ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

পর্যটন

ঘুরে আসুন ‘দক্ষিণের স্বর্গ’ সেন্টমার্টিন

মঈন উদ্দিন, রাবি করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০২৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২, ২০২১
ঘুরে আসুন ‘দক্ষিণের স্বর্গ’ সেন্টমার্টিন সেন্টমার্টিন, ছবি: বাংলানিউজ

সেন্টমার্টিন থেকে ফিরে: সেন্টমার্টিন, বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ। যার চারপাশে সাগর আর আকাশের নীল মিলেমিশে একাকার।

খোলা-মেলা বালুকাময় সমুদ্র সৈকত আর সমুদ্রের বিরামহীন গর্জন যেন নীল রঙের রাজ্যে পরিণত করেছে সেন্টমার্টিন। প্রকৃতি দুই হাত মেলে যেন সৌন্দর্য ঢেলে দিয়েছে এখানে।  

‘দক্ষিণের স্বর্গ’ নামে পরিচিত এই দ্বীপে সারি সারি নারিকেল গাছ, ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে চলা গাঙচিল। সৈকতে বসে স্নিগ্ধ বাতাসে গা জুড়িয়ে নেওয়া, কেয়া বন আর সাগরলতার মায়াময় স্নিগ্ধতায় মন জুড়িয়ে যায় নিমিষেই। বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল ধ্রুবতারা নন্দিত কথা সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ অবকাশ যাপনের জন্য পছন্দের শীর্ষে রেখেছিলেন অনিন্দ্য সুন্দর এই দ্বীপকে।

দেশের ভ্রমণ পিপাসুদের কাছে পরম আরাধ্য একটি পর্যটন গন্তব্য হচ্ছে সেন্টমার্টিন দ্বীপ। সেন্টমার্টিনের প্রতিবেশ ব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দু হলো প্রবাল। সাগরের ছোট-বড়, মেরুদণ্ডী-অমেরুদণ্ডূ অধিকাংশ প্রাণী ও উদ্ভিদকে আগলে রাখে এসব প্রবালসমৃদ্ধ দ্বীপ।

ভাটায় জেগে ওঠা নান্দনিক প্রবাল প্রাচীর, উড়ে চলা গাঙচিল, পশ্চিম বিচ থেকে দেখা সূর্যাস্তের অপরূপ সৌন্দর্য, স্নিগ্ধ বাতাস আর অগভীর সাগরের স্বচ্ছ নীল জলে দল বেঁধে বাধ ভাঙা উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠার লোভে প্রতিবছর পর্যটন মৌসুমে লাখ লাখ পর্যটক পদচিহ্ন আঁকেন এ দ্বীপে।  

বাংলাদেশের মানচিত্রের সর্বদক্ষিণের শেষ স্থান সেন্টমার্টিন দ্বীপ। নয়নাভিরাম সৌন্দর্য অবলোকনের ও ভ্রমণের একটি আকর্ষণীয় পর্যটন এলাকা। কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলা থেকে ৯ কিলোমিটার দক্ষিণে গড়ে ওঠা ছোট দ্বীপ এটি। মিয়ানমারের উত্তর-পশ্চিম উপকূল থেকে ৮ কিলোমিটার পশ্চিমে নাফ নদীর মুখে এর অবস্থান। স্থানীয়রা এটিকে ‘নারিকেল জিনজিরা’ নামে চেনেন। সেন্টমার্টিন দ্বীপের আয়তন প্রায় ৮ বর্গ কিলোমিটার ও উত্তর-দক্ষিণে লম্বা। এ দ্বীপের তিন দিকের ভিত শিলা যা জোয়ারের সময় তলিয়ে যায় এবং ভাটার সময় জেগে ওঠে।  

এগুলোকে ধরলে এর আয়তন হবে প্রায় ১০-১৫ বর্গ কিলোমিটার। এ দ্বীপটি উত্তর ও দক্ষিণে প্রায় ৫ দশমিক ৬৩ কিলোমিটার লম্বা। দ্বীপের প্রস্থ কোথাও ৭০০ মিটার আবার কোথাও ২০০ মিটার।  

দ্বীপটির পূর্ব, দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে সাগরের অনেক দূর পর্যন্ত অগণিত শিলাস্তূপ আছে। সেন্টমার্টিন দ্বীপ সমতল ও সমুদ্রপৃষ্ঠের গড় উচ্চতা থেকে ৩ দশমিক ৬ মিটার ওপরে। মূল ভূখণ্ড ও দ্বীপের মধ্যবর্তী ৯ দশমিক ৬৬ কিলোমিটার প্রশস্ত প্রণালী দ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিমের উন্মুক্ত সাগরের তুলনায় অনেক অগভীর। এখানে পশ্চিম-উত্তর-পশ্চিম দিক জুড়ে রয়েছে ১০-১৫ কিলোমিটার প্রবাল প্রাচীর।  মূল দ্বীপ ছাড়াও এখানে ১০০ থেকে ৫০০ বর্গমিটার আয়তন বিশিষ্ট কয়েকটি ক্ষুদ্র দ্বীপ রয়েছে, যেগুলোকে স্থানীয়ভাবে ছেড়াদিয়া বা সিরাদিয়া (ছেঁড়া দ্বীপ) নামে অভিহিত করা হয়। যার অর্থ বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। ছেঁড়া দ্বীপ হলো বাংলাদেশের মানচিত্রে দক্ষিণের সর্বশেষ বিন্দু। দক্ষিণ দিকে এর পরে বাংলাদেশের আর কোনো ভূখণ্ড নেই।  

মূল দ্বীপের সঙ্গে ছেঁড়া দ্বীপের সংযোগস্থল (স্থানীয়ভাবে গলাচিপা নামে পরিচিত) সামান্য নিচু হওয়ায় জোয়ারের সময় এটি তলিয়ে যায়। তাই ভাটার সময় হেঁটে ছেঁড়া দ্বীপে যাওয়া গেলেও জোয়ারের সময় নৌকা নিয়ে যেতে হয়। সবচেয়ে ভালো হয় উত্তর প্রান্ত থেকে পশ্চিম বিচ ধরে সম্পূর্ণ পথ পায়ে হেঁটে গেলে। নির্জন এই পথটা অসম্ভব সুন্দর।  

সেন্টমার্টিন দ্বীপটির ভূপ্রকৃতি প্রধানত সমতল। তবে কিছু কিছু বালিয়াড়ি দেখা যায়। দ্বীপ ও দ্বীপসংলগ্ন সমুদ্র মিলিয়ে উদ্ভিদ ও প্রাণীর সংখ্যাও অনেক।

প্রবাল দ্বীপে শৈবাল সম্ভাবনা ‘সামুদ্রিক শৈবাল’একটি গুরুত্বপূর্ণ জলজ সম্পদ। স্থানীয়ভাবে ‘পেজালা’ নামে পরিচিত এক ধরণের সামুদ্রিক শৈবাল সেন্টমার্টিনে প্রচুর পাওয়া যায়।

সেন্টমার্টিন প্রবাল দ্বীপে প্রায় ৬৬ প্রজাতির প্রবাল, ১৮৭ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক, ১৫৩ প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবাল, ১৫৭ প্রজাতির গুপ্তজীবী উদ্ভিদ, ২৪০ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, ৪ প্রজাতির উভচর ও ১২০ প্রজাতির পাখি পাওয়া যায়। এছাড়াও রয়েছে ১৯ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী।

অমেরুদণ্ডী প্রাণীদের মধ্যে রয়েছে- স্পঞ্জ, শিল কাঁকড়া, সন্ন্যাসী শিল কাঁকড়া, লবস্টার ইত্যাদি। মাছের মধ্যে রয়েছে- পরী মাছ, প্রজাপতি মাছ, বোল করাল, রাঙ্গা কই, রূপচাঁদা, সুঁই মাছ, লাল মাছ, উড়ুক্কু মাছ ইত্যাদি। সামুদ্রিক কচ্ছপ সবুজ সাগর কাছিম এবং জলপাইরঙা সাগর কাছিম প্রজাতির ডিম পাড়ার স্থান হিসেবে জায়গাটি খ্যাত।

দ্বীপের বালির মধ্যে দেখা যায় গোলাকার পাতার আইপোমিয়া লতা। প্রতিকূল পরিবেশে প্রথম প্রাণের স্পন্দন সৃষ্টিকারী এই উদ্ভিদে ফানেল আকৃতির সাদা-বেগুনি ফুল দেখা যায়। অন্যান্য উদ্ভিদের মধ্যে রয়েছে- কেয়া, শ্যাওড়া, সাগরলতা, বাইন গাছ ইত্যাদি। বৃক্ষ জাতীয় গাছের মধ্যে অন্যতম হলো নারিকেল গাছ। আরও রয়েছে- শিমুল, আম, সুপারি, বাবলা, কড়ই ইত্যাদি।  সেন্টমার্টিন দ্বীপের ঐতিহ্যবাহী উদ্ভিদ হলো কেয়া গাছ। দ্বীপে কেওড়া বন ছাড়া প্রাকৃতিক বন বলতে যা বোঝায় তা নেই। ভাটার সময় পাথুরে প্রবালের মাঝে প্রাণের সাড়া দেয় কেওড়া গাছ। তবে দ্বীপের দক্ষিণ দিকে প্রচুর পরিমাণে কেওড়ার ঝোপ-ঝাড়সহ কিছু ম্যানগ্রোভ গাছও দেখা যায়। সৈকতের প্রান্তজুড়ে আরও দেখা যায় বেশ কিছু ঝাউ গাছ।  

দ্বীপের জনসংখ্যা প্রায় ১২ হাজার। এখানে জীবন-জীবিকা মাছ ধরা, শুটকি প্রকৃয়াকরণ, সামান্য চাষাবাদ ও পর্যটন সেবার ওপর নির্ভরশীল। প্রতি বছর পর্যটন মৌসুমে (অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত) দ্বীপটি কর্মচঞ্চল থাকে। সেন্টমার্টিন দ্বীপের মানুষ নিতান্ত সহজ-সরল, তাদের উষ্ণ আতিথেয়তা পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ।

কীভাবে যাবেন: বাংলাদেশের যেকোনো স্থান থেকে সেন্টমার্টিন যাওয়ার জন্য প্রথমে যেতে হবে কক্সবাজার। ঢাকা থেকে বাসে করে সরাসরি টেকনাফে যাওয়া যায়। ঢাকার ফকিরাপুল ও সায়েদাবাদ থেকে বিভিন্ন পরিবহনের বাস সরাসরি টেকনাফ যায়। ১০-১২ ঘণ্টার এই ভ্রমণে ভাড়া বাস অনুযায়ী সাধারণত ৯০০ থেকে ২ হাজার টাকার মধ্যে হয়ে থাকে। অথবা ঢাকা থেকে প্রথমে কক্সবাজার এসে তারপর কক্সবাজার থেকে টেকনাফ যাওয়া যাবে। এছাড়াও ঢাকা থেকে প্লেনে সরাসরি কক্সবাজার যাওয়া যায়।

কক্সবাজার থেকে লোকাল বাস, সিএনজি বা মাইক্রোবাস/জিপ ভাড়া করে টেকনাফ যাওয়া যাবে। কক্সবাজার থেকে টেকনাফ যেতে সময় লাগে অবস্থা ভেদে প্রায় ১-২ ঘণ্টা। ভাড়া যানবাহন ভেদে ১৫০ থেকে ৩০০ টাকার মধ্যে হয়ে থাকে।

পর্যটন মৌসুমে (অক্টোবর থেকে মার্চ মাস) টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিনে যাত্রী পারাপারে ৬-৭টি জাহাজ চালু থাকে। এগুলোর মধ্যে কেয়ারি সিন্দাবাদ, কেয়ারি ক্রুজ অ্যান্ড ডাইন, আটলান্টিক, বে ক্রুজ, কর্ণফুলী, গ্রিন লাইন উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও এই সমুদ্র রুটে বেশ কিছু ট্রলার ও স্পিডবোট চলাচল করে।  

জাহাজে করে টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন যেতে সময় লাগে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা। জাহাজের শ্রেণীভেদে যাওয়া-আসার ভাড়া ৫৫০ থেকে ১ হাজার টাকার মতো। সেন্টমার্টিনের জেটি ঘাট থেকে প্রতিদিন জাহাজগুলো সকাল সাড়ে ৯টার দিকে সেন্টমার্টিনের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায় এবং সেন্টমার্টিন থেকে ফেরত আসে বিকেল ৩টার দিকে।  
কোথায় খাবেন: পর্যটকদের খাবারের জন্য রয়েছে এখানে বেশ কিছু হোটেল ও রেস্তোরাঁ। সন্ধ্যা বেলা হোটেল-রেস্তোরাঁর সামনে পথের দু’ধারে, সৈকতের পাশে নানা রকম মাছ, কাঁকড়া, অক্টোপাস সাজিয়ে বসে দোকানিরা। তেলে ভাজা মাছের সুগন্ধে চারদিক মৌ মৌ করে। রাতে প্রায় সব হোটেলের আঙিনায় চলে মাছের বার্বিকিউ উৎসব।

কোথায় থাকবেন: সেন্টমার্টিনে থাকার জন্য বেশ উন্নতমানের কয়েকটি হোটেল ও কটেজ রয়েছে। অনেক বাড়িতেও আছে পর্যটকদের জন্য থাকার ব্যবস্থা। এছাড়া তাঁবুতে থাকার ব্যবস্থাও রয়েছে। নিজের সাধ্যমতো যেকোনো একটি বেছে নিতে পারেন। তবে অবশ্যই ভাড়া আগে মিটিয়ে নিতে হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১০১৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০২, ২০২১
এসআরএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।