ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

সালতামামি

তীব্র প্রাকৃতিক দুর্যোগে কেঁপেছে ধরণী

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬১৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৭, ২০১৯
তীব্র প্রাকৃতিক দুর্যোগে কেঁপেছে ধরণী ২০১৯ প্রাকৃতিক দুর্যোগ

২০১৯ পেরিয়ে ২০২০ চলে এলো প্রায়। সব দিক থেকেই ২০১৯ ছিল ঘটনাবহুল একটি বছর। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের তীব্রতা। ২০১৯ সালেও ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, ভূমিকম্প, খরা, তাপদাহ, দাবানলের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। এর মধ্যে বড় ধরনের ক্ষতি করেছে কয়েকটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। 

ঘূর্ণিঝড়
চলতি বছরের মার্চ মাসে আফ্রিকার দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে আঘাত হানে সাইক্লোন ‘ইদাই’। ইন্টারন্যাশনাল ডিজাস্টার ডাটাবেজের (আইডিডি) তথ্য মতে, এতে মোজাম্বিকে ৬০২ জন এবং জিম্বাবুয়েতে ২৯৯ জনের প্রাণহানি হয়।

সাইক্লোনের আঘাতে মোজাম্বিকের দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ বন্দর বেইরা প্রায় ৯০ শতাংশ ধ্বংস হয়ে যায়।

চলতি বছরের ১০ আগস্ট চীনের পূর্ব উপকূলে টাইফুন ‘লেকিমা’য় ৭২ জনের প্রাণহানি হয়। এ টাইফুনে চীনের বেশকিছু প্রদেশ প্রবল বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। সে সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অসংখ্য রাস্তাঘাট ও সেতু। লেকিমার কারণে দেশটিতে ব্যাপক আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এ সময় সর্বোচ্চ সতর্কতা ‘রেড টাইফুন অ্যালার্ট’ জারি করেছিল চীন সরকার। চীন ছাড়াও লেকিমা আঘাত হানে ফিলিপাইন, তাইওয়ান ও মালয়েশিয়ায়। ফিলিপাইনে এ টাইফুনের নাম ছিল ‘হানা’।  

২ সেপ্টেম্বর আটলান্টিকের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শক্তিশালী সামুদ্রিক ঝড় ‘ডোরিয়ান’ আঘাত হানে ক্যারিবীয় দ্বীপরাষ্ট্র বাহামায়। এতে অন্তত ৮০ জনের মৃত্যু হয়। অনেক ঘরবাড়ি লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। আর্থিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় তিন দশমিক চার বিলিয়ন মার্কিন ডলার।  

১২ অক্টোবর জাপানের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় উপদ্বীপগুলোতে ঘণ্টায় ২২৫ কিলোমিটার গতিবেগে আঘাত হানে টাইফুন হাগিবিস। গত ৬১ বছরের মধ্যে জাপানে আঘাত করা সবচেয়ে ভয়াবহ টাইফুন ছিল এটি। এতে অন্তত ৯৫ জনের মৃত্যু হয়। দুই লাখেরও বেশি মানুষকে সরিয়ে নেওয়া হয় নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্রে। এ টাইফুনে প্রচুর আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।

৯ নভেম্বর বঙ্গোপসাগরে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’। এতে ভারতের উড়িষ্যা রাজ্যে দুই জন, পশ্চিমবঙ্গে ১৪ জন ও বাংলাদেশে ২৫ জনের মৃত্যু হয়। উপকূলীয় এলাকা থেকে আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে নেওয়া হয় বাংলাদেশের প্রায় ২০ লাখ মানুষকে। বুলবুলের কারণে পশ্চিমবঙ্গে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন প্রায় ৩৫ লাখ মানুষ। এ ঘূর্ণিঝড়ে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। প্রাথমিক হিসেবে এতে সর্বমোট ৩ বিলিয়নেরও বেশি মার্কিন ডলার ক্ষয়ক্ষতি হয়, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকারও বেশি।

২ ডিসেম্বর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ ফিলিপাইনে আঘাত করে টাইফুন ‘কাম্মুরি’। এতে ১৭ জনের মৃত্যু হয়। আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে নেওয়া হয় প্রায় পাঁচ লাখ মানুষকে। এ ঘূর্ণিঝড়ে ব্যাপক আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।

২৫ ডিসেম্বর বড়দিনে ফিলিপাইনে আঘাত হানে টাইফুন ‘পেনফোন’। এতে অন্তত ২৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের কারণে বড়দিনের উৎসবে যোগ দিতে পারেননি লাখ লাখ মানুষ।  

তাপদাহ 
চলতি বছরের জুন মাসে প্রচণ্ড তাপদাহে ভারতের উত্তরাঞ্চলে ৯০ জনের মৃত্যু হয়। তাপমাত্রা পৌঁছেছিল ৪৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। এ সময় ভারতের বিহার রাজ্যে বিশেষ সতর্কতা জারি করা হয়।  

এছাড়া, জুন মাসে ইউরোপ জ্বলছিল সর্বাধিক তাপমাত্রায়। এসময় তীব্র তাপদাহে মৃত্যু হয়েছে অন্তত ১৫ জনের। এর মধ্যে ফ্রান্সে পাঁচ জন, জার্মানিতে চার জন, যুক্তরাজ্যে তিন জন, স্পেনে দুই জন এবং ইতালিতে এক জন মারা গেছে।  

জুলাই মাসে জাপানে তীব্র তাপদাহে ১৬২ জনের মৃত্যু হয়। এছাড়া, অনেকেই অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। দেশটির কুমাগায়া শহরে তাপমাত্রা পৌঁছেছিল ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াসে।  

বন্যা
মার্চ-এপ্রিলের বন্যায় ইরানের ৩১ প্রদেশের মধ্যে ২৬ প্রদেশই প্লাবিত হয়েছে। কর্তৃপক্ষের মতে, এতে ইরানজুড়ে অন্তত ৭৮ জন মারা গেছেন। এছাড়া, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এক কোটিরও বেশি মানুষ।  

জুলাইয়ের শেষ থেকে আগস্ট পর্যন্ত প্রবল বৃষ্টিতে প্লাবিত হয়েছে ভারতের ১৩ রাজ্য। দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক তথ্য অনুযায়ী, ২৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বন্যায় প্রায় ১৬৭৩ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং ঘরহারা হয়েছেন প্রায় ১০ লাখ মানুষ। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র, উত্তর প্রদেশ, আসাম ও বিহার। গত ২৫ বছরের মধ্যে এ বছর বর্ষা মৌসুমে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে ভারতে।

জোয়ারের পানি বেড়ে যাওয়ায় বন্যায় প্লাবিত হয়েছে ইতালির ভেনিস।  ছবি: সংগৃহীতনভেম্বরে জোয়ারের পানি বেড়ে যাওয়ায় গত ৫০ বছরের ইতিহাসে সর্বোচ্চ বন্যায় প্লাবিত হয়েছে ইতালির সেরা পর্যটন শহর ভেনিস। ভেনিসের ৮০ শতাংশই ডুবে গেছে বন্যায়। এ বন্যায় আর্থিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় এক বিলিয়ন পাউন্ড। ইতালি ছাড়াও অক্টোবর-নভেম্বরের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দক্ষিণ ইউরোপের দেশ ফ্রান্স, গ্রিস, স্পেন, অস্ট্রিয়ার বিভিন্ন এলাকা। বন্যায় ফ্রান্সে চার জন, কাতালোনিয়ায় তিন জন, গ্রিসে দুই জন ও ইতালিতে একজন মারা গেছেন।  

ভূমিকম্প
২৬ নভেম্বর আলবেনিয়ায় রিখটার স্কেলে ছয় দশমিক চার মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্পে ৫২ জনের মৃত্যু হয়, আহত হয়েছেন প্রায় তিন হাজার মানুষ। এছাড়া, ১১শ’ ভবন ধসে যায় এবং ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।  

আলবেনিয়ায় ছয় দশমিক চার মাত্রার ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত বসতবাড়ি।  ছবি: সংগৃহীত২৫ সেপ্টেম্বর ইন্দোনেশিয়ায় ছয় দশমিক পাঁচ মাত্রার ভূমিকম্পে ৪১ জনের মৃত্যু হয়, আহত হন ১৫শ’ জন। ২৪ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের কাশ্মীরে পাঁচ দশমিক ছয় মাত্রার ভূমিকম্পে ৪০ জনের মৃত্যু হয়, আহত হন ৮শ’ ৫০ জন।  

২২ এপ্রিল ফিলিপাইনে ছয় দশমিক এক মাত্রার ‘লুজন’ ভূমিকম্পে অন্তত ১৮ জন নিহত ও ২৮০ জন আহত হয়েছেন। এছাড়া, ২৯ অক্টোবর, ৩১ অক্টোবর ও ১৫ ডিসেম্বর শক্তিশালী ভূমিকম্পে ফিলিপাইনে যথাক্রমে ১৪, ১০ ও ১৩ জনের মৃত্যু হয়।  

২৬ মে আট মাত্রার ভূমিকম্পে কেঁপেছে পেরু। এটি এ বছরের সবচেয়ে শক্তিশালী মাত্রার ভূমিকম্প হলেও ক্ষয়ক্ষতি কম হয়েছে। এতে প্রাণহানি হয়েছে দুই জনের। এছাড়া, বছরজুড়ে বিশ্বে ছোট-বড় আরও অনেক ভূমিকম্প হয়েছে।  

দাবানল
নভেম্বরে দাবানলে বিভিন্ন সময় অস্ট্রেলিয়ার ছয় রাজ্যেই জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। নিউ সাউথ ওয়েলস, ভিক্টোরিয়া ও সাউথ অস্ট্রেলিয়া রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে এখনো জ্বলছে আগুন। ১৯ ডিসেম্বর দ্বিতীয়বারের মতো জরুরি অবস্থা জারি করা হয় নিউ সাউথ ওয়েলসে। দাবানলে এখন পর্যন্ত ছয় জনের মৃত্যু হয়েছে। আগুন নেভাতে গিয়ে দুর্ঘটনায় মারা গেছেন দুই দমকলকর্মী। এছাড়া, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বন্যপ্রাণীরা। আর্থিকভাবেও অস্ট্রেলিয়া ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।

অস্ট্রেলিয়ার দাবানল।  ছবি: সংগৃহীত২৩ অক্টোবর দাবানল ছড়িয়ে পড়ে যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য ক্যালিফোর্নিয়ায়। এতে পুড়ে গেছে প্রায় আড়াই লাখ একর জমি। দাবানলে মৃত্যু হয়েছে পাঁচ জনের।  

এ বছর ব্রাজিলের আমাজন জঙ্গলে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক দাবানলের ঘটনা ঘটেছে। শুধু ব্রাজিল নয়, ভেনিজুয়েলা, বলিভিয়া, কলম্বিয়া, পেরুতে বিস্তৃতে আমাজন অংশও পুড়েছে দাবানলে। আগস্টের শুষ্ক মৌসুম থেকে লাগাতার দাবানলের ঘটনা ঘটেছে আমাজনে। ব্রাজিলের দ্য ন্যাশানাল ইন্সটিটিউট ফর স্পেস রিসার্চের (আইএনপিই) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালের তুলনায় এ বছর আগুন লাগার পরিমাণ বেড়েছে ৮৫ শতাংশ। বছরের প্রথম আট মাসে শুধু ব্রাজিলিয়ান আমাজনেই প্রায় ৭৬ হাজার স্থানে জ্বলেছে আগুন।  

খরা
যুগের সবচেয়ে ভয়াবহ খরায় সঙ্কটে পড়েছে আফ্রিকা মহাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের ১৪টি দেশের ৪ কোটি ৫০ লাখ মানুষ। এ বছর দক্ষিণ আফ্রিকায় খরায় প্রায় ১৩৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সমপরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া নামিবিয়া, জাম্বিয়া, অ্যাঙ্গোলা, জিম্বাবুয়ে ও লেসোথোসহ আরও বেশ কিছু দেশে খাদ্য ও সুপেয় পানির অভাব প্রকট আকার ধারণ করেছে। খরাপ্রবণ দেশগুলোতে খাদ্যাভাবে মারা গেছে অনেক গৃহপালিত ও বন্যপ্রাণী। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জিম্বাবুয়ে। খরায় দেশটিতে দুই শতাধিক হাতি মারা গেছে।

এ বছর গত অর্ধ শতাব্দির সবচেয়ে ভয়াবহ খরায় ভুগেছে অস্ট্রেলিয়া। দেশটির বিভিন্ন স্থানে রিলিফে পানি বিতরণ করেছে সরকার। সুপেয় পানির সঙ্কট দেখা দিয়েছে অনেক অঞ্চলে। প্রভাব পড়েছে কৃষিক্ষেত্রে, আর্থিক ক্ষতিও হয়েছে। পানির অপব্যবহার রোধে জরুরি অবস্থাও জারি করা হয়েছে একাধিকবার।  

ভারতজুড়ে খরার কারণে তীব্র পানি সঙ্কটে রয়েছেন প্রায় ৬০ কোটি মানুষ।  ছবি: সংগৃহীতএ বছর ভারতের দক্ষিণাঞ্চলে স্মরণকালের ভয়াবহ খরা দেখা দিয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কর্ণাটক, অন্ধ্র প্রদেশ, তামিলনাড়ু ও মহারাষ্ট্র রাজ্য। সরকারি হিসেব অনুযায়ী, ভারতজুড়ে খরার কারণে তীব্র পানি সঙ্কটে রয়েছেন প্রায় ৬০ কোটি মানুষ।

বাংলাদেশ সময়: ০১১২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৭, ২০১৯
এফএম/এজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।