ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫

ভারত

কলকাতার চা ওয়ালা ও তাদের ঐতিহ্য (ভিডিও)

ভাস্কর সরদার, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৪৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৮, ২০২১
কলকাতার চা ওয়ালা ও তাদের ঐতিহ্য (ভিডিও)

কলকাতা: ‘এক কাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই’, কবীর সুমনের একটি গানের লাইন। বাঙালির প্রিয় পানীয় চাকে অবলম্বন করে প্রেমিকাকে পাওয়ার আকুতি তিনি মেলে ধরেছেন গানে।

এক কাপ উষ্ণ চা ছাড়া দিনের সূচনা যেমন ভাবা যায় না তেমনি অতিথি আপ্যায়নে চায়ের জুড়ি মেলা ভার। তবে শীতে চা শুধু উষ্ণ নয়, হতে হবে উত্তম এবং তা পরিবেশিত হতে হবে মাটির ভাড়ে। বাসার অন্দরে কাপে চা চললেও বাইরে, মাটির ভাড় ছাড়া রোচে না। এমনটাই কলকাতার রীতি।

কারও পছন্দ আদা-চা, আবার কারও দুধ চা। পশ্চিমবঙ্গ বাদে ভারতে মশলা চা বা তন্দুরী চায়ের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। অর্থাৎ দেশ এবং অঞ্চল অনুযায়ী চায়ের স্বাদ হয় ভিন্ন। পরিবেশানাতেও থাকে ভিন্নতা। তবে যাই হোক উত্তম চায়ের কাপে চুমুকের মজাই আলাদা। কলকাতায় এরকম চায়ের বেশ কয়েকটি দোকান আছে। যেসব দোকানের চা-ওয়ালারা, তাদের তৈরি চায়ের দ্বারাই মানুষকে আকর্ষণ করছেন যুগ যুগ ধরে।

১৫০ বছরের হরেন্দ্রনাথ দত্তর চায়ের দোকান
উত্তর কলকাতার অতিপরিচিত হরেন্দ্রনাথ দত্তর চায়ের দোকান। বাগবাজার স্ট্রিটে, গিরিশ মঞ্চর ঠিক বিপরীতে ১৫০ বছরেরও বেশি পুরাতন এই দোকান। লোকে চেনে হরেন দার দোকান নামে। হরেনদা এখন প্রয়াত। বর্তমানে দোকান চালায় নাট্যপ্রেমী দুই মেয়ে। ছোট্ট, এক চিলতে দোকান ঘিরে থাকে আড্ডার আবহ। এই দোকানে চা খেতে যেমন ভিড়, তেমনই জমে আড্ডা। বাবার পেশায় ইন্দ্রানী দত্ত স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করলেও নেশা কিন্তু নাটক করা।

তার কথায়, ‘এখানে প্রথম থেকেই তিন ধরনের চায়ের চল। গরুর দুধের চা, মাখন চা এবং লেবু চা। লিকার চাও আছে। তবে সবচেয়ে জনপ্রিয় লেবু চা। জানেন, আমাদের লেবুর চায়ের কথা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা ম্যাগাজিনেও ছাপানো হয়েছে। তখন অবশ্য বাবা বেঁচেছিলেন। ’

এখানে চা পরিবেশন করা হয় মাটির ভাড়ে। নাট্যব্যক্তি থেকে নাট্যপ্রেমী, পথচলতি মানুষের আড্ডাস্থান এটাকে বলা যায়।

৪২ বছরের হরি দার চায়ের দোকান 
বয়সের ভারে না হলেও কলকাতার অন্যতম স্পট হিসেবে জনপ্রিয় দক্ষিণ কলকাতায় রবীন্দ্রসদনের বাইরে অর্থাৎ ছাতিম তলায় হরি দার চায়ের দোকান। রবীন্দ্রসদনে অনুষ্ঠানে এসেছেন বা নন্দনে সিনেমা অথবা একাডেমি নাটক দেখেছেন কিংবা নিছক আড্ডার জন্য এসছেন, সে ব্যক্তি ৪২ বছরের বেশি পুরানো হরিদার চায়ে চুমুক দেননি, তা হয়নি। পাশাপাশি আরও দুই একটা চায়ের দোকান থাকলেও হরিদার বিশেষত্ব হলো সবার কথা মাথায় রেখে ফ্ল্যাক্সে চা রেডি রাখেন। তিন ধরনের লিকার চা এবং তিন ধরনের দুধ চা, চাওয়া মাত্রই মাটির ভাড়ে পরিবেশন করে ফেলেন।

৯৮ বছরের জুহুরি সিঙের চায়ের দোকান
মধ্য কলকাতার এসপ্ল্যানেড থেকে লালবাজার থানার দিকে এগোলে পড়ে আলিয়া হোটেলের ঠিক বিপরীত ফুটপাতে চোখে পড়বেই ৯৮ বছরের পুরানো জুহুরি সিঙের চায়ের দোকান। পথেই নজরে পড়বে দোকানে রাখা বিশ লিটারের ফুটন্ত তামার পানির ড্রাম। সেই ফুটন্ত পানিতেই মিশছে মোষের দুধ, এলাচগুড়ো, চা, চিনি ইত্যাদি। ভোর ৫টা থেকে রাত ১১টা পথচলতি মানুষ চা পাবেন এখানে।  

রাত বেশি হলেও ক্লান্তি নেই দোকানকর্মী মহেন্দ্র যাদবের। তার কথায়, ১৯২০ সালে এই ড্রাম কিনেছিলেন মালিক তথা উত্তরপ্রদেশের বাসিন্দা জুহুরি সিং। সেই থেকে আজ পর্যন্ত এতেই চায়ের পানি ফোটানো হয়। আমার এখানে ভিড় লেগে থাকার কারণ যাদের গ্যাস অম্বলের জন্য দুধ চা খেতে পারেন না। তারও খান এখানে। আর এর কারণ এই পুরানো তামার ড্রামের পানি।  এখানেও চা পরিবেশন করা হয় মাটির ভাড়ে।

১০০ বছরের বলবন্ত সিং ধাবা 
দক্ষিণ কলকাতার অতিজনপ্রিয় এই ধাবা, হরিশ মুখার্জি রোড, পিজি হাসপাতালের বিপরীতে পাঞ্জাবিদের ধর্মস্থান ‘গুরুদ্বোয়ার’ লাগোয়া। ১০০ বছরের পাঞ্জাবি এই ধাবা আদতে খাবারের হোটেল। তবে চায়ের জন্যই সবচেয়ে জনপ্রিয়। ২০ রুপি থেকে ২শ রুপির চা মেলে। কেশর চাসহ একাধিক ফ্লেভারে চা পাওয়া যায় এখানে। সকাল, সন্ধ্যা, রাত সব সময় এখানে ভিড় লেগে থাকে চা প্রেমী মানুষদের। বলা হয়, রাত দুটো থেকে ভোর চারটে, মাত্র দুঘণ্টার জন্য চুলার আঁচ কমানো থাকে।

অমিতাভ বচ্চনের কলকাতায় শ্যুটিং থাকলে, তাঁর সকালের স্যান্ডউইচ, চা যায় এখান থেকেই। গোবিন্দা, পরেশ রাওয়াল, বিদ্যা বালান, এমনকী ক্রিকেটার মহেন্দ্র সিং ধোনি, গৌতম গম্ভীর, উমেশ যাদব থেকে নামীদামী শিল্পপতি, ব্যবসায়ীসহ বহু মানুষই পছন্দ করেন এখানকার চা। এমনকী মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে কোনো অতিথি এলে বা মিটিং হলে চা যায় বলবন্ত সিঙের দোকান থেকেই।

ধাবার ম্যানেজারের কথায় এখানের চায়ের বিশেষত্ব হলো কলকাতার নামী হোটেলের শেফ থেকে ড্রাইভাররা সকলেই জানেন। এখানে চা সরাসরি চুলায় বানানো হয় না। চুলার উপর থাকে দু-ফুট বাই দু-ফুট একটা বড় পাতিল। সেই পাতিলের ফুটন্ত পানির উপর বসানো থাকে, চার-পাঁচটা সাড়ে তিন লিটারের বড় চায়ের মগ। তাতেই দেওয়া হয় চায়ের সরঞ্জাম। পাতিলের ফুটন্ত পানিতেই তৈরি হয় ‘স্টিম টি’। এরপর হয় সেই চা ভালো করে ফেটিয়ে ভাড়ে পরিবেশন করা হয়। ভারতে আমরাই প্রথম এভাবে চা শুরু করি।

একবার ইডেনে খেলতে এসে ক্রিকেটার মহেন্দ্র সিং ধোনি চা খেয়ে, ফ্লাস্ক চেয়েছিল কলকাতায় শ্বশুরবাড়িতে নিয়ে যাবেন বলে। ফ্লাস্ক ভর্তি চা নিয়ে গিয়েছিলেন ধোনি। পরে অবশ্য সেই ফ্লাস্ক ফেরত পাঠিয়েও দিয়েছিলেন। এরপর কলকাতায় এলে এখানে চা খেতে আসেন গোপনে।

৯১ বছরের রাধুবাবুর চায়ের দোকান
দক্ষিণ কলকাতার লেক মার্কেটে পরিচিত লেকমলের গলিতে ৯১ বছরের পুরানো জনপ্রিয় চায়ের দোকান। এখানের বিশেষত্ব হলো দার্জিলিং টি এবং আসাম টি মিলিয়ে প্রথম থেকেই চা তৈরির চল চলে আসছে। তবে এ দোকানে প্রকাশ্যে চা বানানো হয় না। এছাড়া এখানে মাটির ভাড় নয়, দোকানের ঐতিহ্য অনুযায়ী কাপ প্লেটে চা পরিবেশ করা হয়। অবশ্য করোনার জন্য ওয়ানটাইম কাপ ব্যবহার করা হচ্ছে।  

প্রয়াত রাধুবাবুর ভাইপো সোমনাথ দত্তর কথায়, বাংলা বিনোদন জগতে চলাচল আছে অথচ এই দোকানের চা খাননি এমন মানুষ নেই। উত্তমকুমার, সুচিত্র সেন, সুপ্রয়াদেবী, বসন্ত চৌধুরী, কাননদেবী, সলিল চৌধুরী, শ্যামল মিত্র, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, হেমন্ত সকলে এমনকী বলিউড অভিনেতা রাজ কাপুর, রুশি মোদীরাও চা খেতে পা রেখেছেন এই দোকানে। এখনও আসেন অনেকে।

তবে এসব দোকান অতিকায় বা লাক্সারি নয়। একেবারে সাধারণ মানের। তাই সকলের আয়ত্তে। তবে তারকাদের জন্য এসব চায়ের দোকনের পরিচিতি বেড়েছে তা একদমই নয়। বরং চায়ের কারিশমা ভিআইপিদের দোকানের দোরগোড়ায় আসতে বাধ্য করেছে।

এরকম আরও চায়ের দোকান আছে কলকাতাজুড়ে। চায়ের উনুন বা চুলা সর্বদা জ্বলছে শহরময়। তবে বাংলাদেশের মতো বসে চা খাওয়ার খুব কম ব্যবস্থা থাকে দোকানগুলোয়। বেশীরভাগ দোকানের সামনে রয়েছে নড়বড়ে বেঞ্চ আর অন্তত একটি বা দুটি খবরের কাগজ। যার এক একটা পাতা এক একজনের হাতে। হাতাহাতিতে নেতিয়ে পড়ে সেই সব কাগজের পাতা। তবু নিস্তার নেই। রাজনৈতিক মতভেদ, রাম রহিমের তর্জা, সংলাপ, দেশের হাল থেকে করোনা ভ্যাকসিন সব তথ্যই মিলবে কলকাতার চায়ের দোকানে কান পাতলে।
 

বাংলাদেশসময়: ০৯৪২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৮, ২০২১
ভিএস/এইচএডি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।