ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১০ অক্টোবর ২০২৪, ০৬ রবিউস সানি ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

মাণিক্য রাজ্যের নাম কি করে ত্রিপুরা

জাকারিয়া মন্ডল, সিনিয়র আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭১২ ঘণ্টা, অক্টোবর ২, ২০১৬
মাণিক্য রাজ্যের নাম কি করে ত্রিপুরা

আগরতলা (ত্রিপুরা) থেকে ফিরে: এখানে ওখানে অঙ্গ হারিয়েছে বটে, আগরতলার বুকে তবু বিশাল বিস্তৃতি নিয়ে টিকে আছে উজ্জয়ন্ত প্রাসাদ। এখনো গাইছে মাণিক্য রাজবংশের গৌরবময় অতীতের গান।


 
মুঘল স্থাপত্যের অনুকরণে নির্মিত মূল প্রাসাদটিকে জাদুঘর বানানো হয়েছে। দক্ষিণের মূল ফটক আর প্রাসাদের মাঝখানে বিশাল দুই দিঘি। পূর্বেরটা রাজার পুকুর, পশ্চিমেরটা রাণীর। দুই পুকুরের মাঝখান দিয়ে কয়েকশ’ মিটার দীর্ঘ জোড়া রাস্তা। দুই রাস্তার মাঝখানে লম্বাটে চৌবাচ্চার মাথায় ফোয়ারা। পুরো পথই শোভিত হরেক ফুল আর বাহারি লতায়।
 
পুকুরের কোণগুলিতে গম্বুজ আকৃতির অবসর যাপন কক্ষ। দু’টো পুকুরের সবটুকু পাড়ই বাঁধানো হয়েছে ইট-সিমেন্টের কংক্রিটে। আগরতলার অধিকাংশ পুকুরই এভাবে বাঁধানো। আর এখানেই আপত্তি পরিবেশ দপ্তরের। পাড় বাঁধিয়ে মাটি ঢেকে দেওয়ার অর্থ হলো পুকুরের জীববৈচিত্র্যের ওপরে চরম আঘাত হানা। নতুন করে তাই আগরতলার কোনো পুকুরের পাড় বাঁধানো নিষেধ করে দিয়েছেন আদ‍ালত।

জাদুঘরে পরিণত হওয়া মূল প্রাসাদটি থেকে সাদা রঙের দ্যুতি ঠিকরে বেরুলেও পশ্চিমের ভবনটিতে বোধ হয় রঙ চড়েনি কিছুকাল। রাজবংশের উত্তরপুরুষদের বসবাস সেখানে।
 
রাজার দিঘির উত্তর-পূর্ব কোণায় যে ভবনটিতে রাজবাড়ির রসুইঘর ছিলো সেটি এখন টাউন হল। পুকুর আর টাউন হলের মাঝধান দিয়ে একটি রাস্তা চলে গেছে রাজবাড়ির পেছনটায়। তারপর সৈন্য ব্যারাকের পড়ো পড়ো কক্ষসারির পাশ দিয়ে স্বামী বিবেকানন্দ ময়দানের কাছে বেরিয়েছে। ওই ময়দান ঘোড়ার আস্তাবল ছিলো রাজার আমলে। ভরদুপুরে ফুটবল খেলা চলছে সেখানে।
 
প্রাসাদের দক্ষিণে মূল ফটকের এপাশে একদিকে ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী ক্ষুদিরাম, অপরদিকে বিদ্যাগাসর ঈশ্বরচন্দ্রের চকচকে ভাস্কর্য।  
 
তার পশ্চিমে দুর্গাবাড়ি মন্দির। আর সব জায়গায় দশ ভূজা বা দশ হাতের দুর্গার পূজা হলেও এই মন্দিরের দুর্গার কেবল দু’টি হাত দৃশ্যমান।
 
কিংবদন্তি বলছে, পুরাতন আগরতলায় রাজধানী থাকাকালে দু্র্গার দশ হাত দেখে মূর্চ্ছা গিয়েছিলেন মহারাজ কৃষ্ণকিশোর মাণিক্যের প্রধান মহারাণী সুদক্ষিণা দেবী। পরের বছরই দুই হাত প্রসারিত করে গড়া হয় দেবীর নতুন বিগ্রহ। বাকি ৮ হাত বাধা পড়ে পেছনে।

মূল ফটকের পূর্ব দিকে মুঘল স্টাইলে নির্মিত লক্ষ্মী নারায়ণ মন্দির এখনো মহারাজা বীরেন্দ্র কিশোর মানিক্য বাহাদুরের স্মৃতি বইছে। তার পিতা মহারাজা রাধা কিশোর মানিক্য বাহাদুরের স্মৃতির উদ্দেশ্যে ১৯১০ সালে এখানে রাধা বৃন্দাবন চন্দ’র মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। সেই মন্দিরই এখন লক্ষ্মী নারায়ণ মন্দির নামে খ্যাত। ১৪ জন দেব-দেবী’র বিগ্রহ আছে এখানে।
 
বলা হচ্ছে, মহাভারতের সময়কালেই শুরু হয় ত্রিপুরা রাজ্যের ইতিহাস। এর নামকরণ নিয়েও নিয়েও রয়েছে বেশ কিছু মিথ। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ধারণাটি হলো- ভুমি অধিষ্ঠাত্রী দেবী ‘ত্রিপুরা সুন্দরী’র নাম থেকেই ত্রিপুরা নামকরণ।

তবে ৪০০ থেকে ৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে রচিত মহাভারতে ত্রিপুরা নামটি পাওয়া যায়। ওই মহাকাব্যে বর্ণিত মহাপরাক্রমশালী রাজা যযাতির ঔরসে শর্মিষ্ঠার গর্ভজাত পুত্রের নাম ছিল দ্রুহ্য। অবাধ্য পুত্র দ্রুহ্যকে রাজ্য থেকে বিতাড়িত করেন যযাতি। বিতাড়িত পুত্র নির্বাসিত হন গঙ্গা ও সাগরের সঙ্গমস্থল ‘সাগর দ্বীপে’।

রাজা দ্রুহ্যের মৃত্যুর পর তার পুত্র দৈত্যরাজ সিংহাসনে আরোহন করেন। তার পুত্রের নাম ত্রিপুর। এই রাজা ত্রিবেগ থেকে উত্তর পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে কিরাত রাজ্য অধিকার করেন। ত্রিপুর রাজা তার বিজিত রাজ্যের নামকরণ করেন ত্রিপুরা, প্রজাদের নামকরণ করেন ত্রিপুর জাতি।

আরো বলা হচ্ছে, দশমহাবিদ্যারূপী দুর্গার একটি নাম ত্রিপুরাসুন্দরী। সেখান থেকেই এসেছে ত্রিপুরা নামটি।

তবে স্থানীয় ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের ভাষা ককবরক থেকে এই ত্রিপুরা নামটি এসেছে বলেও ধারণা করা হয়ে থাকে। এ ভাষায় পানি বা নদীকে বলা হয় ‘তোয় ব তৈ’। আর মোহনাকে বলে ‘প্রা’। কাজেই তোয় ও প্রা শব্দ’র দু’টির বাংলা অর্থ দাঁড়‍ায় নদীর মোহনা বা জলের নিকটবর্তী স্থান। সেখান থেকে প্রথমে তেপ্রা বা তিপ্রা, পরে আরো পরিবর্তিত হয়ে বাংলা ও অন্যান্য ভারতীয় ভাষায় ত্রিপুরা নাম নিয়েছে।
 
ত্রিপুরী ঐতিহাসিকদের অনেকে মনে করেন, অতীতে বর্মণক (আরাকান), চট্টল (চট্টগ্রাম) ও কমলাঙ্ক (কুমিল্লা) প্রদেশের সমন্বয়ে ত্রিপুরা রাজ্য ছিল। এই তিনটি প্রদেশের ছিলো বৃহৎ তিনটি পুর বা নগর। এই ত্রি পুর বা নগর থেকেই ত্রিপুরা নামের উৎপত্তি।
 
বিষ্ণু পুরাণে বলা হচ্ছে, ‘ভারত সাম্রাজ্যের পূর্ব প্রান্তরে কিরাতের বাস। কামরূপ (আসাম) ও রাক্ষ্যাং (আরাকান) প্রদেশের মধ্যবর্তী ভূ-ভাগকে আর্যরা সুম্ম বা সুহ্ম নামে আখ্যায়িত করেন। শান বংশীয় জনগোষ্ঠী সেখানে শক্তিশালী রাজ্য স্থাপন করে। এই রাজ্যটিই মহাভারত গ্রন্থে ত্রৈপুরা, কখনোবা ত্রৈপুরী নামে আখ্যায়িত হয়। ’
 
১৪শ শতকে রচিত মানিক্য রাজবংশের ইতিহাস গ্রন্থ রাজমালাতেও ত্রিপুরা নামটির উল্লেখ পাওয়া যায়।
 
চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ ৬২০ খ্রিস্টাব্দে তার ভারত ভ্রমণ কাহিনীতে সমুদ্র উপকূলবর্তী সমতট (বঙ্গদেশ) নামক দেশের উত্তর পূর্বে ত-ল-পো-তি (To-lo-po-ti) নামে একটি রাজ্যের উল্লেখ করেন, যাকে ত্রিপুরার সমার্থক বলে মনে করা হয়। চলবে
 
বাংলাদেশ সময়: ১৭০১ ঘণ্টা, অক্টোবর ২, ২০১৬
জেডএম

**আড়াইশ’ টাকায় আগরতলা, ঢাকা থেকে ৪ ঘণ্টা 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।