ঢাকা, শনিবার, ১৯ আশ্বিন ১৪৩১, ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ০১ রবিউস সানি ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

চিন চীন, অচিন চীন-০১

সাজেদা সুইটি, চিফ অব করেসপন্ডেন্টস | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮০৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৯, ২০১৪
চিন চীন, অচিন চীন-০১ ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

চীন থেকে ফিরে: জ্ঞানার্জনের জন্য সুদূর চীনে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন গুরুজনরা। যোগাযোগের উৎকর্ষতায়  সেই চীন আর দূরের দেশ নেই।

সময় পেলে ঘুরেই আসুন নানা ঐতিহ্যবাহী দেশটি।
 
ঢাকা থেকে কুনমিং পর্যন্ত চায়না ইস্টার্নে আমরা পৌঁছাই মাত্র ঘন্টা দুয়েকে। রাজধানীর মিরপুর থেকে মতিঝিল যেতেও কখনো কখনো নিশ্চয়ই এর চেয়ে বেশি সময় লেগে যায়।
 
আর কুনমিং থেকে ঘন্টা তিনের যাত্রা বেইজিং পৌঁছাতে। ব্যস্ত ঢাকায় অফিস সময়ে যারা ভয়াবহ যানজট মোকাবেলা করছেন, তারা জানেন, ঢাকার এ-মাথা থেকে ও-মাথা যেতেই ঘন্টা তিন লেগে যায়।   
 
বেইজিংয়ে আমাদের (চীনের কম্যুনিস্ট পার্টির আমন্ত্রণে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া মিডিয়া প্রতিনিধিদল) যেসব স্থানে নিয়ে যাওয়া হয় সে ‍তালিকায়- মহাপ্রাচীর, নিষিদ্ধ নগরী, তিয়ানআনমেন স্কয়ার, নিউজি মসজিদ ছিলো। বহুল পরিচিত মোবাইল ফোন কোম্পানি হুয়াউই’র প্রধান কার্যালয়, জাতীয় জাদুঘর, চায়না রেডিও এবং পিকিং অপেরা দেখতে লিউয়ান থিয়েটারেও যাই।
 
মহাপ্রাচীর:
 
বলা হয়, মহাশূন্য থেকে মানুষের এই কীর্তিটিই শুধু দেখা যায়। সেই বিশাল প্রাচীরে গিয়ে যে কেউ অবাক হবেন। অবাক হয়েছি আমরাও।
 
বিশ্বের নানা জায়গা থেকে পর্যটকরা এসেছেন। শিশু থেকে বৃদ্ধ- কে নেই! প্রচণ্ড শীতের মধ্যে কষ্ট হয়তো একটু পাবেন।

‘তবে প্রস্তুতি ঠিকঠাক থাকলে কষ্ট অনেক কমে যাবে’- বললেন চায়না সেন্টার ফর কনটেম্পরারি ওয়ার্ল্ড স্টাডিজ থেকে আমাদের পথপ্রদর্শক হিসেবে আসা ডা. ঝেং ডংচাও।
 
গাড়ি থেকে নামার সময় ঝেং বলে দিলেন, ‘প্রথমেই নিজেদের নিরাপত্তার বিষয়টি দেখবে, আর কেউ বিচ্ছিন্ন হয়ে যেও না। সবাই একে অন্যকে ফলো করবে। ’
 
ক্যাবল কারে বাডালিং চড়লাম, সেখান থেকে পায়ে হেঁটে উঠতে শুরু করি সবাই। শীতে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হাপিয়ে যাচ্ছিলাম। ভেতরে ঘেমে যাচ্ছি, গলা শুকিয়ে কাঠ, কিন্তু বাইরে হাত-পা-কানে প্রচন্ড ঠাণ্ডা বাতাসের ঝাপটা।
 
মনে মনে আফসোস করছিলাম- খাওয়ার পানির বোতলটি গাড়িতেই ফেলে এসেছি ভুলে।
 
যতদূর ওঠা যায় ততদূর উঠবো বলেই প্রতিজ্ঞা করলাম। হার মানলে হবে? এক সময় দেখলাম চূড়ায় পৌঁছে গেছি।
 
ক্লান্তি ভুলে কিছুটা লজ্জাই পেলাম, যখন দেখলাম বৃদ্ধ-বৃদ্ধারাও উঠে এসেছেন। অতদূর উঠেও হাসিমুখে দেখছিলেন চারদিক। কী অসাধারণ জীবনীশক্তি! তাদের গোড়ালির বয়সী আমরা হাপাই কী করে!
 
বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী এসেছেন ‘গ্রেট ওয়াল’ দেখতে। একজনের নাম লুসি। বাংলাদেশ থেকে আসা অতিথি শুনে হাসিমুখে ইংরেজিতেই অভিবাদন জানালেন তারা।
 
(এখানে বলে রাখা ভালো- ইংরেজি বলতে পারেন না বা চান না চীনের অধিকাংশ নাগরিক। তাই টুকটাক কিছু বিষয় তাদের ভাষায় লিখে সঙ্গে রাখতে পারেন। )
 
নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বর, হোটেলের ঠিকানা, গাইডের সঙ্গে যোগাযোগের উপায় লিখে রাখতে পারেন। পানি, টয়লেট, খাবারসহ যে শব্দগুলো ব্যবহারের প্রয়োজন হবে, সেগুলো মুখস্ত করে রাখতে না পারলেও লিখে রাখাটা ভালো। )
 
‘তোমাদের মহাপ্রাচীরেতো মহাঠাণ্ডা, লুসি! মনে হচ্ছে, এখানেই মারা যাব!’- শীতে কাঁপতে কাঁপতে বললাম।
 
কথা শেষ না হতেই আগলে নিল লুসি ও তার বন্ধুরা, যেন ঠান্ডা দূর করে দেবে এক নিমিষে। আন্তরিকতায় আপ্লুত হলাম।  
 
নিষিদ্ধ নগরী:
 
ঘুরে ঘুরে দেখুন নিষিদ্ধ নগরী। মিং রাজা নাকি বিস্তর জায়গাজুড়ে তার বংশধরদের জন্য গড়েছিলেন এই রাজপ্রাসাদ। রাজার অনুমতি ছাড়া কেউ সেখানে প্রবেশ বা প্রস্থান করতে পারতেন না বলেই এর নাম নিষিদ্ধ নগরী।
 
এটি একটি ছোট্ট শহরের মতো, কাঠের তৈরী অপূর্ব মহল, কারুকার্যশোভিত। প্রথম দেখায় একরকম মনে হলেও কিছুক্ষণ পর বিভ্রম কাটবে। ভিন্নরকম করে গড়া হয়েছে প্রাসাদগুলো। ঘুরে ঘুরে এগুলো দেখতে ছোট গাড়ি ভাড়া করতে পারবেন সেখানে।
 
দেশে ফিরে স্মৃতিচারণ করতে টুপি, খাবার, খেলনাসহ স্যুভেনির কিনতে পারেন সিটিতে ঢোকা বা বের হওয়ার পথে।
 
তিয়ানআনমেন স্কয়ার
 
এটি অনেক আলোচিত ও পরিচিত একটি স্থান। এ নিয়ে পড়াগুলো আওড়ালাম মনে মনে, ‘এই সেই স্কয়ার, যেখানে গণতন্ত্রের দাবিতে ২৫ বছর আগে (১৯৮৯ সালে) শত শত মানুষ বিক্ষোভ করে। ছাত্র-ছাত্রী থেকে শুরু করে শ্রমিক- অনেকেই ছিলেন বিক্ষোভে। এক পর্যায়ে নিরাপত্তা বাহিনীর হামলার শিকার হন তারা। নিহত হন অনেকে। ’
 
(গত জুনেও তিয়ানআনমেন স্কয়ারের ঘটনার ২৫ বছরকে কেন্দ্র করে পরিস্থিতি কিছুটা উত্তপ্ত হয়ে ওঠে বেইজিং-এ। তার প্রভাব এখনো পুরোপুরি কাটেনি। জুনে ইন্টারনেট সার্চ ইঞ্জিনে অবরোধ বসায় চীন প্রশাসন। যার ফলে আমরা সফরের পুরো সময়টিতে গুগলসহ বিভিন্ন সুবিধা পাচ্ছিলাম না। )
 
নিউজি মসজিদ
 
চীনের সবচে পুরনো আর সর্ববৃহৎ মসজিদ এটি। ৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে এটি নির্মিত।
 
ঢুকতেই সালাম দিলেন উপস্থিত রক্ষণাবেক্ষণকারী। ভেতরে শীতল, অভিজাত একটি শান্তি শান্তি ভাব। অনেক যত্ন করে পুরনো রূপটাই যেন ধরে রাখার চেষ্টা রয়েছে মসজিদে।
 
আমাদের পথ প্রদর্শক মিস নীয়ে জানান, একসঙ্গে এক হাজার মুসল্লি এখানে একসঙ্গে নামাজ পড়তে পারেন। কাঠের তৈরি এই মসজিদে আরবি ও চীন ভাষার সংমিশ্রণে কারুকার্য করা।
 
নারী-পুরুষের জন্য স্বাভাবিকভাবেই ওযুর আলাদা ব্যবস্থা রাখা আছে। আমার সফরসঙ্গীরা সুযোগে একটু ফ্রেশও হয়ে নিলেন।
 
পিকিং অপেরা
 
সন্ধ্যায় অপেরা দেখতে লিউয়ান থিয়েটার গেলাম সবাই। কাহিনীর বর্ণনায় সাব-টাইটেল দেওয়া হচ্ছিল দুই পাশেই। কিন্তু লক্ষ্য করলাম একদম শেষে।
 
অবশ্য ভালোই হল। কারণ কল্পনায় বুঝে নিলাম, এক খারাপ রাজা রাজকণ্যার রাজত্ব দখল করতে আসে। কিন্তু রাজকণ্যা ঠিকই তার সাম্রাজ্য রক্ষা করেন বুদ্ধিমত্তা আর বীরত্বে।
 
শিল্পীদের পোশাক দৃষ্টি কেড়ে নিল। নানা রঙের বাহারি পোশাক পরে মঞ্চ আলো করছিলেন তারা। সবচে পছন্দ হল রাজকন্যার মাথার দু’পাশের শিং-এর মতো যে বস্তুটি দুলছিল, সেটি। ভাবছিলাম, মানুষের এমন লম্বা শিং থাকলে ঢাকার ফুটপাতে হাঁটা মুশকিল হত, এর-ওর গায়ে শিং-এর খোঁচা লাগতো!
 
হুয়াউই মোবাইল কোম্পানি
 
অত্যাধুনিক একটি অফিস, যেন টাইম মেশিনে চড়ে ভবিষ্যতে চলে এসেছি।
 
কর্মকর্তা ফিলিপ ঘুরে ঘুরে অফিসের সব দেখালেন। পুলিশ ও ফায়ার ব্রিগেড কর্মীদের আধুনিক পোশাক, যেকোনো বৃহ‍ৎ পরিসরের কার্যালয় বা মন্ত্রণালয়ে মনিটরিং-এর জন্য বড় স্ক্রিণের আধুনিক রূপ দেখালেন ফিলিপ।
 
এছাড়া বাংলাদেশে তাদের দেওয়া বিভিন্ন সেবা এবং ভবিষ্যতে কী সেবা দিতে পারেন, সেগুলোও তুলে ধরলেন।
 
এছাড়া শীতের বেইজিং-এ পাতা ঝরার দৃশ্যও দেখার মতো। শীতের কাপড় পরে রাস্তায় হাঁটতে বের হতে পারেন পছন্দের মানুষটিকে নিয়ে। ঝরা পাতার স্পর্শ গায়ে লাগবে। কিংবা বরফ থেকে গাছ বাঁচাতে কীভাবে গাছগুলোকে সুতো বা কাপড়ে পেঁচিয়ে রাখছেন চীনা বৃদ্ধা, সেটাও দেখতে ভালো লাগবে।   
 
বাংলাদেশ সময়: ১৮০৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৯, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।