ঢাকা, শুক্রবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

ক্রিকেট

মাশরাফি কি তবে সমালোচনার সহজ শিকার?

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩২৪ ঘণ্টা, জুন ১৫, ২০১৯
মাশরাফি কি তবে সমালোচনার সহজ শিকার? মাশরাফি বিন মর্তুজা

ত্রিদেশীয় সিরিজের শিরোপা জেতার স্বাদ নিয়ে ২০১৯ বিশ্বকাপে পা রেখেছিল বাংলাদেশ। ওই সিরিজের বাকি দুই প্রতিপক্ষ ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও আয়ারল্যান্ডকে মুখোমুখি হওয়া সব ম্যাচেই হারিয়েছিল মাশরাফির দল। এটাই বাংলাদেশের প্রথম কোনো ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্ট জয়। সেই আনন্দ আরও বেড়ে যায় বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচেই পাওয়া জয়ে।

কিন্তু পরের দুই ম্যাচ শেষে যেন সব আলো উধাও! চারদিক অন্ধকার করে ছুটে এলো সমালোচনার ঝড়। এই ঝড়ের মূল শিকার হলেন টাইগার ওয়ানডে দলপতি মাশরাফি বিন মর্তুজা।

চলতি বিশ্বকাপে নিজদের তৃতীয় ম্যাচে ইংলিশদের কাছে ১০৬ রানের বিশাল পরাজয় বরণ করেছে বাংলাদেশ। ওই ম্যাচে দলের বোলারদের যখন ইংলিশ ব্যাটসম্যানরা নাভিশ্বাস তুলে ছাড়ছেন, সেসময় সেসময় ৫০ বলে ৫১ রানের ঝড়ো ইনিংস খেলা জনি বেয়ারস্টোকে আউট করে ব্রেক থ্রু এনে দেন মাশরাফি। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। বিশাল সংগ্রহের দ্বারপ্রান্তে তখন ইংলিশরা প্রায় পৌঁছে গেছে।

ও হ্যাঁ, বেয়ারস্টো’র ওই উইকেটটি এবারের বিশ্বকাপে মাশরাফির প্রথম উইকেট। তাও ৬৮ রান খরচ করে। নিজের শেষ ওভারে ১৮ রান খরচ না দিলে ৯ ওভারে ১ উইকেটে ৫০ রান। খুব একটা খারাপ না। কিন্তু তিনি ডেথ ওভারে বল করার ঝুঁকি নিয়েছেন। কিন্তু তা কাজে লাগেনি। ফলে সমালচনার ঝড় তার দিকেই ধেয়ে এসেছে।

সাকিব ছাড়া দলের বাকিদের অবস্থাও সেদিন তার চেয়ে খুব একটা ভালো ছিল না। কিন্তু সব দোষ তার ঘাড়েই চাপানোর চেষ্টা করলেন কিছু সমর্থক। তার অধিনায়কত্ব, এমনকি একাদশে জায়গা পাওয়া নিয়েও দেখা দিলো নানান প্রশ্ন। তাছাড়া দলে রুবেলকে না নেওয়া এখন সমালোচকদের কাছে বড় ইস্যু। অথচ এই ইংলিশদের কাছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, দক্ষিণ আফ্রিকাও পাত্তা পায়নি। দক্ষিণ আফ্রিকা হেরেছে ১০৪ রানে, উইন্ডিজ হেরেছে ৮ উইকেটে। ইংলিশরা এবার সবচেয়ে ফেভারিট আর তারা স্বাগতিকও- এটা সবাই যেন ভুলেই গেছে। এই ইংলিশরা বাকি দলগুলোর বোলারদের উপরও সমান ছড়ি ঘুরিয়েছে। কিন্তু সমালোচনার পাত্র যেন শুধুই বাংলাদেশ দল আর মাশরাফি।

মাশরাফিকে সবচেয়ে বেশি সমস্যা পোহাতে হচ্ছে তার রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে। তিনি এখন সংসদ সদস্য। এই বিষয়টাকে অনেকে মেনেই নিতে পারছেন না। অনেকে বলছেন, ক্ষমতা খাটিয়ে তিনি নেতৃত্ব চালিয়ে যাচ্ছেন। এসব অভিযোগ কোনো ক্রিকেট বিশেষজ্ঞ কিংবা সাবেক ক্রিকেটাররা করছেন না, বরং দেশের ক্রিকেটভক্তদের একটা অংশ প্রতিনিয়ত তাকে আক্রমণ করে যাচ্ছেন। এক্ষেত্রে আবাগের কোনো সীমারেখা মানছেন না তারা। এমনকি দেশের ক্রিকেটে মাশরাফির অবদানের কথাও তারা বেমালুম ভুলে যাচ্ছেন।

এখন কথা হচ্ছে, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে বিচরণ সহজ হওয়ায় কি তাহলে মাশরাফিকে আক্রমণ করা সহজ হয়ে গেছে? কথাটা কিছুটা সত্য তো অবশ্যই। যিনি কোনোদিন ব্যাট ধরেই দেখেননি কিংবা বল ছুঁয়ে দেখেননি এমনকি মাশরাফির ক্যারিয়ার শুরুর অনেক পরেও যার জন্ম তিনিও অবলীলায় তাকে গালি-গালাজ করছেন। বিশ্বকাপের মতো এত বড় আসরে খেলার সময় এসব যথেচ্ছ সমালোচনা কতটুকু শোভন?

ইনজুরিপ্রবণ ক্যারিয়ারে অনেকবারই শেষ দেখে ফেলেছিলেন মাশরাফি। কিন্তু ফিনিক্স পাখির মতোই বারবার ছাই থেকে জেগে উঠেছেন। নিজের সামর্থ্য আগের মতো নেই, তবু নিজের সেরাটা দিতে কার্পণ্য করেন না। গত পাঁচ বছর ধরে তার ধারাবাহিকতা দেখলেই বোঝা যায় তার প্রচেষ্টা কতটা কাজ করেছে। এই ৩৫ বছর বয়সে আর শত সেলাইয়ে ছিন্নভিন্ন হাঁটু নিয়েও কি অদম্য তার পারফরম্যান্স।

২০১১ বিশ্বকাপে সুযোগ না পাওয়ায় যারা তার ক্যারিয়ার শেষ বলে ধরে নিয়েছিলেন, তাদের মুখে চুনকালি মেখে বিশ্বকাপের ঠিক পরেই অজিদের বিপক্ষে তিনি ৩ উইকেট তুলে নিয়েছিলেন। কিন্তু এরপর আবার ১২ ম্যাচ বাইরে। ২০১১ সাল থেকে বাংলাদেশের ৮৯টি ওয়ানডে ম্যাচের ৩৫-এর বেশি খেলা হয়নি তার। কিন্তু ২০১২ সাল থেকে পরবর্তী ৪ বছরে তিনিই বাংলাদেশের দ্বিতীয় সেরা উইকেটশিকারি। সেই গতি নেই, কিন্তু স্লোয়ার, বলের ভ্যারিয়েশন, কন্ডিশন আর পিচ পড়তে পারার ক্ষমতা মিলিয়ে তিনি এখনো দলের সেরা পেসার।

আজ মাশরাফিকে গালি দিচ্ছেন যারা, তারাই আবার একটা ম্যাচ জিতলেই প্রশংসার তুবড়ি ছোটাবেন এতে কোনো সন্দেহ নেই। হ্যাঁ, খারাপ খেললে অবশ্যই সমালোচনা করতে হবে। তবে সেটা হবে গঠনমূলক। ক্রিকেট নিয়ে যার ন্যূনতম জ্ঞান নেই, তিনিও যদি সমালোচক সেজে বসেন তা দেশের ক্রিকেটের জন্য কোনো মঙ্গল বয়ে আনবে না।

মাশরাফিকে নিয়ে সবচেয়ে ভালো ব্যাখ্যা দিয়েছেন বাংলাদেশের কোচ স্টিভ রোডস।

ক্রিকইনফোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, আমি মনে করি, মানুষ তার প্রতি বেশি কঠোর হচ্ছে। কিছু মানুষের স্মৃতিশক্তি দুর্বল। সে (মাশরাফি) আমাদের জন্য দারুণ কিছু মুহূর্ত এনে দিয়েছে। আমি মনে করি, কিছু দল তাকে টার্গেট বানাচ্ছে, কিন্তু আশা করি, এটা আমাদের জন্য সুফল এনে দেবে। সে ভালো করেই জানে সে কি করছে। এটার মানে হয়তো আমাদের জন্য কিছু উইকেট হতে পারে।

‘আমি মনে করি মাশরাফি একজন সত্যিকারের যোদ্ধা। মানুষ তাকে কিছুটা চাপে ফেলে দেয়। সে ঠিক আছে। আমি মনে করি সে গত ম্যাচে ভালোই বোলিং করেছে, তাও কঠিন সময়ে। ওই সময় আমরা স্পিনারদের আক্রমণে আনতে পারতাম না। সে একজন সত্যিকারের প্রতিদ্বন্দ্বী। তার অনেক গর্ব। আমিও তাকে নিয়ে অনেক গর্বিত। অধিনায়ক কিংবা খেলোয়াড় হিসেবে ম্যাশকে নিয়ে কোনো সমস্যা দেখি না। ’

মাঠে নামার আগে মাশরাফির প্রতিদিনের প্রস্তুতি অন্য সবার চেয়ে আলাদা। বাকিরা যেখানে নেট আর জিমে কাটায় (তিনিও কারও চেয়ে কম সময় কাটান না), তাকে সেখানে প্রায় এক ঘণ্টা সময় কাটাতে হয় পায়ের টেপ লাগানোর জন্য। সেটা অনুশীলনের জন্য যেমন, খেলার আগেও তেমন। ফলে তাকে নিজের পা শেভ করে রাখতে হয় যাতে টেপ তুলতে সুবিধা হয়! ভাবা যায়?

আমরা এখনো ক্রিকেটের শীর্ষ দল হতে পারিনি। তবে সেরা হওয়ার পথেই আছি। এখন যদি সব ম্যাচেই জয় খুঁজে বেড়াই তবে একটা উঠতি ক্রিকেট শক্তি কি প্রত্যাশার ভারে দুম করে পড়ে যাবে না? এই দলটি বিশ্বকাপ জিতে আনবে এমন প্রত্যাশা কি একটু বেশি হয়ে যায় না? মাশরাফিসহ পাঁচ সিনিয়র (সাকিব, তামিম, মুশফিক, মাহমুদউল্লাহ) যেদিন অবসরে যাবেন, সেদিন আমাদের ক্রিকেটে কতটা শূন্যতা সৃষ্টি হবে সেটা কি আমরা ভেবে দেখেছি?

এই বিশ্বকাপের পর হয়ত মাশারাফি অবসরে চলে যাবেন। অল্প কিছু ম্যাচই তো, এরপর বুক চিতিয়ে লড়াই করতে দেখবো কাকে? সতীর্থদের ধমক দিয়ে আবার মাথায় হাত বুলিয়ে কে তাদের সেরাটা বের করে আনবেন? আছে কোনো বিকল্প? শেষটায় একটু সবুর, খুব বেশি চাওয়া তো নয়।

বাংলাদেশ সময়: ০৯২০ ঘণ্টা, জুন ১৫, ২০১৯
এমএইচএম/এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।