ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

এভিয়াট্যুর

বিপজ্জনক বিমানবন্দর নিয়ে ক্ষুব্ধ নেপালিরাও

ইকরাম-উদ দৌলা, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫১৪ ঘণ্টা, মার্চ ২১, ২০১৮
বিপজ্জনক বিমানবন্দর নিয়ে ক্ষুব্ধ নেপালিরাও বিশাল পাহাড়শ্রেণী ডিঙিয়ে নিচে নেমে ত্রিভুবন বিমানবন্দরে অবতরণ করতে হয় প্লেনগুলোকে।/ভিডিও-ইকরাম- উদ দৌলা

নেপাল থেকে: ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বিকেল ৩টায় কাঠমাণ্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উদ্দেশে ছেড়ে যায় রিজেন্ট এয়ারওয়েজের ফ্লাইট আরএক্স-৭৯৫। পাইলট ক্যাপ্টেন রহমতের পক্ষ থেকে বলা হলো, আবহাওয়া ভাল, তবে বাতাসের কারণে হালকা ঝাঁকি লাগতে পারে। বাংলাদেশ সময় বিকেল ৪টা ১৫ মিনিটে ত্রিভুবন বিমানবন্দরে অবতরণ করবে উড়োজাহাজ।

ঘণ্টাখানেক চলার পর পাইলটের ঘোষণা, ‘ত্রিভুবন বিমানবন্দর থেকে আমরা ৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে আছি। বিমানবন্দরে পাঁচটি প্লেন ল্যান্ডিং অ্যাপ্রোচে আছে।

তাই এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল (এটিসি) থেকে আকাশে চক্কর দিতে বলা হয়েছে। ১৫ মিনিট আমাদের আকাশে ঘুরতে হবে। ’

তখনও যাত্রীরা সব স্বাভাবিকই আছেন। ১৫ মিনিট পরে নামতে হবে। তাই সবাই জানালার ফাঁক দিয়ে হিমালয়ের দেশ নেপালের পর্বতমালা, নদীসহ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখার চেষ্টা করছেন। কেউ মোবাইল ফোনে ছবি তুলছেন, কেউবা করছেন ভিডিও। এভাবে ১৫ মিনিট পেরোনোর পর আবার পাইলটের ঘোষণা, ‘এটিসি আরও ১০ মিনিট চক্কর দিতে বলেছে। ’ 

ত্রিভুবন বিমানবন্দরের সম্মুখ।  ছবি: জিএম মুজিবুর
যাত্রীদের মাঝে এতোক্ষণ যে আলাপ-সালাপ চলছিল, এ ঘোষণা শোনার পর তা মিইয়ে গেলো। ১০ মিনিট পর পাইলট অবতরণের ঘোষণা দিলেন। প্লেনে তখন পিনপতন নিরবতা। যেন সবাই দাঁতে দাঁত চেপে শক্ত হয়ে গেছেন।

অতিরিক্ত ২৫ মিনিট আকাশে ঘোরার পর ফ্লাইট আরএক্স৭৯৫ স্পর্শ করলো রানওয়ে। কোনো রকম ঝাঁকুনি ছাড়াই আধা মিনিটের মতো চলার পরেই নিরাপদে অবতরণের ঘোষণা এলো। একইসঙ্গে নির্দেশনা এলো, আপনার সিটবেল্ট বাধার সিগন্যালটি নিভে না যাওয়া পর্যন্ত খুলবেন না। এতোক্ষণ গলা প্রায় শুকিয়ে এলেও নিরাপদে অবতরণের ঘোষণায় যাত্রীরা বড় শ্বাস নিতে পারলেন। সবারই কণ্ঠেই আনন্দের ঝিলিক। বড় কোনো অনিশ্চয়তার হাত থেকে রেহাই পাওয়ার আনন্দের।
 
এই ঘটনা ১৭ মার্চের। ১২ মার্চ ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট বিএস২১১ অবতরণকালে বিধ্বস্ত হওয়ার দিন পাঁচেকের মধ্যে আকাশে দীর্ঘ সময় ধরে চক্কর দেওয়া প্লেন থেকে নামতে পারাতো অনিশ্চয়তা জয়েরই মতো।

শুধু এই ফ্লাইটই নয়, ত্রিভুবন এয়ারপোর্টের আকাশে একের পর এক চক্কর দেওয়া ছাড়া কোনো প্লেনই অবতরণ করতে পারে না অনায়াসে। অর্থাৎ বেশিরভাগ ফ্লাইটকেই পাহাড়ঘেরা ত্রিভুবনের আকাশে চক্কর দিতে হয় এটিসির সংকেত না পাওয়া পর্যন্ত।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপে জানা গেলো, হিমালয়-এভারেস্টের দেশের একমাত্র আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ত্রিভুবনে দিনে প্রায় চারশ’ ফ্লাইট ওঠানামা করে। এ কারণে দেখা দেয় ব্যাপক ট্রাফিকের। তারওপর আবার বিমানবন্দরটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৮ হাজার ফুট ওপরে, যেখানে ঢাকা থেকে কক্সবাজারের আকাশে প্লেন এ উচ্চতায় যাতায়াত করে। অর্থাৎ যে উচ্চতায় প্লেন স্বাভাবিকভাবে ওড়ার কথা, ত্রিভুবন বিমানবন্দরে সে উচ্চতায় নামতে হয়। বাংলাদেশ বা এমন সমতলের কোনো দেশ থেকে আসা ফ্লাইটকে এই বিমানবন্দরটির আকাশে গিয়ে অনেক ওপরে ওঠে যেতে হয়। এরপর গতি কমিয়ে নিচে নামতে হয় এটিসির সিগন্যাল মেনে।
 
ব্যাপক ট্রাফিক আর অস্বাভাবিক উচ্চতার পাশাপাশি বিমানবন্দরের অবস্থানের দিক থেকেও রয়েছে সমূহবিপদের আশঙ্কা। ত্রিভুবনের অবস্থান কাঠমান্ডু শহরের একটি পাহাড়ের চাঁদির ওপরে। এর চারপাশের কয়েক নটিক্যাল মাইল দূরেই রয়েছে বিশাল পাহাড়শ্রেণী। কোনো প্লেন যখন অবতরণ করে, তখন সেই পাহাড়ের অনেক ওপরে ওঠে আবার হঠাৎ করেই নিচে নামতে হয়। সে বিপজ্জনক দৃশ্য দূর থেকে দেখলে যে কাউকেই আঁতকে উঠতে হবে। প্রায় ৩০ হাজার ফুট ওপর থেকে হঠাৎ করেই বিমানবন্দরের কাছাকাছি উচ্চতায় নেমে আসা ভয় পাইয়ে দেয় স্থানীয়দেরও।  

ত্রিভুবন বিমানবন্দরের রানওয়ে।  ছবি: জিএম মুজিবুর
পাইলট তার দক্ষতায় অনেক উঁচু থেকে একেবারে নিচে আসার কাজটি সারতে পারলেও রানওয়ে ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা বিপদকে আরও ঘনিয়ে দেয়। এটিসির বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নির্দেশনায় হরহামেশাই বিভ্রান্তিতে ফেলে দেওয়ার বিষয়টি। বিশেষত এই বিমানবন্দরের রানওয়ের দুই প্রান্ত ০২ ও ২০ নির্ধারণে এটিসির নেপালি কর্মকর্তাদের অস্পষ্ট অথবা বিভ্রান্তিমূলক নির্দেশেনা দুর্ঘটনার সৃষ্টি করে, যার সবশেষ উদাহরণ ইউএস-বাংলার বিএস-২১১ ফ্লাইটটি বলে অনেকের অভিমত।  

অবস্থানগত দিক থেকে বিপজ্জনক আর ব্যবস্থাপনাগত দিক থেকে ভীষণ দুর্বলতার কারণেই ‍ত্রিভুবন ‘জগত’র ‘নরক’ হয়ে উঠেছে বলে ধারণা খোদ নেপালিদেরও। তারাও বলছেন, এতো কিছু ঘটে গেলেও কর্তৃপক্ষের টনক নড়ছে না। এর একটা বিহিত হওয়া উচিত।
 
২৬ বাংলাদেশিসহ ৪৯ জনের প্রাণ কেড়ে নেওয়া বিএস২১১ ফ্লাইট বিধ্বস্তের ঘটনা ভীষণ ব্যথিত করেছে নেপালের মানুষকেও। এতে শোকাহত শিল্পী শ্যাম সুন্দর যাদব একটি প্রদর্শনীরও আয়োজন করেন। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, এ ধরনের ঘটনা এমনিতেই কাম্য নয়। কিন্তু এ এয়ারপোর্টে দুর্ঘটনা একটি নিয়মিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় হয়েছে।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী পূর্ণ কুমার বলেন, ‘এটিসিকা গালতি হ্যায়। গভর্নমেন্টকা কাভি নেহি টেনশন হোতা হ্যায়। টু জিরো অর জিরো টু কি লিয়ে ইতনা লোক মারগেয়া! সো, স্যাড। (দুর্ঘটনাটি এটিসির ভুলে হয়েছে। সরকার এ ব্যাপারে কখনো চিন্তা করে না। ২০ আর ০২ এর জন্য এতোগুলো মানুষ মারা গেলো! খুবই দুঃখজনক!)
 
রীনা আগারওয়াল নামের কাঠমান্ডুর এক বাসিন্দা বলেন, ‘বাংলাদেশ শোক পালন কারলিয়া। হামভি চাতাহু। বাট গর্ভনমেন্ট ইজ সাইলেন্ট! (দুর্ঘটনার পর বাংলাদেশ শোক পালন করেছে। আমরাও চাই। কিন্তু সরকার নীরব!)
 
সৌদি আরবে ১৪ বছর ট্যাক্সি চালিয়ে দেশে চলে এসেছেন রতন পাল। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, এই বিমানবন্দর একেবারে বিপজ্জনক। প্রতিবছর দুর্ঘটনায় মানুষ মরছে। কিন্তু সরকারের কোনো অ্যাকশন নেই।
 
তবে বিষয়গুলোকে তেমন পাত্তা দিচ্ছে না বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। ত্রিভুবন বিমানবন্দরের মহাব্যবস্থাপক রাজকুমার ছেত্রী এ বিষয়ে বাংলানিউজকে বলেন, অবস্থানগত কারণে কিছু ত্রুটি রয়ে গেছে। এর ওপর আমাদের করার কিছু নেই। তবে নানা ব্যাবস্থা নেওয়ার পর দুর্ঘটনা আগের চেয়ে কমে এসেছে। রানওয়ে বাড়ানোর কোনো জায়গা নেই। একটি রানওয়ে দিয়ে ফ্লাইট ওঠা-নামা করে। তাই ট্রাফিক একটু বেশি। কিন্তু এগুলো কোনো সমস্যা নয়।
 
বাংলাদেশ সময়: ২১০০ ঘণ্টা, মার্চ ২১, ২০১৮
ইইউডি/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।