ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

ট্রাভেলার্স নোটবুক

এথেন্স থেকে জাহিদুর রহমান

গ্রিসে পরিবর্তনের দূত জসিম উদ্দিন

জাহিদুর রহমান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৩৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৪, ২০১৬
গ্রিসে পরিবর্তনের দূত জসিম উদ্দিন

এথেন্স, গ্রিস থেকে: দূতাবাস কেবল এথেন্স কেন্দ্রিক না। দূতাবাসই যাবে সেবা গ্রহীতা বাংলাদেশিদের কাছে।

দূতাবাস ছড়িয়ে পড়বে এথেন্সের বাইরে। দূর-দূরান্ত যেখান থেকে মানুষ দূতাবাসে আসতে পারে না, সেখানেই চলে যাবে দূতাবাস। কলিং বেল চাপলেই হলো। দূতাবাসের দরজা খুলে যাবে সেবার দেওয়ার জন্য।

এমনটিই বলছিলেন গ্রিসে বাংলাদেশ দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত জসিম উদ্দিন।
১৯৯৪ সালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগ দেওয়া ১৩তম ব্যাচের এই কর্মকর্তা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। আন্তজার্তিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে পড়াশোনা শেষ করে লন্ডনে অধ্যায়ন করেছেন মডার্ন  ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যাডিজ বিষয়ে। বাংলাদেশ থেকে এনডিসি করা পেশাদার এই কুটনীতিকের বাড়ি নোয়াখালীর মাইজদী উপজেলায়।

গত বছরের ৩০ আগস্ট দূতাবাস প্রধান হিসেবে তিনি যোগ দেন গ্রিসে। তারপর থেকেই দূতাবাসকে জনবান্ধব আর সেবামুখী করার প্রয়াস নিয়ে চলেছে তার নানা কার্যক্রম।

গ্রিসে বাংলাদেশিদের পরিস্থিতি, সংকট আর সম্ভাবনা নিয়ে বাংলানিউজের সাথে কথা বলেন রাষ্ট্রদূত জসিম উদ্দিন।

তিনি জানান, স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আসা বাংলাদেশিরা অনেক কষ্ট করেন প্রবাসে। অনেক সংগ্রামের মধ্যে টিকে থাকতে হয় তাদের। আমি ভাবলাম। এরা তো আমার পরিবারেরই সদস্য। আনন্দের সাথে আমরা যদি তাদের দূতাবাসের সাথে যুক্ত করতে পারি তবে সেটা আরো ভালো হয়। তাদের জন্যে ক্রীড়া প্রতিযোগিতা বা স্বাস্থ্য ক্যাম্পের মাধ্যমে আমরা পরস্পরের আরো কাছাকাছি আসতে পারি।
রাজধানী এথেন্স থেকে ২৬০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমের শহর নিয়া মানোলাদায় ২০১৩ সালের ১৭ এপ্রিল বকেয়া বেতনের দাবিতে ধর্মঘটে যাওয়া শ্রমিকেদর উপর নির্বিচারে গুলি চালায় মালিকপক্ষ। গুলিবিদ্ধ হন ৩২ জন বাংলাদেশি।

আমরা সেসব বাংলাদেশিদের পাশে রয়েছি। তাদের চিকিৎসা, পূর্ণবাসন, ক্ষতিপূরণ ও ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে কাজ করছি। আমরা কথা বলছি সেখানকার খামার মালিক, জনপ্রতিনিধি আর স্থানীয় প্রশাসনের সাথে। এইভাবে সরাসরি সম্পৃক্ত হয়ে আমরা শ্রমিকদের দাবি, তাদের বঞ্চনা আর খামার মালিকদের ভূমিকা সবকিছু বিবেচনা করে সমস্যাগুলো নিষ্পত্তি করার চেষ্টা করছি। আমি মনে করি, এভাবে সংলাপের মাধ্যমেই বেড়িয়ে আসবে সমাধানের পথ। যেটা এতাদিন ছিলো না। দূতাবাস ছিলো এথেন্স কেন্দ্রিক। অভিবাসী শ্রমিকদের অনেকেই ভাষা বোঝেন না। নানা দেশ পাড়ি দেবার উদ্দেশ্যে তারা প্রথমে গ্রিসে আসেন। ভাষাগত সীমাবদ্ধতার জন্য তারা ইচ্ছে থাকলেও অনেক কিছু করতে পারেন না। আমরা বিনা ফি-তে গ্রিক ভাষা শিক্ষা কার্যক্রম চালু করেছি, জানালেন জসিম উদ্দিন।

বলতে পারেন অনন্য আর দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ। কারণ অভিবাসীরা গ্রিসে থাকেন অথচ ভাষা জানেন না। এটা কিন্তু সমস্যা। ভাষাটা অন্তত জানা থাকলে সম্ভাবনার অনেক দরজা খুলে যায়। ছোট পরিসরে আমরা এ কাজ শুরু করলেও এই কর্মসূচিকে আরো বিস্তৃতি করতে চাই আমরা, যোগ করেন তিনি।

জসিম উদ্দিন আরও বলেন, শ্রমিকরা চান এখানে বৈধ হতে। আমরা তাদের বলছি বৈধ হতে হলে কি ধরনের নিয়ম কানুন মেনে চলতে হবে। এসব প্রবাসীদের জন্যেই আমরা দূতাবাসে খুলেছি হেল্প ডেক্স। জানিয়ে দিচ্ছি স্থায়ী হতে হলে তার কি কি কাগজ পত্র লাগবে, কোথায় যেতে হবে প্রভৃতি।

এখানে শ্রমিকদের পেনশন একটি বড় সমস্যা। কর্মকাল শেষ করে দেশে ফিরলেও তারা পেনশন পান না। অথচ তিনি কিন্তু পেনশন পাবার যোগ্য। দূতাবাস এটা নিয়ে এখানকার সরকারের সাথে নিবিড়ভাবে কাজ করছে। যদিও পেনশন বা সামাজিক নিরাপত্তা, যাই বলুন না কেন এগুলো এখানে বর্তমান পরিস্থিতিতে অত্যন্ত নাজুক বিষয়।

আমি এ বিষয়ে দেশটির শ্রমমন্ত্রীর সাথে কথা বলেছি। তিনি আমাকে বলেছেন, বিষয়টির নিষ্পত্তি হওয়া উচি‍ৎ। তিনি সম্মতি দিয়েছেন, আমরা উভয় দেশ এটি নিয়ে কাজ করছি। দুই দেশের মধ্যে এ বিষয়ে একটি চুক্তি হলে আমরা অভিবাসী শ্রমিকদের পেনশন নিশ্চিত করতে পারবো।

দূতাবাসের আরও উদ্যোগের কথা জানালেন তিনি। বললেন, কনস্যুলার সেবাকে আরো বিস্তৃতি করার উদ্যোগ নিয়েছি আমরা। আমি বলে দিয়েছি, এমআরপি বা যেকোনো প্রয়োজনে অভিবাসীদের কোনো অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়ার প্রয়োজন নেই। কলিং বেল টিববে, দূতাবাসে ঢুকবে। এমআরপি পাসপোর্টের জন্যে ছবি তুলতে বসে যাচ্ছেন- দিনের কাজটা যাতে দিনেই শেষ করা যায়।

পাসপোর্ট তৈরি হয়ে গেলে অনলাইনের মাধ্যমেই তা জানানোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বলে দিয়েছি, দূতাবাসে একজন সেবাগ্রহীতা থাকা পর্যন্ত কেউ ডেক্স ছেড়ে যেতে পারবেন না। আমরা তাদের ফরম পূরণে সহায়তা করছি। এমনকি সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও আমরা কাজ করেছি। অভিবাসী শ্রমিকদের সেবাকে দোর গোড়ায় নিয়ে যেতে আমরা খুলেছি লেবার উইং। এর দায়িত্বে রয়েছেন ফার্স্ট সেক্রেটারি ড. সাঈদা ফারহানা নূর চৌধুরী।

কথায় কথায় তার পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন জসিম উদ্দিন। বলেন, আমরা লক্ষ্য করলাম, শ্রমিকদের অনেকে ৪০ বা ৪৫ বছরে না পেরুতেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন। অথচ কতই না স্বপ্ন নিয়ে এত দূর এসেছিলেন তারা। স্বপ্ন নিয়ে আসা মানুষগুলো স্বপ্ন পূরণের আগেই মারা যাওয়া কোনো মতেই মেনে নেবার নয়। আমরা উদ্যোগ নিলাম তাদের স্বাস্থ্য জ্ঞান দিয়ে স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়াতে।

আনন্দ-উৎসবেও আছি এক সঙ্গে। এখানে পহেলা বৈশাখ পালন করেছি সবাইকে নিয়ে। বলতে পারেন, এই উৎসব আয়োজন করতে রাত ৩টা পর্যন্ত ব্যস্ত ছিলেন দূতাবাসকর্মীরা। সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি ২০৪১ সালে দেশকে উন্নত দেশে পরিণত করা। আমরা অভিবাসীদের বলছি, এই আপনাদের কারণেই আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিভার্জ রেকর্ড ভাঙ্গছে। আপনাদের নিয়েই আমাদের উন্নত দেশে উন্নীত হবার কাজ করতে হবে। সকলকে সেই কর্মসূচির সাথে একান্তভাবে যুক্ত হয়ে দেশকে এগিয়ে নিতে হবে।

যারা দালাল চক্রের মাধ্যমে গ্রিসে আসতে চান। তাদের অত্যন্ত সর্তক থাকতে হবে। তাদের বুঝতে হবে, এমনিতেই দেশটির অর্থনীতি প্রচণ্ড চাপের মধ্যে। তাই তারা যেন বুঝে শুনে এ পথে পা বাড়ান। তবে কৃষি শ্রমিক হিসেবে এসে এ দেশে বৈধভাবে কাজ করার সম্ভবনা রয়েছে। সবকিছুর আগে ভাবতে হবে কেউ যেন অবৈধ অভিবাসী হওয়ার পথে পা না বাড়ান। তাতে জীবন কেবল ঝুঁকিপূর্ণই নয়, সাক্ষাৎ মৃত্যুও সামনে আসতে পারে। আমরা প্রবাসীদের জন্যে একটি ডাটাবেইজ তৈরির কথা ভাবছি। যদিও অনেকে এখানে আসেন প্রকৃতপক্ষে ইউরোপের অন্যান্য দেশে যাবার জন্য। তবে একটি শক্তিশালী ডাটাবেইজ থাকলে শ্রমিকদের অবস্থান বা সরকারের সর্তকতামূলক পদক্ষেপ সবকিছুর যোগাযোগ সহজ হবে।

আসলে গ্রিসের সবকিছুই ইউরোপ কেন্দ্রিক। সেটা মাথায় রেখেই দু’দেশের সাথে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে আরও জোরদারে কাজ করছি আমরা, যোগ করেন রাষ্টদূত জসিম উদ্দিন।

বাংলাদেশ সময়: ২০৩৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৪, ২০১৬
এটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।