ঢাকা, শনিবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

ভারত

ফল যাই হোক, সরকার গঠনের ভিত্তি নন্দীগ্রাম

ভাস্কর সরদার, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৪৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ৪, ২০২১
ফল যাই হোক, সরকার গঠনের ভিত্তি নন্দীগ্রাম

কলকাতা: পশ্চিমবঙ্গে প্রথম দফার ভোট শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হলেও, ১ এপ্রিল একাধিক অশান্তির মধ্যদিয়ে শেষ হয়েছে দ্বিতীয় দফার ভোটগ্রহণ।

আগামী ৬ এপ্রিল তৃতীয় দফার নির্বাচন।

তবে দ্বিতীয় দফায় নন্দীগ্রামে মমতা-শুভেন্দু দৌরথের পর, রাজ্যের বাকি দফার ভোট অনেকটা ফিকে হয়ে আসছে। ভোটের সেই টানটান উত্তেজনা কিছুটা হলেও মলিন। রসিকতার সুরে রাজ্যবাসীর অনেকের মত—জলসায় যেমন তারকা শিল্পীরা শেষে ওঠেন, নন্দীগ্রামের ভোটটা তেমন পরে হলেই ভালো হতো!

তবে নন্দীগ্রামে সেদিনের ভোট শুধু দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে হয়নি। জোর টক্কর হয়েছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বনাম বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারীর। বলা যায়, ভোট হয়েছিল দলনেত্রী বনাম দলত্যাগীর মধ্যে। তবে ভোটের ফল যাই হোক না কেন, যে প্রার্থী হারবে তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার অনেটাই ব্যাকফুটে চলে যাবে বলে মনে করছেন ভোট বিশ্লেষকমহল।

ধরা যাক, এমনটা হলো গোটা বাংলায় তৃণমূল কংগ্রেস জোড়াফুল ফোটাতে সক্ষম হলো, কিন্তু নন্দীগ্রামে মমতা ফেল করলেন। তবে তখনও কি দলের মধ্যে সেই গ্রহণযোগ্যতা থাকবে তার? রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মত, মমতার গ্রহণযোগ্যতা অনেকটাই খর্ব হতে পারে। যদিও তৃণমূলের দাবি এসব সমীকরণ মিলবে না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই নন্দীগ্রাম থেকে কমপক্ষে ৩৫ হাজার ভোটে জিতবেন।

এখানেই প্রশ্ন বিজেপির। তাহলে নন্দীগ্রামে ৮০ শতাংশ জাল ভোট পড়েছে বলে কেন দাবি করছেন মমতা। কেন দাবি করছেন তাদের সমর্থকরা ভোট দিতে পারেননি। যদিও নন্দীগ্রামে ভোটের পর মমতা নির্বাচন কমিশনকে ৬৩টি অভিযোগসহ হাতে লেখা একটি চিঠি দিয়েছিলেন। তাতে তিনি বলেছিলেন, কেন্দ্রীয় বাহিনীর সহযোগিতায় বিজেপি ভোট করেছে। আর তার উত্তরে রোববার (৪ এপ্রিল) নির্বাচন কমিশন স্পষ্টতই জানিয়ে দিয়েছে, অভিযোগ ভিত্তিহীন।

কারণ নন্দীগ্রামে ৩৫৫টি বুথে সিসিটিভির ফুটেজে এমন কোনো ঘটনার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এমনকি ভারতের সংবাদমাধ্যমও এমন কোনো ফুটেজ দেখাতে পারেনি। ফলে বুথ দখল বা কেন্দ্রীয় বাহিনীর সহযোগিতায় জাল ভোটের তথ্য ভিত্তিহীন বলে মনে করছে কমিশন। ফলে নির্বাচন কমিশনের উত্তর মমতার কাছে বড় ধাক্কা বলে মনে করছেন অনেকে।

অপরদিকে বিজপির অন্দরে শোনা যাচ্ছে বাংলাজুড়ে পদ্ম ফুটলে নন্দীগ্রামের প্রার্থী শুভেন্দু অধিকারী হবেন রাজ্যের উপমুখ্যমন্ত্রী। এমনকি তিনিই মুখ্যমন্ত্রীর অন্যতম দাবিদার বলেও কানাঘুষো চলছে। কিন্তু বিজেপি বাংলা দখল করলো অথচ শুভেন্দুই হেরে গেলেন মমতার কাছে, তাহলে? বিশ্লেষকদের মতে গ্রহণযোগ্যতা দূরের কথা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মন থেকে মুছেই যাবে শুভেন্দু। ‘ওয়াশ আউট’ হয়ে যেতে পারে তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার।

আবার নাও হতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে। রাজ্যে কোনো বড় পদ না পেলেও, ভোটের মুখে শুভেন্দু-হাওয়া পশ্চিমবঙ্গে অনেকটাই প্রাণ পেয়েছে বিজেপি। ফলে এত তাড়াতাড়ি দল থেকে ব্রাত্য হবেন না তিনি। অনেকটা দলের নির্বাচনী পর্যবেক্ষক মুকুল রায় বা রাজ্য সভাপতি দিলিপ ঘোষের মতো হয়ে যেতে পারে তার ক্যারিয়ার। এ দুই বাঙালি নেতা বিজেপির জন্য এত কিছু করলেও কোনোকালেই রাজ্যভার তাদের ওপর দেবেন না কেন্দ্রীয় নেতারা। বাঙালি হিসেবে ব্যতিক্রমী কাজটা করে দেখাতে পারেন শুভেন্দু। অবশ্য যদি তিনি জেতেন। তবে তার দলের দাবি কম করে হলেও ১ লাখ ভোটে জিতবেন শুভেন্দু অধিকারী।

তবে নির্বাচন কমিশনের কথা মতো নন্দীগ্রামে ভোটের দিন বুথ দখল না হলেও একাধিক জায়গায় চরম সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিল দুই দল। তা অস্বীকার করার কোনো জায়গাই নেই কমিশনের। স্পষ্ট করে বললে, বাংলার নিরিখে দিনটি মোটেও সুখকর ছিল না। ভোটের লড়াইয়ের পিছনে এক বিভাজনের রাজনীতির মুখোমুখি হয়েছিল নন্দীগ্রাম। যদিও তেমন একটা অশান্তি ছড়াতে পারেনি কেন্দ্রীয় বাহিনীর বদান্যতায়।

তবে ভোটের দিনে সংঘর্ষের জন্য দুই নেতাকেই দায়ী করেছেন নন্দীগ্রামবাসী। দুই নেতাই প্রচারকালে একবারে জন্য বলেননি, অপ্রীতিকর কিছু ঘটলে প্রশাসনকে জানান। বাড়তি কেন্দ্রীয় বাহিনী আছে তাদের সহযোগিতা নিন। ফলে ফল যাওয়ার হয়েছিল। তবে এবারের নির্বাচনের এখনও অবধি সাধুবাদ দিতে হয় নির্বাচন কমিশনকে। যে উত্তেজনার মধ্য দিয়ে ভোট চলছে তাতে মৃত ও আহতের সংখ্যা, করোনা সংক্রমণের সংখ্যাকেও হার মানাতে পারতো। কিন্তু এখন অবধি তা হয়নি কমিশন ও কেন্দ্রীয় বাহিনী এবং পুলিশের সৌজন্যে। তবে দুই দফা ভোটের আগের দিন মৃত্যু হয়েছে তৃণমূল-বিজেপি-সংযুক্ত মোর্চা কর্মীর। সঠিক তথ্য এখন অবধি না পাওয়া গেলেও সংখ্যাটা পাঁচের কাছাকাছি।

তবে এত কিছুর মধ্যে নন্দীগ্রামে ভোট পড়েছে ৮৮ শতাংশ। এ ভোট মমতার পক্ষে নাকি মোদীর পক্ষে তা জানা যাবে ভোট গণনার দিন। তবে বিজেপি যদি রাজ্যে পদ্ম ফোটাতে সক্ষম হয় তাহলে সেই বন্দোবস্ত করে দিয়েছে তৃণমূল। আর সেই জমি কিছুটা হলেও উর্বর করতে সহযোগিতা করেছে বামেরাও। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। ৩৪ বছরের বাম আমলে একটি গ্রাম যেমন বিজেপি দখল করতে পারেনি। তেমন এবারের ভোটে আব্বাস সিদ্দিকির সহযোগিতায় তৃণমূলের সংখ্যালঘু ভোটে চির ধরিয়েছে বামেরা।

তবুও ধারণা করা হচ্ছে নন্দীগ্রামে প্রায় ৭০ হাজার মুসলিম ভোটের মধ্যে ১২ থেকে ১৫ হাজার ভোট শুভেন্দুর ঝুলিতে যেতে পারে। কারণ তার জনপ্রিয়তা। ফলে সংখ্যালঘু মুসলিম ভোটই যে এবার বড় ফ্যাক্টর, তা কিন্তু নয়। আসলে রাজ্যবাসীর মধ্যে একটা ট্রেন্ড লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আর হলো—৩৪ বছর বামেদের দেখলাম, দিদিকে দিলাম ১০ বছর। একটাবার দেখি না কী হয়! আমরাই তো জনতা। সরকারের মেয়াদ তো মাত্র ৫ বছর!

তবে সব সমীকরণই সম্ভাব্য। এবারের ভোট এক অন্যমাত্রায় পৌঁছে গেছে। ফলে কোনো আন্দাজই নাও মিলতে পারে। তবে এ কথা ঠিক আগামী দিনে যে দলই রাজ্যে সরকার গঠন করুক তা নির্ভর করবে নন্দীগ্রামের ওপর ভিত্তি করে।

বাংলাদেশ সময়: ১৭৪১ ঘণ্টা, এপ্রিল ০১, ২০২১
ভিএস/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।