ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

ট্রাভেলার্স নোটবুক

পর্যটন স্বর্গ কক্সবাজারে

মো. রফিকুল ইসলাম, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১২৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৯, ২০১৬
পর্যটন স্বর্গ কক্সবাজারে

আমার কর্মস্থল নেত্রকোনার সুসঙ্গ দুর্গাপুর উপজেলার সুসঙ্গ মহাবিদ্যালয়ের মাসিক সভায় শিক্ষা সফরের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় মাসখানেক আগে। আমরা কলেজের উত্সাহী কিছু শিক্ষক দূরবর্তী স্থানে শিক্ষা সফরের সিদ্ধান্ত নেই।

এবং স্থান হিসেবে বেছে নেই সাগর-পাহাড়-অরণ্য ঘেরা প্রকৃতির অপার লীলাভূমি কক্সবাজারকে।

পৃথিবীর দীর্ঘতম ১২০ কিলোমিটারের সমুদ্র সৈকত, বঙ্গোপসাগরের উত্তাল ফেনিল ঢেউ, বিশালাকার প্রবাল পাথর, সাগরপাড়ের সুউচ্চ সারি সারি পাথুরে পাহাড়, স্ফটিক স্বচ্ছ ঝর্ণাধারা, বিস্তীর্ণ ঝাউবন, রাখাইন পল্লী, বার্মিজ মার্কেট আর স্থানীয় সংস্কৃতি সবই যেন আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকছিলো ভ্রমণ যাত্রার আগে থেকেই। কিন্তু সুসঙ্গ দুর্গাপুর থেকে এর দূরত্ব যে অনেক! দেশের উত্তর সীমান্ত থেকে একেবারে দক্ষিণ সীমান্তে।

দূরত্ব, পরিবহন, খরচ ও সময়- এসব কিছু বিবেচনায় নিয়ে অবশেষে ১৫ ফেব্রুয়ারি কলেজ থেকে ছাত্র-শিক্ষক মিলে আমরা ৬৬ জন ভ্রমণপিপাসু যাত্রা শুরু করি। অর্থ সাশ্রয়, ক্লান্তি লাঘব ও বাড়তি আনন্দের লক্ষ্যে এ ভ্রমণ যাত্রার সিংহভাগ জুড়েই ট্রেনে ভ্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেই আমরা। জারিয়া রেলস্টেশন থেকে আরাম-আয়েশে সন্ধ্যার আগেই আমরা পৌঁছে যাই ময়মনসিংহ স্টেশনে। আমাদের পরবর্তী ট্রেন আন্তঃনগর ‘বিজয় এক্সপ্রেস’ চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে ছাড়বে রাত ৮টায়। প্রায় ঘন্টাদুয়েক সময় হাতে থাকায় আমরা ময়মনসিংহ শহরে ভ্রমণ সংক্রান্ত টুকিটাকি জিনিসপত্র ও রাতের খাবার কিনে নেই।

রাত ৮ টায় দীর্ঘ পথ-পরিক্রমা বিজয়ের লক্ষ্যে আত্মপ্রত্যয়ী এক হুঙ্কার দিয়ে রুপসী চট্টলার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলো ‘বিজয় এক্সপ্রেস’। যথাসময়ে ট্রেনটি ছাড়ায় আমাদের মনে তখন বাড়তি আনন্দ আর উত্তেজনা। শুরু হয়ে গেলো ছাত্র-ছাত্রীদের আধুনিক, ব্যান্ড, লোকগীতি-পল্লীগীতি, রবীন্দ্র-নজরুল সংগীত, হিন্দি, ইংরেজি গানের সঙ্গে নাচ আর হাততালি।

এভাবে সুরে-ছন্দে, নাচে-গানে ট্রেনের ছন্দময় দুলুনিতে আমরা পার হতে থাকি ময়মনসিংহ জেলা, কিশোরগঞ্জ জেলা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা, কুমিল্লা জেলা, ফেনী জেলা ও চট্টগ্রাম জেলা এবং এসব এলাকার বিখ্যাত সব শহর- গৌরীপুর, নান্দাইল, কিশোরগঞ্জ, ভৈরব, আশুগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, আখাউড়া, কুমিল্লা, লাকসাম ফেনী ইত্যাদি।

অতঃপর পূবাকাশের লাল সুর্যকে সঙ্গে নিয়ে প্রবেশ করি রূপসী চট্টগ্রামে। এ প্রত্যুষে আঁধার ভেদ করে আমাদের সামনে উন্মোচিত হতে থাকলো উঁচু-নিচু পাহাড়ের সারি, টিলা, সবুজ বনানী, ফসলের ক্ষেত ও রকমারি সবজি বাগান। চোখে পড়লো বিচিত্র পাখির ওড়াউড়ি, কোথাও জলাশয়ের পাশে বসা চিল, বক আর মাছরাঙা।

অবশেষে সুদৃশ্য বাণিজ্য নগরীর সুরম্য স্থাপনা, অট্টালিকা, কল-কারখানা পেরিয়ে ঠিক ভোর ছয়টায় পৌঁছে যাই দৃষ্টিনন্দন চট্টগ্রাম স্টেশনে। ধীরে-সুস্থে প্রাতঃক্রিয়াদি এবং নাস্তা-পানি সেরে সকাল সাড়ে নয়টার দিকে আমরা বাসযোগে কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে রওনা দেই।

বাণিজ্যিক ব্যস্ততায় সরগরম চট্টগ্রাম শহর ও প্রবাহমান কর্ণফুলীর অপার সৌন্দর্য উপভোগ করে আমরা সামনে এগোচ্ছি। পাহাড়-নদী-সাগর বেষ্টিত চট্টলার অনেক কিছুই যেন পর্যটনের খোরাক। আমরা ক্রমান্বয়ে অতিক্রম করছি চট্টগ্রাম জেলার বোয়ালখালী, পটিয়া, চন্দনাইশ, হাটহাজারী, সাতকানিয়া, লোহাগড়া ইত্যাদি স্থান। এখানে রাস্তার দু’পাশে যেমন আছে সবুজ-শ্যামলিমায় ভরা সমতল, তেমনি কোথাও কোথাও আছে বন্ধুর অরণ্য। মাঝে মাঝে সর্পিল অবয়বে বয়ে চলেছে বহু ছড়া, খাল এবং কর্ণফুলী, সাঙ্গু, বাঁশখালীর মতো নয়নাভিরাম নদীগুলো। সুদৃশ্য সাম্পানের পাশাপাশি সেগুলোতে ভেসে চলেছে বাঁশ-বৃক্ষের মাচাল। চলন্ত বাস থেকেই এ এলাকার প্রকৃতির রূপবৈচিত্র্য উপভোগ করে চলেছি সন্মুখপানে।

এক সময় চলে এলাম কক্সবাজার জেলায়। ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হতে থাকলো ভূ-প্রকৃতির দৃশ্যপট। রাস্তার দু’পাশ জুড়েই দিগন্তজোড়া উঁচু-নিচু পাহাড়-টিলা। তার ওপর বিশাল বিশাল গর্জন ও অন্যান্য বৃক্ষের প্রাকৃতিক বন, আবার কোথাও সৃজিত বন, কোথাও নারকেল-সুপারি বিথি- এর সবই নয়নাভিরাম সবুজে ভরপুর। বহমান নদী-নালা ও ছড়া সেতো আছেই।

মনে হয় চলে এসেছি অন্য এক ভুবনে। অনেকেই বিস্ময়ে বিমূঢ়। এমনি এক অনুভূতিতে একে একে পার হচ্ছি হারবাং, চকরিয়া, ডুলোহাজারা, ফুলছড়ি, নাপিতখালি, ঈদগাঁও ও বিখ্যাত রামু এলাকা।

রামু ও ডুলোহাজারায় রয়েছে বহু দর্শনীয় স্থান। কিন্তু সেগুলোতে বিরতি না দিয়ে আমরা এগিয়ে চলেছি মূল গন্তব্য কক্সবাজারের দিকে।

বেলা একটায় চলে এলাম বেলাভূমির লীলাক্ষেত্র বিশ্বখ্যাত পর্যটন নগরী কক্সবাজারে। সেই ১৯৮২ সালে প্রথম দেখা কক্সবাজারকে ঠিক মেলাতে পারছি না। রাস্তা-ঘাট হয়েছে সুপ্রশস্ত, ভূমি অক্ষের পাশাপাশি আকাশের দিকে বাড়ছে শহর, টিনের ঘরের স্থলে গড়ে উঠেছে দালান-কোঠা, সাগরের তীরবর্তী এলাকায় সারি সারি হোটেল,কটেজ আর রিসোর্ট। আদি-অনাদিবাসী লোকজনের পদচারণায় কর্মমুখর গতিশীল এক শহর। যেন চলছে হাল্কা কোনো উত্সবের আমেজ। বাস থামলো ঝাউতলার হোটেল সাগরগাঁও প্রাঙ্গনে।

বিকেলে সাগর আর সূর্যাস্তের ইপ্সিত মাহেন্দ্রক্ষণ উপভোগ করতে আমরা টমটম গাড়িতে করে এগোচ্ছি কলাবতী বিচ ও লাবনী বিচের দিকে। সাগরের মিষ্টি বাতাস এসে জুড়িয়ে দিচ্ছে আমাদের মন-প্রাণ, চোখে পড়ছে সুদীর্ঘ শ্যামল ঝাউবন, সৈকতে আঁছড়ে পড়া সাগরের উন্মাতাল সফেন ঢেউ, শোনা যাচ্ছে সাগরের আগ্রাসী গর্জন। একটা আকাঙ্খা আর স্বপ্ন পূরণের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছি আমরা।

টমটম থেকে নেমে যতোই বিচের দিকে এগোচ্ছি ততোই বিচ আম্ব্রেলার সুদীর্ঘ সারি আর ভ্রমণপিপাসুদের আনাগোনা বিস্তৃত হতে থাকলো। বুঝলাম, চৌত্রিশ বছর আগের তুলনায় পর্যটক ও আয়োজন বেড়েছে বহুগুণ। বিচ আম্ব্রেলার বাহুল্য ও ঘনত্ব এতো বেশি যে, এটাকে বেলাভূমির মেলা মনে হচ্ছিলো। নিরিবিলি সমুদ্রলীলা উপভোগ করবার যুত্সই পরিবেশটি ঠিক যেন এখানটায় নেই।

তারপরও আর দশজনের মতো করে বিচ চেয়ারে গা এলিয়ে আমরা বঙ্গোপসাগরের রূপ-মাধুরী উপভোগ করলাম। কেউ কেউ নিমগ্ন হলো সমুদ্রস্নান ও জলকেলিতে, কেউবা সাগরকে পটভূমি করে দূর্লভ ছবি তোলায় ব্যস্ত, কেউ জীবনের প্রথম দেখায় সাগরের বিশালত্বের দিকে তাকিয়ে আছে অবাক বিস্ময়ে। দিগন্তজোড়া সুনীল জলরাশি ধনুকের পিঠের মতো উঁচু থেকে নিচের দিকে ধাবমান হয়ে সামনে চলার যেন পথ খুঁজে পাচ্ছে না। আর সেই আক্রোশেই যেন গর্জন করে আঁছড়ে পড়ে ভেঙে ফেলতে চাইছে সমস্ত বেলাভূমি, নিত্যদিন নিরন্তর।

আর এসব দৃশ্য আমরা উপভোগ করছি পৃথিবীর দীর্ঘতম সমূদ্র সৈকতে দাঁড়িয়ে, এ অনুভবে আমরা পুলকিত ও রোমাঞ্চিত। কিন্তু, একটি বিষয় দেখে আমি অত্যন্ত হতাশ হয়েছি, কক্সবাজার সংলগ্ন পুরো সৈকত জুড়ে একটিও জেলিফিশ ও শামুক-ঝিনুক না দেখে। অথচ, ১৯৮২ সালে এসে এ সৈকতেই প্রচুর জেলিফিশ ও শামুক-ঝিনুক পড়ে থাকতে দেখেছি, স্বচ্ছ জেলিফিশের গায়ে হাত বুলিয়েছি, কুড়িয়েছি শামুক-ঝিনুক।

অথচ আজ আমার সহযাত্রী ও শিক্ষার্থীদের তা দেখাতে ব্যর্থ হলাম। পরিবেশ দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন জনিত কারণে সাগরের যে জীব-বৈচিত্র্যও কমে এসেছে এটা তারই প্রকৃষ্ট প্রমাণ।

এদিকে পশ্চিম দিগন্তে সূর্য ধীরে ধীরে রক্তিম আভা ধারণ করতে শুরু করেছে। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই মহাসাগরের বুকে অস্তমিত হবে সে। সাগরের ভেতরের পেলব ঢেউ এবং তীরবর্তী উত্তাল ঢেউয়ে সূর্যের রক্তিম প্রতিবিম্ব অসংখ্য সূর্য হয়ে যেন নাচন তুলেছে আর পুরো সমুদ্র যেন হয়ে পড়েছে এক লালাভ হীরকখণ্ড, যার ভেতর থেকে বিকিরিত হচ্ছে লাল ঝিলিক। এ এক অভূতপূর্ব অপার্থিব দৃশ্য।

অবশেষে মহাসাগরের লালটিপ কেঁপে কেঁপে তার বুকে অস্তমিত হলো। স্বপ্নীল এ দৃশ্য আমাদেরকে সম্মোহিত করে রেখেছে অনেকক্ষণ। তারপর ফিরে আসা সৈকতপাড়ের ঝিনুক মার্কেটে। আলো-আঁধারির মনোরম এ পরিবেশে চা-নাস্তা সেরে রওনা দিলাম বার্মিজ মার্কেটে।

বেশ কিছু ভবনের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে এ মার্কেট। সুশ্রী ও প্রিয়দর্শিনী রাখাইন তরুণীদের পরিচালিত বিপণিবিতানে পাওয়া যায় মায়ানমার, থাইল্যান্ড ও চীন থেকে আনা রকমারি পোশাক-আশাক, চাটনি-চকলেট-বাদাম, রঙিন ছাতা, খেলনা, তৈজসপত্র ও গৃহসজ্জা সামগ্রী। ভিন্নতর আবহের এ মার্কেটে কেনাকাটা আপনাকে নিশ্চিত আনন্দ দেবে।

রাত দশটার মধ্যে খাওয়া-দাওয়া সেরে ফিরে এলাম হোটেলে। পরদিন সকালে হিমছড়ি ও ইনানি ভ্রমণের স্বপ্ন নিয়ে নিদ্রামগ্ন হলাম আমরা।

সাত সকালে নাস্তা সেরে বেশ কয়েকটি টমটম গাড়ি ভাড়া করে রওনা হলাম হিমছড়ি  জাতীয় উদ্যান এবং ইনানি সি বিচের দিকে। পঁয়ত্রিশ কিলোমিটার দূরবর্তী ইনানি যেতে সময় লাগবে পঞ্চাশ মিনিট আর দশ-বারো মিনিট দূরত্বের হিমছড়ি মাত্র ১২ কিলোমিটার দূরে। কক্সবাজারের সৈকত ঘেঁষেই তৈরি হয়েছে মেরিন ড্রাইভ সড়ক যা চলে গেছে ১২০ কিলোমিটার দূরবর্তী টেকনাফ পর্যন্ত। এখানে শুধু বিশ্বের দীর্ঘতম সমূদ্র সৈকত পরিভ্রমণের অনুভূতিতেই আপনি আনন্দিত হবেন না, আরো বিস্ময়ে রোমাঞ্চিত হবেন বামদিকের সুউচ্চ লাগাতার পাহাড়ের সারি দেখে। বিশ্বে আর কোথাও এ বিরল দৃশ্য মিলবে কি-না তা আমার জানা নেই।

এ মেরিন ড্রাইভের আবেশ-আবহ ও সুখানুভূতি নিয়ে বিশ্বব্যাপী প্রচার ও সুযোগ-সুবিধার প্রসার হলে এখানে পর্যটকের ঢল নামবে তা নিশ্চিত করে বলা যায়। কোথাও খাড়া পাহাড়ে ভাঁজে ভাঁজে লাখো বছরের স্মৃতিচিহ্ন নিয়ে সুরক্ষার দেয়ালের মতো দাঁড়িয়ে আছে, কোথাও পাথুরে পাহাড় তার দৃঢ়তার জানান দিচ্ছে, কোথাও গিরিখাদ, কোথাও গুহা, কোথাও ঝর্ণাধারা। বিচিত্র সব গাছ-গাছালি, লতাগুল্ম, বনফুল আর অর্কিডে সেজে আছে প্রায় সবগুলো পাহাড়। আর ডানদিকে বঙ্গোপসাগরের সুনীল জলরাশি এবং উছ্বাসী ফেনিল ঢেউ আদিগন্ত বয়ে চলেছে সুদূর টেকনাফ পর্যন্ত। মাঝে মাঝে লম্বা ঝাউবন, নারিকেল-সুপারি বিথি আর স্থানীয় সাম্পান নৌকার উপস্থিতি আপনাকে বিমোহিত করবে।

কী নেই এখানে? যারা প্রকৃতি বোঝেন, তারা নিশ্চিত প্রেমে পড়বেন এ পরিবেশের। বিস্ময়ের ঘোর কাটতে না কাটতেই চলে এলাম ইনানি বিচে। নিসর্গের আরেক বিস্ময় অপেক্ষা করছে যেন আমাদের জন্য। বিশালাকায় প্রবাল পাথর ছড়িয়ে ছিটিয়ে ভরে আছে এ সৈকত। সাগরের জল এদেরকে ভালোবেসে বিপুল উচ্ছ্বাসে পুনঃপুনঃ আলিঙ্গন করছে যেন। দূরে উড়ছে গাঙচিল। আরো দূরে দেখা যাচ্ছে সারিবদ্ধ লোকজন জাল পেতে মাছ ধরছেন এবং বেশ দূরে দেখা যাচ্ছে ভাসমান ট্রলার। ডাঙায় সাময়িক বিরতিতে থরে থরে সাজানো মাছধরা সাম্পান।

কক্সবাজারে এসে স্বতন্ত্র ইনানি সি বিচ দেখে না গেলে ভ্রমণ হবে অসম্পূর্ণ। এখানকার ডুবন্ত পাথরগুলোতে উঠতে গিয়ে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। নইলে পা পিছলে বড় দুর্ঘটনাও ঘটে যেতে পারে। এখান থেকে উঠতে মন চায়নি, তারপরও রুটিনমাফিক ফিরে আসার তাগিদে উঠতে হলো আমাদের।

ফেরার পথে চরম পরিতৃপ্তি নিয়ে এগোচ্ছি হিমছড়ির জাতীয় উদ্যান ও ঝরনার দিকে। এখানে এসে টিকিট কেটে সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলাম এ উদ্যানের উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গে। চারদিকে চোখ বুলালাম, পশ্চিমে বিস্তৃত বঙ্গোপসাগরকে মনে হচ্ছিলো আগের চেয়ে অনেক ছোট, কিন্তু ভিন্নতর এক বনসাই-সৌন্দর্য নিয়ে সে বিমুগ্ধ করলো আমাদের। ডানে-বামে-পেছনে তাকিয়ে দেখলাম অরণ্য ছাওয়া পাহাড় আর পাহাড়, নিচে ঘন সবুজ গিরিখাদ। শুনলাম, এসব পাহাড়ি বনে রয়েছে দুর্লভ বন্যপ্রাণী। আবার সিঁড়ি দিয়ে নেমে বামদিকে ভেতরে হিমছড়ির সেই বিখ্যাত ঝরনা। উষ্ণ এ ঋতুতে জলপ্রপাতের বিস্তৃতি ও তীব্রতা কমে গেলেও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যপিপাসুদের মনোরঞ্জন একবিন্দু কম দিচ্ছে না সে। তাই চরম পরিতৃপ্তি নিয়ে এর সামনে বিভিন্ন ভঙ্গিতে ছবি তোলায় ব্যস্ত অনেকেই।

এরপর কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম আমরা। কক্সবাজারে দুপুরের খাবার সেরেই উঠে পড়লাম বাসে। পরবর্তী গন্তব্য ডুলোহাজারায় বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক পরিদর্শন শেষে চট্টগ্রাম শহরে রাত্রিযাপন। কক্সবাজার শহর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার উত্তরে ডুলোহাজরা বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে ঘন্টাখানেকের মধ্যেই পৌঁছে যাই আমরা।

দেশের প্রথম ও বৃহত্তম সাফারি পার্ক এটি। ৯০০ হেক্টর জায়গা জুড়ে সম্পূর্ণ অবিকল প্রকৃতিতে ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এটি। প্রকৃতি ও জীব-বৈচিত্র্য প্রেমিকদের জন্য এ এক আরাধ্য স্বর্গরাজ্য। শহুরে চিড়িয়াখানা থেকে এ এক ভিন্নতর আয়োজন। ‘বন্যেরা বনে সুন্দর’ সে কথাটির সত্যতা প্রমাণ করতেই যেন এ সাফারি পার্কের যতো আয়োজন। মূল ফটক পার হয়ে এক পলকেই ভালো লেগে যায় এ প্রাকৃতিক পার্কটি। সুবিশাল বাহারি গর্জনসহ বিচিত্র রকমের বৃক্ষরাজি, লতা-গুল্ম ও পশু-পাখির কল-কাকলিতে ভরপুর এটি। ছায়া-সুনিবিড় পিচঢালা পথ, তারই দু’পাশে উপযোগী বিভিন্ন বেষ্টনী দিয়ে প্রাকৃতিক পরিবেশে গড়ে তোলা হয়েছে বিভিন্ন প্রাণীর আবাস। সত্যিই মনোমুগ্ধকর! পাখির বিচিত্র কিচির-মিচিরের সঙ্গে দুপুরের খাঁ খাঁ রোদে মাঝে মাঝে কানে ভেসে আসছিল বাঘ-সিংহের হুঙ্কার এবং উল্লুকের ডাকাডাকি।

মনে হচ্ছিলো আমরা যেন গভীর নির্জন অরণ্যের পথহারা পথিক। এখানে ঘুরে ঘুরে আমরা দেখলাম উল্লুক, বানর, রয়েল বেঙ্গল টাইগার, মেছোবাঘ, চিতাবাঘ, সিংহ, হরিণ, হনুমান, বন্য শুকর, ময়ূরসহ বিরল বিচিত্র পাখি, সাপ, কুমির, জলহস্তি, হাতি, বনগরু এবং শুধুমাত্র এ এলাকায় প্রাপ্ত বন্যপ্রাণী কালো ভল্লুক, মায়া হরিণ, লামচিতা, মদনটাক পাখি ইত্যাদি। এখানে একপাশে হাতির জন্য রয়েছে বিস্তীর্ণ অভয়ারণ্য। নিরাপত্তার কারণে যেখানে সর্বসাধারণের প্রবেশ নিষেধ। বন থেকে প্রায়ই নাকি বন্যহাতির দল মূল পার্কটিতে চলে আসে। বনের ফাঁকে ফাঁকে কিছু সুদৃশ্য ডোবা ও লেকও চোখে পড়লো। যাতে ফুটে আছে অজস্র লাল শাপলা ফুল। চারদিকে ভালোভাবে চোখ বুলালে আপনি আরো দেখতে পারবেন বিচিত্র বনফুল ও অর্কিড এবং ভ্রমর-অলির ওড়াউড়ি।

চমত্কার এ নৈসর্গিক পরিবেশ পরম তৃপ্তির সঙ্গে উপভোগ করে আবারো বাসে উঠে বসলাম। রাতেই ফিরতে হবে চট্টগ্রাম, সকালে ধরতে হবে ময়মনসিংহগামী আন্তঃনগর ট্রেন ‘বিজয় এক্সপ্রেস’ এবং যথারীতি ফিরে যেতে হবে আবাস ও কর্মস্থল সুসঙ্গ দুর্গাপুরে। তবুও এ সফরে- স্মৃতি ও অভিজ্ঞতার ঝুলিতে ভরে নিয়েছি অপরূপ কক্সবাজার, হিমছড়ি, ইনানি ও ডুলোহাজরা বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কের অপার সৌন্দর্য ও জ্ঞানকে। ক্ষুদ্র এ নশ্বর জীবনে সেই বা কম কী!

মোঃ রফিকুল ইসলাম: সহকারী অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, সুসঙ্গ মহাবিদ্যালয়, দুর্গাপুর, নেত্রকোনা।

বাংলাদেশ সময়: ০১৩০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৯, ২০১৬
এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।