ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

আগরতলা

ত্রিপুরায় দুই যুবকের পুকুরে মুক্তা চাষ

সুদীপ চন্দ্র নাথ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২০৩ ঘণ্টা, জুন ১৭, ২০২০
ত্রিপুরায় দুই যুবকের পুকুরে মুক্তা চাষ ত্রিপুরায় দুই যুবকের মুক্তা চাষ

আগরতলা (ত্রিপুরা): ত্রিপুরার দুই যুবকের অদম্য ইচ্ছা ও আগ্রহে পুকুরের পানিতে ফলছে মুক্তা। তাও সরকারি কোন সহযোগিতা ছাড়াই। এই দুই যুবক হলেন সিপাহীজলা জেলার অন্তর্গত বিশালগড়ের চিত্তরঞ্জন দত্ত (৩১) এবং অরূপ সরকার (৩৯)।

এই দুই মুক্তাচাষির প্রথম সন্ধান পায় বাংলানিউজ। এ বিষয় নিয়ে তারা প্রথমবারের মতো সংবাদমাধ্যমে কথা বলছেন বলেও জানান বাংলানিউজকে।

আমরা সকলে জানি সমুদ্রের নোনা পানিতে যেসকল ঝিনুক বাস করে এই ঝিনুকের মধ্যেই মুক্তা পাওয়া যায়। প্রাকৃতিকভাবে সামুদ্রিক ঝিনুকের মধ্যে মুক্তা তৈরি হয়। তবে পরবর্তীতে সমুদ্রের তটবর্তী এলাকায় কেইস কালচারের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মুক্তা চাষ করা হয়। বর্তমানে সমুদ্রের নোনা পানি ছাড়াও পুকুরেও মিঠা পানিতে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন করে মুক্তা চাষ করা হচ্ছে।

ঝিনুকের খোলসে ডিজাইনার মুক্তা

বিশালগড় এলাকায় দুজনে পুকুরের মধ্যে মুক্তা চাষ করছেন। সবাই যেখানে পুকুরের মিঠাপানিতে নানা জাতের মাছ, কাঁকড়াসহ অন্যান্য জলজ প্রাণী চাষ করে, সেখানে হঠাৎ করে মুক্তা চাষের ইচ্ছে হলো কী করে? এছাড়া উত্তর-পূর্ব ভারতের আর কোন রাজ্যে মুক্তা চাষ হচ্ছে বলে জানা যায়নি। রীতিমত এক চ্যালেঞ্জিং কাজ।

এর উত্তরে চিত্তরঞ্জন দত্ত বাংলানিউজকে জানান, গত বছরের ডিসেম্বর মাস নাগাদ মোবাইল ঘাটতে ঘাটতে হঠাৎ তিনি একটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মুক্তা চাষের বিষয় সংক্রান্ত একটি ভিডিও দেখতে পান। ভিডিওটিতে দেখানো হয়, কী করে মিঠা পানিতে মুক্তা চাষ করা সম্ভব। ভিডিওটি ভালো করে দেখার পর তার আগ্রহ জন্মে মুক্তা চাষের প্রতি। তখন তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেওয়া ফোন নাম্বারে যোগাযোগ করেন এবং এ বছরের জানুয়ারি মাসে তিনি পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব মেদিনীপুরের মেছেদা এলাকায় হাতে কলমে মুক্তা চাষের প্রশিক্ষণ নিতে চলে যান। সেখানে তিনি ৫ দিনের প্রশিক্ষণ নেন মিঠা পানিতে মুক্তা চাষের বিষয়ে। প্রশিক্ষণ বাবদ তার কাছ থেকে সংস্থাটি ৮ হাজার রুপি নেয় বলে জানান তিনি।

প্রশিক্ষণ শেষে রাজ্যে ফিরে এসে অরূপ সরকারের সঙ্গে যৌথভাবে তিনি মুক্তা চাষ শুরু করেন। প্রাথমিকভাবে ১৩ কাঠা জায়গা জুড়ে থাকা একটি পুকুরে মুক্তা চাষ শুরু করেন তারা।

এবছরের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রথম ধাপের ঝিনুক মুক্তা চাষের জন্য পুকুরের পানিতে দেন তারা।

পুকুরে মুক্তা চাষ

চাষের জন্য কি আলাদা বিশেষ কোন প্রজাতির ঝিনুকের প্রয়োজন হয়? পুকুরে যে সকল বস্তু পাওয়া যায় তাতে এই ঝিনুক থেকে মুক্তা পাওয়া কি সম্ভব? তিনি জানান, পুকুরে যে সকল ঝিনুক পাওয়া যায় এগুলির ভিতর মুক্তা চাষ করা সম্ভব। তবে মুক্তা চাষের জন্য ঝিনুকের মধ্যে বিশেষ কিছু কাজ করতে হয়। একটি ঝিনুকের দুপাশে দুটি খোলস থাকে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষ করলে দুটি খোলসে দুটি মুক্তা পাওয়া যায়। প্রথম পর্যায়ে যে মুক্তাগুলি তারা পুকুরে ছেড়েছেন এগুলি থেকে প্রায় ১৩ মাস পর পূর্ণাঙ্গ মুক্তা পাওয়া সম্ভব বলেও জানান।

মূলত দু'ধরনের মুক্তা চাষ করা সম্ভব হয় ঝিনুকের পেটের ভিতর। এক ধরনের মুখটা হলো গোলাকার যেগুলো সাধারণত আংটি মালাসহ গহনা তৈরির কাজে ব্যবহৃত হয়। আবার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষ করলে ডিজাইনার মুক্তা পাওয়া সম্ভব। এটা নির্ভর করে চাষীর উপর তিনি কি ধরনের মুক্তা তৈরি করতে চান ঝিনুকের পেটে। সে অনুসারে তারা ঝিনুকগুলির ভেতরে বিশেষ কাজ করে থাকেন। তারা ডিজাইনার মুক্তা তৈরীর জন্য বর্তমানে ঝিনুক চাষ করছেন, কারণ এ ধরনের মুক্তার চাহিদা খুব বেশি। অপরদিকে গোলাকার মুক্তা উৎপাদনে চীন এবং জাপান বিশ্বের মধ্যে প্রথম স্থান দখল করে আছে। এই দুটি দেশ কোটি কোটি গোলাকার মুক্তা বিশ্বব্যাপী রফতানি করছে।

পুকুরের মধ্যে দড়ি বেঁধে প্লাস্টিকের বোতল দিয়ে এই দড়ি গুলিকে ভাসিয়ে রেখেছেন এবং ভাসানো ওই দড়ি থেকে আরো একটি ছোট দড়ি চলে গিয়েছে পুকুরের পানির ভেতর। এই ছোট দড়ির মধ্যে লাগানো রয়েছে বিশেষ ধরনের নেট। এই নেট গুলির মধ্যে কাজ করা ঝিনুক রাখা হয়েছে। এই ঝিনুক গুলির পেটের ভেতর ১২ থেকে ১৩ মাসে পূর্ণাঙ্গ মুক্তা তৈরি হবে। প্রথম পর্যায়ে মুক্তা উৎপাদনের জন্য পুকুরে ১ হাজার ৩টি'র মতো ঝিনুক পানিতে রয়েছে।

এখন পর্যন্ত তাদের খরচ হয়েছে প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার রুপি। তবে এই মুক্তার জন্য আলাদা করে আর খুব একটা খরচ হবে না বলেও জানান তারা। ত্রিপুরা রাজ্যে প্রথম মুক্তা চাষ করছেন সরকারি কোন সহায়তা পেয়েছেন কি? তারা বলেন এখন পর্যন্ত সরকারি কোনো সহায়তা তারা পাননি। তবে ত্রিপুরা সরকারের মৎস্য দফতরের অধিকর্তা ডি কে চাকমা তাদের এই কাজের খুব প্রশংসা করেছেন। সেসঙ্গে তিনি আশ্বাস দিয়েছেন সরকারি কোন সহায়তা করা যায় কিনা এ বিষয়টি তিনি বিবেচনা করে দেখবেন।

ঝিনুকের জন্য কি খাবার দিতে হয়? কি খাবার দেওয়া হচ্ছে ঝিনুকগুলোকে? উত্তরে জানান এক ধরনের শৈবাল খেয়ে ঝিনুক গুলি বেঁচে থাকে। এই শৈবালগুলি পুকুরে এমনিতেই পাওয়া যায় তাই ঝিনুকের জন্য আলাদা করে খাবারের কোন খরচা নেই। এরপর তারা পুকুরে দু-একবার এই শৈবালগুলো এনে ছেড়েছেন বলেও জানান তারা।

ত্রিপুরায় এই প্রথম মুক্তা চাষ করছেন দুই যুবক

ঝিনুকের মধ্যে বিশেষ কাজ করার জন্য যে সামগ্রীগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে এগুলি কি ত্রিপুরায় পাওয়া যায় না অন্য কোথা থেকে আনা হয়েছে? তা জানতে চাইলে তারা জানান মুক্তা চাষের কোন কিছুই ত্রিপুরাতে পাওয়া যায় না। কিছু কিছু সামগ্রী তারা কলকাতা থেকে আনিয়েছেন। বিশেষ ধরনের নেটের ছোট ছোট প্যাকেটের মধ্যে ঝিনুকগুলোকে রাখা। এ নেটগুলো গুজরাট থেকে আনিয়েছেন বলে জানান।

পুকুরে রাখা জিনিসগুলো কি আদৌ মুক্তা তৈরি হচ্ছে এ বিষয়ে তারা কতটুকু নিশ্চিত। তারা জানান, শতভাগ নিশ্চিত মুক্তা তৈরি হচ্ছে। শুধু মুখে বলেই ক্ষান্ত হননি। সঙ্গে সঙ্গে পুকুরের পানিতে নেমে জালের ভিতর থেকে একটি ঝিনুক তুলে আনেন ও ভেঙে দেখান। দেখা যায়, ঝিনুকের দু'পাশের খোলসের মধ্যে দুটি ডিজাইনার মুক্তা ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে। এরমধ্যে একটি মুক্তা গণেশের আকৃতির এবং অন্য মুক্তাটি লাভ চিহ্নের মতো।

সবকিছুর শেষে মুক্তা চাষ করে কত লাভ হতে পারে? তারা বলেন সবকটিতেই  মুক্তা হবে এ বিষয়ে নিশ্চিত। এরপরও যদি ১ হাজার ৩শ'র মধ্যে ১ হাজার ঝিনুকে মুক্তা তৈরি তবে ২ হাজার পিস মুক্তা পাওয়া যাবে। যদি এক এক পিস মুক্তা ৫০০ রুপি করে বিক্রি করা হয় তবে দশ লাখ রুপি আসবে। যদিও ডিজাইনার মুক্তা আরো বেশি দামে বিক্রি হয় বাজারে।

মুক্তা চাষ নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী? যদি সফলভাবে প্রথম পর্যায়ের মুক্তাগুলো বেরিয়ে আসে তবে পরবর্তী ধাপে তারা আরো বেশি পরিমাণ পুকুরে মুক্তা চাষ করবেন। এজন্য ইতোমধ্যে তারা অন্যান্য জায়গা থেকে ঝিনুক সংগ্রহ করে পুকুরে রেখেছেন বলেও জানান।

বাংলাদেশ সময়: ১২০২ ঘণ্টা, জুন ১৭, ২০২০
এসসিএন/এমকেআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।