ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

সালতামামি

সুন্দরবনে আগুন ও হরিণ নিধন ছিল বছরজুড়ে আলোচনায়

মাহবুবুর রহমান মুন্না, ব্যুরো এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৫৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১, ২০২২
সুন্দরবনে আগুন ও হরিণ নিধন ছিল বছরজুড়ে আলোচনায়

খুলনা: যুগ যুগ ধরে সুন্দরবন বাংলাদেশকে মায়ের মতো আগলে রেখেছে। সুন্দরবনের কারণে ঘূর্ণিঝড় আম্পান, আইলা, সিডর, বুলবুল আরও ভয়ঙ্কর হতে পারেনি।

অপরাজেয় এই বনের কাছে একের পর এক ঘূর্ণিঝড় মাথা নত করেছে।

অথচ সেই সুন্দরবনকে ধ্বংস করছে কিছু অসাধু মানুষ। বনের ভগ্নস্বাস্থ্যের পেছনে দায়ী মানুষের অতি লোভী মনোভাব। তারা বন উজাড়সহ বনের প্রাণী হত্যা করতেও কুণ্ঠাবোধ করেন না। বিদায়ী ২০২১ সালেও এমন আলোচিত-সমালোচিত অনেক ঘটনা ঘটেছে এই বনে।

বিদায়ী বছরে দফায় দফায় বনের অভ্যান্তরে অগ্নিকাণ্ডে বনভূমি হয়েছে উজাড়। তদন্ত কমিটি হয়েছে। বছরজুড়ে হরিণ শিকারীরাও বেপরোয়া ছিল। রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার হত্যা করে পাচারেরও ঘটনা ঘটেছে। পিছিয়ে ছিল না বিষ দিয়ে বনের নদী ও খালে মাছ শিকারীরা।

সুন্দরবনে আগুন:

বছরের শুরুর দিকে ৮ ফেব্রুয়ারি অগ্নিকাণ্ডে সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের পার্শ্ববর্তী ধানসাগর এলাকার চার শতক বনভূমি পুড়ে যায়। সোমবার (৩ মে) সুন্দরবন পূর্ব বনবিভাগের শরণখোলা রেঞ্জের দাসের ভারানি এলাকায় আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। সার্ভিস, বন বিভাগ ও স্থানীয়দের প্রায় ৩০ ঘণ্টার প্রচেষ্টায় মঙ্গলবার (৪ মে) বিকেল ৫টায় আগুন নিভে যায়। পরে বুধবার (৫ মে) সকালে লাগা আগুন থেকে দক্ষিণ পাশে আবারও ছড়িয়ে পড়ে।

প্রতিবার আগুন লাগার কারণ অনুসন্ধান, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করতে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। সেসব কমিটি আগুন লাগার কারণ তুলে ধরে তা বন্ধে কী কী করতে হবে, তার তালিকাও দিয়েছে। তবে, দীর্ঘদিনেও সেসব সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়নি।

সুপারিশগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ৪০ কিলোমিটার খাল ও তিনটি পুকুর পুনঃখনন, আগুন লাগলে তা নিয়ন্ত্রণে বন বিভাগের জনবল বাড়ানো, বনরক্ষীদের টহল কার্যক্রম জোরদার, তিনটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার তৈরি, সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের ৩৫ কিলোমিটার এলাকায় নাইলনের দড়ি দিয়ে বেড়া নির্মাণ, রিভার ফায়ার স্টেশন নির্মাণ ও বনসংলগ্ন ভরাট হয়ে যাওয়া ভোলা নদী।

কেন সুন্দরবনে বার বার আগুন লাগে এ বিষয়ে বিভিন্ন অনুসন্ধানী থেকে জানা যায়, জেলে-বাওয়ালীদের ফেলে দেওয়া বিড়ি-সিগারেটের আগুন থেকে সুন্দরবনে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত ঘটে। যে এলাকাগুলোতে বারবার আগুন লাগছে, সেখানকার নদী-খাল ভরাট হয়ে যাওয়ায় স্থানীয় লোকজন সহজেই বনের মধ্যে ঢুকতে পারছে। অনেক সময় তাদের বিড়ি-সিগারেটের উচ্ছিষ্টাংশ থেকে আগুন লাগছে। মধু সংগ্রহের পর মৌয়ালদের ফেলে দেওয়া মশাল থেকেও আগুন লাগে। মাছ ধরার সুবিধার্থেও বেশ কয়েকবার আগুন লাগিয়েছে স্থানীয় একটি চক্র। আগুন লাগিয়ে দেওয়ার ঘটনায় একাধিক মামলাও হয়েছে। কিন্তু ঘটনাগুলোর সঙ্গে জড়িতদের বেশিরভাগই ধরা পড়েনি। আবার যারা ধরা পড়েছেন তারা আইনের ফাঁক দিয়ে ছাড়া পেয়ে গেছেন।

অভিযোগ রয়েছে, বনসংলগ্ন এলাকায় রিভার ফায়ার স্টেশন না থাকায় আগুন নেভাতে অনেক সময় লেগে যায়।

হরিণ নিধন:

বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনে করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও বিদায়ী বছরে চোরা শিকারীরা বেপরোয়া হয়ে উঠে। কঠোর লকডাউন পালনে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যখন তৎপর এই সুযোগে একটি সংঘবদ্ধ চক্র সুন্দরবনে প্রবেশ করে। লকডাউন পরবর্তী সময়েও বেপরোয়া ছিল হরিণ শিকারীরা। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে হরিণের মাংস চামড়া ও মাথাসহ গ্রেফতার হয়েছেও বহু অপরাধী।

শুক্রবার (২৫ জুন) সুন্দরবন সংলগ্ন চুনকুড়ি নদীতে যৌথ অভিযান চালিয়ে ৯৭ হাজার মিটার অবৈধ নেট জাল ও ৪ হাজার ৮৭০ কেজি জাল ধরা রশি জব্দ করেছে বনবিভাগ, নৌপুলিশ ও কোস্টগার্ড। পরে জব্দকৃত অবৈধ নেট জাল ও রশি মুন্সিগঞ্জ নৌপুলিশ ফাঁড়ির সামনে আগুনে পুড়িয়ে বিনষ্ট করা হয়।

শুক্রবার (২ জুলাই) দিনগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে গভীর সুন্দরবনে অভিযান চালিয়ে ২০ কেজি হরিণের মাংসসহ কুখ্যাত চোরা শিকারী জব্বার গাজীকে আটক করে বনবিভাগ। সুন্দরবনের ধলের খালের মুখ থেকে তাকে আটক করা হয়। জব্বার গাজী সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার মরাগাং গ্রামের সুজাউদ্দীন গাজীর ছেলে।

সোমবার (৫ জুলাই) ভোরে সুন্দরবন থেকে হরিণ শিকারের ফাঁদ ও কীটনাশকসহ এক ব্যক্তিকে আটক করে বনবিভাগ।

মঙ্গলবার (৬ জুলাই) ভোরে সুন্দরবনে অবৈধভাবে প্রবেশ করে মাছ ধরার প্রস্তুতিকালে নৌকাসহ কীটনাশক জব্দ করে বনবিভাগ। সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের পশুর নদীতে অভিযান চালিয়ে নৌকা ও কীটনাশক জব্দ করে বনরক্ষীরা। এ সময় নৌকায় থাকা তিন ব্যক্তি পশুর নদে লাফিয়ে পালিয়ে যায়। পরে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে জব্দ নৌকাটিকে ভেঙে ফেলে বনরক্ষীরা।

রোববার (৭ নভেম্বর) ভোরে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে সুন্দরবন সংলগ্ন কয়রা উপজেলার পাতাখালী এলাকা থেকে তাকে আটক করা হয়।

সুন্দরবনের পশুর নদীর পশ্চিম পাড় থেকে ১৬০ কেজি হরিণের মাংস, ২শ মিটার হরিণ ধরার ফাঁদ, ৪টি হরিণের শিং, ১টি তক্ষক ও ৪টি ডিঙ্গি নৌকাসহ ১০ জনকে আটক করে খুলনা রেঞ্জের অন্তর্গত ভদ্রা টহল ফাঁড়ি।

শুক্রবার (১৯ নভেম্বর) বিকেল ৪টার দিকে ভদ্রা টহল ফাঁড়ির আওতাধীন সুন্দরবনের ১৬ নং কম্পার্টমেন্টের পশুর নদীর পশ্চিম পাড় থেকে তাদের আটক করা হয়।

সুন্দরবন সংলগ্ন লোকালয় থেকে হরিণের মাংস ও মাথাসহ মো. ইস্রাফিল (৪০) নামে এক শিকারিকে আটক করে কোস্টগার্ডের সদস্যরা। এ সময় তার কাছ থেকে ১৬ কেজি ৫০শ গ্রাম হরিণের মাংস ও ১টি হরিণের মাথা জব্দ করেন কোস্টগার্ড সদস্যরা।

রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের চামড়া উদ্ধার:

সুন্দরবনের বন বিভাগ ও র‌্যাব- ৮- এর সদস্যরা ক্রেতা সেজে বাঘের চামড়াসহ এক চোরাকারবারিকে আটক করে। ১৯ জানুয়ারি (মঙ্গলবার) শরণখোলা সদরের রায়েন্দা বাসস্ট্যান্ড এলাকা থেকে মো. গাউস ফকিরকে আটক করা হয়। তিনি শরণখোলা উপজেলার দক্ষিণ সাউথখালী গ্রামের রশিদ ফকিরের ছেলে।

র‌্যাব-৬- এর সদস্যরা অভিযান চালিয়ে সুন্দরবনের বাঘের দুটি চামড়াসহ দু'জনকে আটক করেছেন। শনিবার (১১ ডিসেম্বর) রাত সোয়া ১০টার দিকে বাগেরহাট জেলার ফকিরহাট উপজেলার কাটাখালী বাজারে অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করা হয়।

আটক দুইজন হলেন- খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার কাঞ্চনপুর গ্রামের আজিজুর রহমান ও খুলনা মহানগরীর সোনাডাঙ্গার সাইদ খান।

বাংলাদেশ সময়: ১৭৫৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১, ২০২২
এমআরএম/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।