ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

সালতামামি

বছরজুড়ে আলোচনায় এনবিআরের যেসব ঘটনা

শেখ জাহিদুজ্জামান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৪৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩০, ২০১৭
বছরজুড়ে আলোচনায় এনবিআরের যেসব ঘটনা বছরজুড়ে আলোচনায় এনবিআর

ঢাকা: বছরের শুরু থেকেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলো নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের বিষয়টি। তবে ব্যবসায়ীদের চাপের মুখে শেষমেষ আর বাস্তবায়ন হয়নি নতুন এই আইন। আলোচনার কেন্দ্রে ছিল বছরের শুরু থেকে শেষ অব্দি বিভিন্ন সময় ঘটে যাওয়া বেশ  কটি তোলপাড় করা ঘটনা। এসব ঘটনা নিয়ে সাধারণ জনমনে কৌতূহল যেমন ছিল, তেমনি এসব নিয়ে উদ্বেগ এবং প্রতিক্রিয়াও ছিল তীব্র।

এসব চাঞ্চল্যকর ঘটনার মধ্যে ছিল মোবাইল কোম্পানিগুলোর ভ্যাট ফাঁকি, আপন জুয়েলার্সের স্বর্ণ জব্দ করার ঘটনা, রেইনট্রি হোটেলে অভিযান, শুল্ক গোয়েন্দা মহাপরিচালকের অপসারণের দাবি, ধনকুবের মুসা বিন শমসেরের গাড়ি আটক এবং মামলা দায়েরের ঘটনাসহ চট্টগ্রাম কাস্টমসে ১০ কন্টেইনার পণ্য জব্দ করার ঘটনা। সবমিলিয়ে আলোচনা ও সমালোচনার মধ্য দিয়ে কেটেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ২০১৭ সালটি।

ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন না হওয়া
বছরের প্রথম দিন থেকেই নতুন ভ্যাট ‍আইন বাস্তবায়নের বিরোধিতা করে আসছিলেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু এনবিআর নতুন ভ্যাট আইনে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা রয়েছে বলে দাবি করে। এ নিয়ে ব্যবসায়ী ও অংশীজনদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠকও করে সংস্থাটি। তবে নতুন ভ্যাট আইনের সুফল তুলে ধরতে ব্যর্থ হয় এনবিআর। একারণে ২০১৭ সালের ১ জুলাইতে নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন হওয়ার কথা থাকলেও ব্যবসায়ীদের তোপের মুখে ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন থেকে পিছু হটে সরকার।  

চলতি অর্থবছরের বাজেট অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নতুন ভ্যাট আইনটি স্থগিত করার ঘোষণা দেন। পাশাপাশি ভ্যাট আইনকে আরও সহজতর করতেও এনবিআরকে নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী।  শুধু তাই নয়, চলতি অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব আদায়ে ২ লাখ ৪৮ হাজার ১৯০ কোটি টাকার যে লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছে  সেটা নিয়েও সমালোচনার মুখে পড়ে সংস্থাটি।    

মোবাইল কোম্পানিগুলোর ভ্যাট ফাঁকি
চলতি বছরের প্রথম থেকেই মোবাইল কোম্পানিগুলোর ভ্যাট ফাঁকি (রাজস্ব আদায়) নিয়ে সরব ছিল এনবিআর। আর তখন মোবাইল কোম্পানিগুলোও রাজস্ব ফাঁকি দেয়নি বলে বিবৃতি দিতে থাকে। তবে এনবিআরের একের পর এক অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসতে থাকে কোম্পানিগুলোর রাজস্ব ফাঁকির চিত্র।  

সবশেষ তথ্যমতে, মোবাইল কোম্পানিগুলোর প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকির তথ্য উৎঘাটন করতে সক্ষম হয় এনবিআর। এর মধ্যে গ্রামীণফোন ২ হাজার ২ কোটি ৭১ লাখ টাকা, বাংলালিংক ১ হাজার ৯১ কোটি ৪১ লাখ টাকা, রবি ১ হাজার ২শ ১৮ কোটি ২১ লাখ টাকা, এয়ারটেল ৩৭৯ কোটি ৯৩ লাখ টাকা, টেলিটক ১০৪ কোটি ৯৩ লাখ টাকা এবং প্যাসিফিক টেলিকম লিমিটেড ফাঁকি দিয়েছে ৮১ কোটি ২৬ লাখ টাকা। এই বিপুল রাজস্ব ফাঁকি উদঘাটনের সফলতা এনবিআর’কে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়।

আপন জুয়েলার্স ও রেইনট্রি হোটেলে শুল্ক গোয়েন্দার অভিযান
চলতি বছরের ২৮ মার্চ জন্মদিনের পার্টির নামে রেইনট্রি হোটেলে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া দুই শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ করে আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদের ছেলে সাফাত আহমেদ ও তার বন্ধু  নাঈম আশরাফ। এই ধর্ষণের জেরে বেরিয়ে আসে আপন জুয়েলার্সের অবৈধ স্বর্ণ ব্যবসার অজানা চিত্র। একারণে চলতি বছরের ১৪ মে শুল্ক গোয়েন্দার ৫টি টিম আলাদাভাবে ভাগ হয়ে অভিযান চালায় আপন জুয়েলার্সে।  

কয়েক দফার অভিযানে আপন জুয়েলার্সের ৫টি শোরুম থেকে জব্দ করা হয়  মোট ১৫.১৩ মণ স্বর্ণ, ৭৩৬৯ পিস ডায়মন্ডখচিত অলঙ্কার, নগদ ৬৭ লাখ ৪০ হাজার টাকা ও ১০০ মার্কিন ডলার। এরপর আপন জুয়েলার্সের তিন মালিক দিলদার আহমেদ,গুলজার আহমেদ ও আজাদ আহমেদের নামে কাস্টমসে ৫টি মামলা এবং মুদ্রা পাচার প্রতিরোধ আইনে করা হয় আরও ৫টি মামলা। এসব মামলায় আটক হয়ে বর্তমানে আপন জুয়েলার্সের ৩ মালিক জেল হাজতে আছেন।  এছাড়া ধর্ষণের সূত্র ধরে অবৈধ মদ উদ্ধারের জন্য রেইনট্রি হোটেলে অভিযান চালান শুল্ক গোয়েন্দারা। অভিযানে ১০ বোতল বিদেশি মদ উদ্ধার করা হয়। তবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর অভিযান চালিয়ে কিছুই উদ্ধার করতে পারেনি। আপন জুয়েলার্স ও এর মালিকপুত্রের ধর্ষণকাণ্ড দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়।  

শুল্ক গোয়েন্দার মহাপরিচালকের অপসারণের দাবি
আপন জুয়েলার্সের স্বর্ণ জব্দ করায় বাংলাদেশ জুয়েলারি মালিক সমিতি (বাজুস) ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আপন জুয়েলার্সের জব্দকরা স্বর্ণ ফেরত দিতে এনবিআরকে আল্টিমেটাম দেয়। সেই সাথে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মইনুল খানের অপসারণও দাবি করে সংগঠনটি।  

এর পরিপ্রেক্ষিতে এনবিআর চেয়ারম্যান মো.নজিবুর রহমান ৮জুন  বাংলানিউজকে বলেন, শুল্ক গোয়েন্দার মহাপরিচালককে অপসারণের প্রশ্নই আসে না।  

এরপর টিআইবি’র পক্ষ থেকে সকল জুয়েলারি দোকানে অভিযানের দাবি জানানো হয় এবং এনবিআরকে সাধুবাদ জানানো হয়। পরে এনবিআর চেয়ারম্যান স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। পরে অযৌক্তিক আল্টিমেটাম তুলে নেয় সংগঠনটি।  

ধনকুবের মুসা বিন শমসেরের গাড়ি আটক, মামলা 
আলোচিত ধনকুবের মুসা বিন শমসেরের ব্যবহৃত বিলাসবহুল একটি রেঞ্জ রোভার গাড়ি অভিযান চালিয়ে আটক করেন শুল্ক গোয়েন্দারা। এই ঘটনায় মুসা বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে বলেন, তার সম্মানহানি করতেই এমন কাজ করা হচ্ছে।  

তবে শুল্ক গোয়েন্দাদের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, মুসার ব্যবহৃত গাড়িটি কার্নেট সুবিধায় আনা হয়েছিল। তবে এই সুবিধার অপব্যবহার করে তিনি ২ কোটি ১৭ লাখ  টাকা শুল্ক ফাঁকি দেন। এরপর শুল্ক গোয়েন্দা দপ্তরে হাজির হয়ে নিজের বক্তব্য পেশ করেন মুসা।  

সেসময় তিনি বলেন, সুইস ব্যাংকে তার ৯৬ হাজার কোটি টাকা পড়ে আছে। তখনই বেঁকে বসে শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ। এরপর গাড়িতে শুল্ক ফাঁকির অভিযোগে ঢাকা  কাস্টমস হাউসে মামলা হয়। এছাড়া সুইস ব্যাংকে পড়ে থাকা অর্থের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো হিসাব দাখিল করতে না পারায় ৩১ জুলাই তার বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিং (মুদ্রাপাচার) প্রতিরোধ আইনে মামলা করেন শুল্ক গোয়েন্দারা।

শুধু তাই নয়, মুসা যেন পালিয়ে যেতে না পারেন সেজন্য তার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে  শুল্ক গোয়েন্দার পক্ষ থেকে পুলিশের বিশেষ শাখার অতিরিক্ত আইজিপি বরাবর আবেদনও করা হয়। আর সেই আবেদন মঞ্জুরও হয়। মুসার ঘটনাটি নিয়ে বেশ আলোচনা সমালোচনা চলে।

চট্টগ্রাম কাস্টমসে ১০ কন্টেইনার পণ্য জব্দ
 মার্চ মাসের ৫ ও ৬ তারিখে চট্টগ্রাম বন্দরে ১২টি কন্টেইনার আটক করে শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ। কন্টেইনারে পাওয়া যায় ১৬ হাজার ১৭০ বোতল মদ, ৩ কোটি ৮৪ লাখ শলাকা সিগারেট, ৪ হাজার ৭৪টি এলইডি টেলিভিশন ও ২৮১ টি আমদানি-নিষিদ্ধ পুরাতন ফটোকপি মেশিন।  

এই ১২টি কন্টেইনার আনা হয় দুটি অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে। এরপর দীর্ঘ অনুসন্ধান শেষে ২৭ নভেম্বর রাজধানীর পল্টন থানায় ৭জনের নামে মানিলন্ডারিং মামলা দায়ের করে শুল্ক গোয়েন্দা‍ বিভাগ।  অনুসন্ধানে উঠে আসে,পোল্ট্রি ফিডের মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির ঘোষণা দিয়ে আনা হয় কন্টেইনারগুলো। ২০১৭ সালে এই ১২টি কন্টেইনার আটক করার ঘটনা ছিল  শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের বড় এক সফলতা।
 
বাংলাদেশ সময়: ০২৪৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০১৭
এসজে/জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।