ঢাকা, শনিবার, ১৯ আশ্বিন ১৪৩১, ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ০১ রবিউস সানি ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

পূর্ণিমায় মেঘের সীমান্তে

সমির মল্লিক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৪৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩, ২০১৪
পূর্ণিমায় মেঘের সীমান্তে

রাঙামাটি থেকে ৭২ কিলোমিটার দূরে ছোটহরিণা বাজার। ছোটহরিণা যাওয়ার একমাত্র উপায় নৌপথ।

বরকলের আকাশে সূর্যাস্ত দেখার ইচ্ছে অনেক দিনের। ভারতের সীমান্ত থেকে বয়ে আসা কর্ণফুলীর মূল স্রোত বরকল হয়ে শুভলংয়ে এসে কাপ্তাই লেকে মিশে গেছে। কর্ণফ‍ুলীর মোহানায় দাঁড়িয়ে থাকা উঁচু পাহাড়ের গাঁয়ে ঢলে পড়া সূর্যটা যে কতো সুন্দর হতে পারে! সেই সঙ্গে শেষ বিকেলে নদীর পাড়ের কাশবনে সাত রংয়ের বাহারী রঙধনু।

সকালের কুয়াশা মোড়ানা স্নিগ্ধতাকে সঙ্গী করে মোটরবাইকে রওনা হলাম দিঘীনালা থেকে, আঁকা বাঁকা সরু পাহাড়ি জনপদ পেরিয়ে ১ ঘণ্টায় পৌঁছে যাই লংগদু বাজারে। এখান থেকেই ধরতে হবে শুভলংয়ের লঞ্চ। লংগদু থেকে শুভলং যেতে সময় লাগে প্রায় ৩ ঘণ্টা। লংগদু বাজারে প্রাতঃরাশ শেষ করে রওনা হলাম লঞ্চে। লংগদু থেকে অল্প দূরত্বে কাট্টলি বিল। সুমুদ্র সদৃশ বিশাল জলরাশির বুকে দ্বীপের মতো কাট্টলি বাজার। চারপাশে লেকের নীল জলরাশি।

কাপ্তাই লেকের পানিতে শীতের আগমনী জানিয়ে দেয় মিষ্টি কুয়াশা। আমাদের গন্তব্য বরকলের শেষ বাজার ছোটহরিণা। নামেই পরিচয়, তাই যাত্রাপথ আর সময় সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা নিলাম লঞ্চের মাস্টার আল আমিনের কাছ থেকে।

লংগদু হয়ে আমাদের যেতে হবে শুভলং বাজার, সেখান থেকে দুপুর আড়াইটায় বরকলের লঞ্চ ধরতে হবে। বরকল হয়ে হরিণা যেতে সময় লাগবে ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা। এতো দীর্ঘ পথ এই লঞ্চ থাকতে হবে ভেবে খুব ভালো লাগলো। একদিনের মধ্যে ১০ ঘণ্টার লঞ্চ জার্নি!

শুভলং থেকে আমাদের লঞ্চ যাত্রা শুরু। কাপ্তাই লেকের কোল ঘেঁষে থাকা পাহাড়, দলছুট বাড়ি, নীল জলরাশির ভিড়ে কোথাও কোথাও পাখির ঝাঁক।

বিকেলে বরকল বাজারে কিছুক্ষণের যাত্রা বিরতি। হাতে ১০ মিনিট সময়, এরই মাঝে ঘুরে দেখলাম বরকল বাজার। ছোট ছিমছাম বাজার। বিদ্যুৎ সংযোগ নেই, সৌরবিদ্যুৎ একমাত্র ভরসা। একপাশে কর্ণফুলীর স্রোতধারা, অন্যপাশে উ‍ঁচু পাহাড়। নদী পাহাড় ঘেঁষে বরকল বাজার।

লঞ্চ যখন বরকল ছেড়ে ছোট হরিণার দিকে যাত্রা আরম্ভ করলো তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। বরকল বাজার পাড়ি দিতে না দিতেই চোখ ধাঁধানো সব ল্যান্ডস্কেপ । পাহাড়ের পাদদেশেই সব বাড়ি।

মেঘের ছায়ায় ঢেকে যায় গ্রামগুলো। কাশবন ঘেঁষা পাহাড়ের কোলজুড়ে রঙধনুর রেখা সবুজ পাহাড়কে যেন আরো উজ্জ্বল করে তুলেছে।

লঞ্চের বেশিরভাগ যাত্রীর গন্তব্য ছোটহরিণা, একদিন পরেই ছোটহরিণার সাপ্তাহিক বাজার। শেষ বিকেলে শান্ত জলপথ, মাথার উপর সন্ধ্যার উজ্জ্বল আকাশ। একটু পরেই পূর্ণিমার আলোয় ডুবে গেলো নীরব পাহাড়। কর্ণফুলীর দু’ধারে এমন নীরবচ্ছিন্ন পাহাড়ের সারি আর কোথাও পাওয়া যাবে না। ধবধবে জোৎস্নার আলোয় আলোকিত কর্ণফুলীর পথ ধরে লঞ্চ যাত্রাটা স্বপ্নপুরী যাত্রার মতো মনে হয়।

পথে পথে স্থানীয় যাত্রীদের ওঠানামায় লঞ্চ ভিড়ছে বিভিন্ন ঘাটে। আমাদের রাতে থাকার ব্যবস্থা ভূষণছড়া বাজারে, বাজারের সামাদ চাচার কাঠের বোর্ডিংয়ে। সামাদ চাচার মতে আমারাই এখানে প্রথম ট্যুরিস্ট।

সামাদ চাচার বাসাতেই আমাদের রাতের খাবারের আয়োজন হলো। সারা রাত জোৎস্নার আলোয় আলোকিত এই দূর গ্রামে রাত কাটিয়ে খুব ভোরে রওনা হই ছোটহরিণার পথে।

 অদূরের পাহাড়গুলো সাদা কুয়াশার চাদরে মোড়ানো, নদীর বুকে টলটলে পানি। মোটরবাইকে কিছুটা পথচলা, বাকিটা হেঁটে আর খেয়া পার হয়ে পৌঁছে যাই ছোট হরিণায়।

কর্ণফুলীর তীরে পাহাড়ের উপর ছোটহরিণা বাজার। পাহাড় ঘিরে সকালের মেঘ। মনে হচ্ছে মেঘের দোলনায় শুয়ে আছে বাংলাদেশের এই সীমান্তবর্তী ছোট বাজার। দুর্গম পাহাড়ি জনপদে হরিণা বাজার বেশ জনপ্রিয়। বাজারের পাশেই বিজিবি ক্যাম্প। ছোট হরিণার পর কোনো বাঙালি প্রবেশের অনুমতি নেই। কড়া নিষেধাজ্ঞা। এর পর মিজোরামের সীমান্তবর্তী দেমাগ্রী, শ্রীনগর, বড়হরিণা, ভাল্লুকছড়ি, টেগামুথ। আর এসব এলাকায় কেবল আদিবাসীরা চলাচল করতে পারে।

স্থানীয়রা বলেন, আদিবাসীরা নৌপথে টেগামুখ সীমান্ত দিয়ে মিজোরামের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। আলাদা আলাদা দু’দেশের পতাকা নিয়ে নৌকা চলাচল করে সীমান্তবর্তী অঞ্চলসমূহে।

অনেক চেষ্টা তদবির করেও শ্রীনগর যাওয়ার অনুমতি মিলল না। অগত্যা ফেরার পালা। ছোট হরিণা থেকে সকাল ৮টার লঞ্চে যাত্রা শুরু করে শুভলং হয়ে লংগদু পৌঁছালাম শেষ বিকেলে। এত প্রাপ্তির ভিড়ে দেমাগ্রী, শ্রীনগর, বড়হরিণা, ভাল্লুকছড়ি, টেগামুথ সীমান্ত পথগুলো ভেসে ওঠে কল্পনার ছবিতে।

এক মেঘের সীমান্ত ধরে নতুন কোনো সূর্যাস্ত দেখার স্বপ্নজাল বোনা শুরু হলো।

প্রিয় পাঠক, ভ্রমণ যাদের নেশা, বেড়ানোর সুযোগ এলে যারা উড়িয়ে দেন সব বাধা, কাজের অংশ হিসেবে যারা ভ্রমণ করেন কিংবা যাদের কালেভদ্রে সুযোগ হয় ভ্রমণের তারা সবাই হতে পারেন ট্রাভেলার্স নোটবুক’র লেখক। আপনার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারেন বাংলানিউজের পাঠকদের সঙ্গে।

আর একটা কথা লেখার সঙ্গে ছবি পাঠাতে ভুলবেনই না, সেই সঙ্গে বাতলে দিন সেখানে যাওয়ার পথঘাটের বিবরণও।  

প্রিয় পাঠক, আপনার ভ্রমণ আনন্দ বিশ্বজুড়ে বাঙালির কাছে ছড়িয়ে দিতে আমাদের ই-মেইল করুন-



বাংলাদেশ সময়: ১৬৫০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৩, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।