটি প্রধান পথ বাতলে দিয়েছেন।

এক. প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা

আপনার কনটেন্ট চুরি প্রতিরোধে কিছু সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা আগে থেকেই নেওয়া সম্ভব। এতে চোররাও মনে করবে আপনি নিজের কপিরাইটের বিষয়ে যথেষ্ট সতর্ক এবং ধরে ফেলতে পারেন। এ জন্য আপনাকে তিনটি কাজ করতে হবে-

ক.  ডিএমসিএ বা ডিজিটাল মিলেনিয়াম কপিরাইট অ্যাক্ট’র আওতায় আপনার ওয়েবসাইটটি নিবন্ধিত করে নিন। আর তাদের একটি ব্যাজ আপনার সাইটে রাখুন। এতে সম্ভাব্য কপিরাইট লঙ্ঘণকারীরা জানবে আপনি আপনার কনটেন্টের অধিকার সংরক্ষণ করছেন।

খ. ওয়েব সাইটে কপিরাইটের একটি নোটিশ ঝুলিয়ে দিন। এতে স্পষ্ট হবে আপনি কনটেন্টের কপিরাইটের আইনগত দিকটিতে সতর্ক। ফলে কনটেন্ট চোররা ভয় পাবে। আর জানতেও পারবে আপনার সাইটের কনটেন্ট কপি করা অবৈধ একটি কাজ। ‘ডু নট কপি’ লেখা একটি ব্যাজও ঝুলিয়ে রাখতে পারেন সাইটে।

গ. আপনার কনটেন্ট যে আপনারই তা প্রমাণ করতে ড্রাফটগুলো কম্পিউটারে সেভ করে রাখুন যাতে প্রয়োজন হলে তা উপস্থাপন করা সম্ভব হয়।

দুই. নকল কনটেন্ট সনাক্তকরণ ও পর্যবেক্ষণ টুলস ব্যবহার

কপিরাইট লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে লড়তে ইন্টারনেটেই মিলবে অনেক ব্যবস্থা। এখানে কয়েকটি টুলসের কথা তুলে ধরছি।

ক) গুগল সার্চ ব্যবহার করুন। আপনার কনটেন্টের যেকোনও বিশেষ অংশ লিখে সার্চ দিন। কোটেশন মার্কগুলো ব্যবহার করুন, তাতে সার্চ থেকে সুনির্দিষ্ট করে তথ্য পাওয়া যাবে।

খ) আরেকটি পথেও কাজটি করা যায়, তাতে সময়ও বাঁচে। সেটি হচ্ছে কম্পিউটারে ‘গুগল অ্যালার্ট’ সেট করে রাখা। এতে যে কোনও সময় সার্চের আওতায় রাখা শব্দ বা বাক্যগুলো কোথাও কপি পেস্ট হলে সঙ্গে সঙ্গে তা আপনার ই-মেইলে চলে আসবে।

গ) চৌর্যবৃত্তি ধরে ফেলার মনিটরিংয়ে দুটি টুলসের নাম প্লাগিয়াম ও প্লাগিয়ারিজমা। এর মাধ্যমে কোনও সাইটে আপনার কনটেন্ট প্রকাশিত হলে আপনি ওই সাইটের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারবেন কিংবা ব্যবস্থা নিতে পারবেন।

ঘ) আপনার সাইটে ‘কপিগেটর’ সার্ভিসটি যোগ করে নিতে পারেন। এটি আপনার সাইট ফ্রি মনিটর করবে আর যখনই ইন্টারনেটে একই ধরনের কনটেন্ট পাবে তথ্য দেবে। এই সার্ভিসটি নকল কনটেন্টকে দুই ভাবে সনাক্ত করে একটি ‘হুবহু’ আরেকটি ‘কাছাকাছি’। এতে কনটেন্ট যারা হুবহু কপি করেন তারা তো ধরা পড়েনই একই সঙ্গে যারা কপি করে কিছুটা এদিক সেদিক করে তা ব্যবহার করছেন তারাও রেহাই পান না।

ঙ) কখনো কখনো আমরা নিজেরাও ভুল করে নকল করে ফেলি। এর থেকে মুক্ত থাকতে নিজেকেও সতর্ক হতে হবে। সে জন্য কপিগেটরের মতো প্ল্যাগস্পটার নামে আরেকটি সার্ভিস রয়েছে। এটি আপনার নিজের ওয়েব সাইটের কনটেন্টের ওপর নজরদারি করবে। ব্যাচ সার্চ ফিচার টুল ব্যবহার করে এ পদ্ধতিতে আপনি জানতে পারবেন ভুল করে হলেও আপনার নিজের সাইটে অন্যের কনটেন্ট ঢুকে পড়েছে কিনা। এই প্রোগ্রামটি আপনার পোস্ট কিংবা ওয়েবসাইটে নকল কনটেন্ট কত ভাগ তা নির্দেশ করবে। এতে চোর ধরতে গিয়ে আপনি নিজেই যাতে চোর বনে না যান, সেটা নিশ্চিত হবে।

ধরে ফেলাই শেষ কথা নয়, কনটেন্ট চোরদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণও জরুরি। আপনি যখন নিশ্চিত হয়ে যাবেন কেউ আপনার কনটেন্ট চুরি করে ব্যবহার করেছে, তখন পরিস্থিতি বুঝে আপনাকে কয়েকটি পদক্ষেপ নিতে হবে। এখানে কিছু নির্দেশিকা রয়েছে সে জন্য।
এক. যতটা বেশি সম্ভব তথ্য সংগ্রহ করে নিন, যাতে নকল হওয়ার বিষয়টি প্রমাণ করা সহজ হয়। সম্ভব হলে সকল নকল কনটেন্টের স্ক্রিনশট রাখুন।

দুই. কপিরাইট লঙ্ঘণকারীর সঙ্গে যোগাযোগের তথ্য যোগাড় করে ফেলুন। তথ্য না পাওয়া গেলে তাদের ডোমেইন নেম ধরে ওয়েবমাস্টারের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। এবার ভদ্রোচিত ভাষায় একটি চিঠিতে তাদের জানিয়ে দিন তাদের সাইটে আপনার কনটেন্ট ব্যবহার করা হয়েছে বিনা অনুমতিতে। তাদের বলুন নকলকৃত কনটেন্ট যেনো মুছে ফেলা হয়। এই চিঠিতে আপনার কাছে কনটেন্ট নকলের যেসব তথ্য রয়েছে তার সবগুলোই উল্লেখ করুন ও প্রমাণ দিন। এই প্রথম ই-মেইলটি পেলে অধিকাশ নকলকারীই তাদের চুরি করা কনটেন্ট মুছে ফেলেন।

তিন. ‘হুইজ’ (Whois) সার্ভিসটি ব্যবহার করে ওয়েবসাইটের মালিকের বৈধ নাম ও ফোন নম্বর পাওয়া সম্ভব। হুইজের সার্চ বক্সে ডোমেইন নামটি বসিয়ে সার্চ দিলে তাদের সব তথ্যই বের হয়ে আসবে। এখান থেকেই আপনি তাদের সঙ্গে অত্যন্ত আন্তরিক ভঙ্গিমায় যোগাযোগ করতে পারেন। আর কনটেন্ট সরিয়ে নেওয়ার অনুরোধ করতে পারেন।

চার. অপরাধীর সঙ্গে আপনার এই আলোচনা যদি ফলপ্রসূ না হয়, তাদের ওয়েবসাইট হোস্টিং কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। এটাও হুইজ সার্ভিস থেকে জানা যাবে। এবার হোস্টিং কোম্পানির কাছে বিষয়টি জানান। তারা যদি জানতে পারে তাদের হোস্ট করা একটি সাইট কনটেন্ট চুরি করছে তারা সেগুলো সরিয়ে দেবে। এমনকি তারা এ ধরনের সাইটকে তাদের ক্লায়েন্ট তালিকা থেকে বাদ দিয়েও দিতে পারে।

পাঁচ. এতেও যদি আপনি কোনও ফল না পান, কপিরাইট লঙ্ঘনকারীকে একটি আনুষ্ঠানিক ‘সিজ অ্যান্ড ডেসিস্ট’ (ক্ষান্ত হও, নিবৃত থাকো) পত্র পাঠান। এর মাধ্যমে আপনি তাদের জোর দিয়ে এটাও বলতে পারবেন, তারা যেনো এরই মধ্যে যেসব কনটেন্ট চুরি করে ব্যবহার করেছে সেগুলো সরিয়ে দেয়, নয়তো তাদের আইনি ব্যবস্থার মুখোমুখি হতে হবে। অনলাইনেই এই ‘সিজ অ্যান্ড ডেসিস্ট’ পত্রের অনেক স্যাম্পল পাওয়া যায় যা দেখে আপনি এমন একটি চিঠি তৈরি করতে পারবেন।

ছয়. ডিএমসিএ’র ৫১২ নং ধারার আওতায় আপনি ‘নোটিস অ্যান্ড টেক ডাউন’ (জানাও এবং সরিয়ে ফেলো) সুবিধাটি পাবেন। এতে কনটেন্টের কপিরাইট হোল্ডার তার কনটেন্ট চুরি হলে সনাক্ত করার পাশাপাশি তা যেখানে ব্যবহার হয়েছে সেখানে কারো প্রবেশাধিকার বন্ধ করে দিতে পারে।

সাত. গুগলের কাছে কপিরাইট লঙ্ঘনের একটি অভিযোগ ঠুকে দিন। গুগলও নকল হওয়া কনটেন্ট হয় সরিয়ে দিতে পারে নয়তো তা অকেজো করে দিতে পারে। এমনকি এ ধরনের অপরাধীকে সাবস্ক্রাইবারের তালিকা থেকে বাদ দিতেও পারে গুগল। এক্ষেত্রে ডিজিটাল মিলেনিয়াম কপিরাইট অ্যাক্টের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করতে পারে গুগল ।

আট. আর সবশেষে আইনি ব্যবস্থা। উপরের কোনও উদ্যোগই ফলপ্রসূ না হলে আইনের আশ্রয় নিলে চৌর্যবৃত্তি যারা করছেন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব।

বাংলাদেশ সময় ১৫২০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৪, ২০১৭
এমএমকে
 

 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।