ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

ট্রাভেলার্স নোটবুক

ভারত ভ্রমণপঞ্জি-১

সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড, কলকাতা ইন অক্টোবর

এরশাদুল আলম প্রিন্স, ল’ এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯০৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ২০, ২০১৫
সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড, কলকাতা ইন অক্টোবর ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

কলকাতা থেকে ফিরে: দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় পর কলকাতা। পুরনো পাসপোর্টটা হাতে নিয়ে পৃষ্ঠা উল্টাতেই ফিরে যাই তের বছর আগের সেই কলকাতায়।



সবে ইউনির্ভাসিটি তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। পাসপোর্ট হাতে পেয়েছি বেশ কয়েকদিন। হয়তো মাস তিনেক। ছিল-ছাপ্পর ছাড়া খালি কয়েকটি পৃষ্ঠা আর কি! সহ্যে যে আর কুলোচ্ছে না। এসব নিয়েই ভাবছিলাম কয়েকদিন। আজ না কাল, কাল না পরশু। এভাবেই একদিন ধানমন্ডির ভারতীয় ভিসা অফিসে গেলাম।

তখন তো আর আজকের মতো অনলাইনে ভিসা আবেদন করা যেতো না! ধানমণ্ডির ভিসা অফিসে গেলে ছাপানো ফর্ম পাওয়া যেতো। তাও নিজেকে পূরণ করতে হতো না। দালালদের একশ’/ দুশ’ টাকা দিলে তারাই সব ব্যবস্থা করতো। কোনো জটিলতা ছাড়াই ভিসাও পেয়ে গেলাম।

সেপ্টেম্বর মাসের কোনো একদিন। কলাবাগানের কাউন্টার থেকে টিকিট নিয়ে বাসে উঠে বসলাম। গন্তব্য বেনাপোল। এর পর আর জানা নেই। সবাই যে দিকে যায় সেদিকেই। সবকিছু আগে থেকে জেনে-বুঝে যাওয়ার অনলাইন সমাধান তখন ছিল না।
সকালের বেনাপোল। ব্যস্ত চারদিক।

সীমান্ত পার হওয়ার সময় এক অদ্ভূত অনুভূতি আমাকে নাড়া দেয়। রাষ্ট্র, সীমান্ত, নো ম্যানস’ ল্যান্ড, কাঁটাতার, এপার-ওপার শব্দগুলো বহুবার শুনেছি। পড়েছিও রাষ্টবিজ্ঞানে, ইতিহাসে। কিন্তু বাংলাদেশের শেষ সীমানায় গিয়ে যা বুঝলাম তা হলো, বাংলাদেশের ভূখণ্ড থেকে বেরিয়ে গেছে একটি সড়ক। একদিকে বেনাপোল, আরেক দিকে পেট্রাপোল। দুপাশে কাঁটাতার। মাঝখানে নো ম্যানস’ ল্যান্ড। এক পা সামনে বাড়ালেই ভারত-মানে আরেকটি রাষ্ট্র। নো ম্যানস’ ল্যাণ্ডের ঠিক একটু পরেই দাঁড়িয়ে আছে ইয়া বড় গোঁফওয়ালা এক বিএসএফ সদস্য। এই বুঝি রাষ্ট্রবিজ্ঞান?
এবার পেট্রাপোল থেকে আরো কয়েকজন সাধারণ যাত্রীর সঙ্গে ট্যাক্সিতে করে কলকাতার পথে।

সবুজের বুক চিরে এগিয়ে গেছে একটি সড়ক। দুপাশে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে শতাব্দী প্রাচীন বৃক্ষরাজী।
 
যেতে যেতে মনে পড়লো, ইতিহাসে পড়া মুক্তিযুদ্ধের সেই সব দিনগুলোর কথা। যেদিন এই পথ ধরেই হেঁটে গিয়েছিলেন লক্ষকোটি বাংলাদেশি শরণার্থী। মনে পড়লো তাদের কথা, যারা চিরদিনের ভীটে মাটি ছেড়ে, বাড়ির সামনের কৃষ্ণচূড়া গাছ অথবা শান বাঁধানো পুকুর ঘাটটি পেছনে ফেলে, কিংবা মাত্র উড়তে শেখা পায়রা জোড়াকে মুক্ত করে দিয়ে মুক্তির সন্ধানে শরণার্থী জীবন বরণ করেছিলেন, হেঁটেছিলেন এই পথে অজানা গন্তব্যে। কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছিল তাদের কথা মনে করে।

ট্যাক্সির গ্লাস নামিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলাম এক প্রাচীন বৃক্ষ। ভাবলাম, হয়তো এরই তলে ক্ষণিকের তরে ছায়া খুঁজেছিলেন আমারই আপনজন। হয়তো ক্লান্তি দূর করেছিলেন আরো অনেকটা পথ যেতে হবে বলে। শ্রদ্ধাবনত হই ওই বৃক্ষের কাছে।

মনে পড়ে গেল আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অ্যালন গিনসবার্গের সেই বিখ্যাত কবিতাটি: 
Millions of souls nineteenseventyone
homeless on Jessore road under grey sun
A million are dead, the million who can
Walk toward Calcutta from East Pakistan

Taxi September along Jessore Road
Oxcart skeletons drag charcoal load
past watery fields thru rain flood ruts
Dung cakes on treetrunks, plastic-roof huts

Wet processions Families walk
Stunted boys big heads don't talk
Look bony skulls & silent round eyes
Starving black angels in human disguise...

এসব ভাবতে ভাবতেই একসময় পৌঁছে যাই ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে।
দীর্ঘ একযুগ পরে আবার সেই প্রিয় শহর। এবার Calcutta নয় Kolkata।   হরিদাসপুর নয়, সরাসরি ‘নেতাজীতে’। সেপ্টেম্বর নয়। এই অক্টোবরে।
স্টিল, কাঁচ, অ্যালুমিনিয়াম, দামি টাইলস আর মারবেল পাথর দিয়ে তৈরি এক সুবিশাল অত্যাধুনিক বিমানবন্দর ‘নেতাজী সুভাস চন্দ্র বোস’ আর্ন্তজাতিক বিমানবন্দর।

পড়শির ভালো কিছু দেখলে যে ঈর্ষা হয়, গা জ্বলে যায় আর নিজের ওপর রাগ হয় তা টের পেলাম ‘শাহজালাল’ থেকে ‘নেতাজি’তে এসে। শুধু নাম পরিবর্তনে যে মানের কোনো হের ফের হয় না তার প্রমাণ মিললো প্রায় পৌনে এক ঘণ্টার ব্যবধানে দুই বিমানবন্দর দেখে। এতো বছর পরেও আমরা কি আর্ন্তজাতিক মানের একটি বিমান বন্দর পেয়েছি?

বিদেশি নাগরিক বা প্রবাসীদের কাছে বিমানবন্দরই হলো একটি দেশের প্রথম প্রতিচ্ছবি। শাহজালালে প্লেন থেকে অবতরণ থেকে শুরু করে ট্যাক্সিতে চড়া পর্যন্ত যে সামান্য ধারণাটুকু পাওয়া যায় তা আর্ন্তজাতিক বিমান বন্দরের ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

ইমিগ্রেশন অফিসারদের সরকারি দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণ পরিবর্তন করা সময়ের দাবি। কোনো রকম ইমিগ্রেশন পার হওয়ার পরই শুরু হয় কারেন্সি পরিবর্তন করার জন্য দোকানিদের ডাকাডাকি। এসব পার হয়ে বাইরে বের হলে ট্যাক্সি চালকদের ডাকাডাকি।
 
সারা ঢাকা শহরে ট্যাক্সি চালকদের অনেক ডাকাডাকি, এমনকি হাতে পায়ে ধরেও অনেক সময় কোথাও যাওয়ার জন্য রাজি করানো যায় না। তাদের মর্জি হলেই কেবল সাড়া মেলে। অথচ বিমান বন্দরে তার উল্টো চিত্র।

ভিন্নচিত্র দেখলাম কলকাতা বিমানবন্দরে। সম্পূর্ণ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন একটি বিমানবন্দর। ওয়াশরুম থেকে ওয়েটিং স্পেস-সর্বত্রই আধুনিকতার ছাপ স্পষ্ট।
বাংলা, ইংরেজি ও হিন্দিতে যাত্রীদের জন্য যথাযথ নির্দেশনা দেওয়া আছে। পর্যাপ্ত কুলিংসহ পুরো বিমানবন্দরটিই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। আমাদেরও তাই। কিন্তু শাহজালালে গরম থেকে কিছুটা রক্ষা পেলেও ঠাণ্ডা হওয়ার সুযোগ নেই।

বাঙালির বই পড়ার অভ্যেস কম। তবে কলকাতা বিমানবন্দরের বইয়ের দোকানটি দেখে ভালো লাগলো। বিখ্যাত সব বইয়ের ভাণ্ডার যেনো এই ছোট লাইব্রেরিটি।

ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ করে কোনো রকম বিরতি ও দুঃশ্চিন্তা ছাড়াই লাগেজ সংগ্রহ করলাম। যার যার লাগেজ ঠিকমতো নেওয়া হচ্ছে কিনা তাও দেখা হলো।

বিমানবন্দর থেকে যার যার গন্তব্যে যাওয়ার জন্য সব রকম সুযোগ সুবিধাই আছে এখানে। আছে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের ব্যবস্থা। রেল-বাসের খবরও জানা যায়, টিকিটও পাওয়া যায়। কলকাতার যে কোনো গন্তব্যে যাওয়ার জন্য আছে প্রিপেইড ট্যাক্সির ব্যবস্থা।

বিমানবন্দর থেকে মারক্যুইস স্ট্রিট ঘণ্টা খানেকের মামলা। ট্রাফিক জ্যাম বলতে যা বোঝায় সেরকম কিছু পেলাম না। কয়েকটি সিগন্যালে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে, এই যা। আগের চেয়ে অনেক পরিচ্ছন্ন ও প্রশস্ত সড়ক। ঢাকার মতো এতো বিলবোর্ড নেই।

তবে, ঢাকার মতো কলকাতায়ও বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক বিলবোর্ড চোখে পড়লো। অধিকাংশ রাজনৈতিক বিলবোর্ডেই মমতা ব্যানার্জির মোনাজাতরত ছবি। বুঝলাম, বাঙালিমাত্র একই রাজনৈতিক আবর্তে ঘুরপাক খায়। ধর্ম নিয়ে রাজনীতি শুধু বাংলাদেশে নয়, পশ্চিমবঙ্গও কম যায় না।

ভারতের রাজনীতিতে কলকাতা সব সময়ই গুরুত্বপূর্ণ। ব্রিটিশ ভারত থেকে এর গুরুত্ব আরো বাড়তে থাকে। ১৯১১ সাল পর্যন্ত আজকের কলকাতাই ছিল ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী। ব্রিটিশরা মুঘলদের কাছ থেকে সিংহাসন কেড়ে নিয়ে দিল্লি থেকে রাজধানীও স্থানান্তর করে কলকাতায়। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণেই এ স্থানান্তর। অনেকে মনে করেন, ব্রিটিশ ভারতের কলকাতা লন্ডনের চেয়ে অনেক উন্নত শহর ছিল।

সময়ের আবর্তে সেই কলকাতা হারিয়েছে জৌলুস। তবে, পুরনোর বুক চিরে বেড়ে উঠছে নতুন ও আধুনিক এক কলকাতা।

বাংলাদেশ সময়: ০৮৫০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২০, ২০১৫
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।