ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

অপার মহিমার রমজান

‘তারাবিতে পঠিতব্য আয়াতের তাফসির’

আজ কোরআনের হৃৎপিণ্ড সূরা ইয়াসীন পাঠ

মুফতি মাহফুযূল হক, অতিথি লেখক, ইসলাম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৪৩ ঘণ্টা, জুলাই ৬, ২০১৫
আজ কোরআনের হৃৎপিণ্ড সূরা ইয়াসীন পাঠ

আজ ১৯তম তারাবি। আজকের খতমে তারাবিতে ২২তম পারা তেলাওয়াত করা হবে।

আজ তেলাওয়াত ৩১নং আয়াত থেকে শুরু হয়ে সূরা আহজাব শেষ হবে। এরপর সূরা সাবা, সূরা ফাতির শেষ করে সূরা ইয়াসীনের ২১নং আয়াত পর্যন্ত পাঠ করা হবে।

সূরা আহজাবের উল্লেখযোগ্য কিছু বিষয়-
৩২-৩৩নং আয়াতে নারীদের কয়েকটি কাজের নির্দেশ দেয়া হয়েছে-
১. পরপুরুষের সঙ্গে স্বাভাবিক মোলায়েম কণ্ঠে কথা না বলে বরং ইচ্ছাকৃতভাবে কর্কশ স্বরে কথা বলবে।
২. নারীরা যথাসম্ভব ঘরেই অবস্থান করবে, প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের হবে না। তবে নবী করিম (সা.)-এর আমল ও উক্তি দ্বারা বুঝা যায় যে, বিভিন্ন প্রয়োজনে নারীরা বাড়ির বাইরে যেতে পারবে।
৩. জাহেলী যুগের নারীদের মতো নিজেদের সৌন্দর্য প্রদর্শন করে বেড়াবে না।
৪. নামাজ আদায় করবে।
৫. জাকাত প্রদান করবে।
৬. আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবে।

উক্ত আয়াতে যদিও নবীপত্নীদের সম্বোধন করা হয়েছে, তবুও এসব বিধান দুনিয়ার সব নারীদের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য। কেননা, আয়াতে বিধানের সঙ্গে কারণ বলা হয়েছে, সতীত্ব বজায় রাখা, অপবিত্র হওয়া রোধ করা। উপরোক্ত কারণ যেভাবে নবীপত্নীদের জন্য জরুরী সেভাবে সব নারীদের জন্যও জরুরী। তাই উপরোক্ত বিধান সবার জন্যই।

৩৬নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, আল্লাহ এবং তার রাসূল যখন কোনো বিষয়ের সিদ্ধান্ত প্রদান করেন, তখন সে বিষয়ে কোনো মুমিন নর-নারীর জন্য ভিন্ন মত পোষণ করা বৈধ নয়। যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কথা অমান্য করল- সে স্পষ্ট পথভ্রষ্টতায় পতিত হল।

৪১-৪২নং আয়াতে বেশি বেশি আল্লাহর জিকির করার ও সকাল-সন্ধ্যা তাসবিহ পাঠ করার কথা বলা হয়েছে।

৪৮নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, কাফের ও মুনাফিকদের কথা মানবেন না। তাদের নির্যাতনে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হবেন না। আল্লাহর ওপর ভরসা রাখুন। তিনিই আপনার কার্যনির্বাহক হিসাবে যথেষ্ট।

৪৯নং আয়াতে বিধান দেয়া হয়েছে যে, কোনো ব্যক্তি যদি বিয়ের পর স্ত্রীর সঙ্গে নির্জনে অবস্থান করার পূর্বেই স্ত্রীকে তালাক প্রদান করে, তবে এ মহিলার জন্য ইদ্দতের কোনো বিধান থাকবে না। আর তার যদি মহর ধার্য করা থাকে তবে অর্ধেক মহর তাকে পরিশোধ করতে হবে। আর যদি মহর ধার্য করা না থাকে তবে তাকে গ্রহণযোগ্য মানের এক সেট পোশাক দিতে হবে। কোনো দুর্ব্যবহার না করে ভদ্রভাবে তাকে বিদায় দিতে হবে।

৫৬নং আয়াতে উম্মতকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, রাসূল (সা.)-এর জন্য দুরূদ পাঠ করতে এবং সালাম পাঠ করতে। আরো উল্লেখ করা হয়েছে যে, আল্লাহতায়ালা তার রাসূলের ওপর খাস রহমত বর্ষণ করেন এবং  ফেরেশতারা তার জন্য বিশেষ দোয়া করেন। ‍ৎ

এ আয়াত প্রচলিত মিলাদ অনুষ্ঠানের দলিল নয়। এ আয়াত দুরূদ পাঠের দলিল। দুরূদ ব্যক্তিগত আমল। দলবদ্ধ কোনো আমল না। প্রচলিত মিলাদে দলবদ্ধতা থাকে, নামাজের জামাতের মতো একজন অনুষ্ঠানের ইমামতি করে। সম্মিলিত দুরূদ পাঠের এ ধরণের কোনো অনুষ্ঠান অনুসরণীয় তিন যুগে প্রচলিত ছিল না।

৫৯নং আয়াতে নারীদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে, (বাইরে চলাফেরার সময়) নারীরা যেন নিজেদের ওপর একটি জালবাব ঝুলিয়ে দেয়।

জালবাব বলা হয় উড়নার ওপর পরিধেয় বিশেষ কাপড়কে। আয়াতে জালবাবকে ঝুলিয়ে (টেনে বা নীচু) করে দিতে বলা হয়েছে। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) কে এ আয়াতের ব্যাখ্যা জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন, মহিলারা যখন কোনো প্রয়োজনে বাড়ির বাইরে যাবে তখন মাথার ওপর থেকে জালবাব ঝুলিয়ে দিয়ে চেহারা ঢেকে রাখবে। পথ দেখার জন্য শুধুমাত্র চোখ খোলা রাখবে। -ইবনে কাসির

মুহাম্মাদ ইবনে সিরিন বলেন, আমি উবাইদা সালমানিকে এ আয়াতের তাফসির জিজ্ঞাসা করলে তিনি নিজের মাথা ও চেহারা ঢেকে ফেললেন এবং বাম চোখ খোলা রাখলেন। -ইবনে কাসির

কোরআনের এ আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে চেহারা ঢেকে চলা-ফেরা করার ধারণা পৃথিবীর কোথাও ছিল না, এমনকি আরবেও এ ধারণার কোনো অস্তিত্ব ছিল না। অন্যকোনো ধর্মে ও সংস্কৃতিতেও এ রেওয়াজ নেই। চেহারা ঢাকা একমাত্র ইসলামের স্বতন্ত্র বিধান। কোরআনের এ আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর সকল মহিলা সাহাবি চেহারা ঢেকে বাইরে চলা-ফেরা করতেন। কোনো মুমিন স্বাধীন নারী চেহারা খোলা রেখে বাইরে যেতেন এরূপ কোনো প্রমাণ নেই। বরং তারা চেহারা ঢেকে রাখতেন এর অনেক প্রমাণ আছে।

বনি কাইনুকার যুদ্ধের পর উম্মে খালাদ নামের এক নারী তার সদ্য শহীদ হওয়া দুই সন্তানের খোঁজ নিতে আসলেন। উপস্থিত এক সাহাবি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার ছেলের ইন্তেকালের পরও আপনার মুখের নেকাব ঠিক আছে? তিনি উত্তর দিলেন, ছেলে হারাতে পারি কিন্তু লজ্জা হারাতে পারি না -আবু দাউদ : ২৪৯০

হজের ইহরাম অবস্থায় চেহারায় কাপড় লাগানো নিষেধ থাকলেও মহিলা সাহাবিরা ইহরামের অবস্থায়ও পরপুরুষের সামনে চেহারা ঢেকে রাখতেন। পবিত্র কোরআনে কারিমের এ আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত আরব ও অনারবের দ্বীনদার পরিবারের নারীরা নেকাব দিয়ে মুখ ঢেকে চলা-ফেরা করে আসছে। এটা উম্মতের বিগত দেড় হাজার বছরের নিরবিচ্ছিন্ন আমল।

৬৭-৬৮নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, জাহান্নামীরা বলবে, হে আমাদের প্রভু! আমরা তো আমাদের নেতাদের ও বড়দের অনুসরণ করেছিলাম। তারা আমাদের ভুল পথে পরিচালিত করেছিল। তাই আজ আপনি তাদের দ্বিগুণ শাস্তি প্রদান করুন।

সূরা সাবা
সূরা সাবা পবিত্র কোরআনে কারিমের ৩৪তম সূরা। এটা মক্কি সূরা। এর আয়াত সংখ্যা ৫৪টি। এ সূরার উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বিষয় হলো-

১৪নং আয়াতে হজরত সোলায়মান (রা.)-এর মৃত্যুর ঘটনা আলোচনা করা হয়েছে। তিনি লাঠির ওপর ভর দিয়ে বাইতুল মোকাদ্দাস নির্মাণ কাজ তদারকি করছিলেন। জিনরা ছিল এ কাজের শ্রমিক। এ অবস্থায় তিনি মারা গেলেন। কিন্তু জিনরা কিছুই টের পেল না। ঘুনে খেতে খেতে যখন তার লাঠি ভেঙ্গে গেল তখন তিনি পরে গেলেন। পরীক্ষা করে দেখা গেল তার মৃত্যু হয়েছে এক বছর আগে। জিনরা মন্তব্য করল, আমরা যদি গায়েব জানতাম তবে এমন (কঠিন) অপমাননাকর বিপদে এতদিন অবস্থান করতাম না।

১৫-১৯নং আয়াতে সাবা সম্প্রদায়ের ঘটনা আলোচনা করা হয়েছে।

সূরা ফাতির
সূরা ফাতির পবিত্র কোরআনে কারিমের ৩৫তম সূরা। এটা মক্কি সূরা। এর আয়াত ৪৫টি। এ সূরায় একত্ববাদের প্রমাণ দেয়া হয়েছে, নবীকে সান্তনা দেয়া হয়েছে, মুমিনদের সুসংবাদ দেয়া হয়েছে, কাফেরদের ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে।

সূরা ইয়াসীন
সূরা ইয়াসীন পবিত্র কোরআনে কারিমের ৩৬তম সূরা। সূরা ইয়াসীন মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে। এর আয়াত ৮৩টি।

সূরা ইয়াসীনের ফজিলত
হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, সূরা ইয়াসীন পবিত্র কোরআনে কারিমের হৃৎপিণ্ড। ’ এ হাদিসে আরো বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি সূরা ইয়াসীন আল্লাহ ও পরকালের কল্যাণ লাভের জন্য পাঠ করবে তার মাগফিরাত হয়ে যায়। তোমরা তোমাদের মৃতদের জন্য এ সূরা তেলাওয়াত করো। -রুহুল মায়ানি ও তাফসিরে মাজহারি

ইমাম গাজ্জালি (রহ.) বলেন, ‘সূরা ইয়াসীনকে কোরআনের হৃৎপিণ্ড এ কারণে বলা হয়েছে যে, এ সূরায় কেয়ামত ও হাশর বিষয়ে বিশদ ব্যাখ্যা ও অলঙ্কারসহকারে বর্ণিত হয়েছে। পরকালে বিশ্বাস ঈমানের এমন একটি মূলনীতি, যার ওপর মানুষের সব আমল ও আচরণের বিশুদ্ধতা নির্ভরশীল। আমরা জানি, পরকালভীতিই মানুষকে সৎকর্মে উদ্বুদ্ধ করে এবং অবৈধ বাসনা ও হারাম কাজ থেকে বিরত রাখে। তাই দেহের সুস্থতা যেমন অন্তরের সুস্থতার ওপর নির্ভরশীল তেমনি ঈমানের সুস্থতা পরকালের চিন্তার ওপর নির্ভরশীল। -রুহুল মায়ানি

এ সূরার নাম সূরা ইয়াসীন হিসেবে প্রসিদ্ধ; তবে হাদিসে এ সূরার নাম ‘আজিমা’ও বর্ণিত আছে। অপর এক হাদিসে বর্ণিত আছে যে, তাওরাতে এ সূরার নাম ‘মুয়িম্মাহ’ বলে উল্লেখ আছে।

অর্থাৎ এ সূরা তার পাঠকারীকে ইহকাল ও পরকালে শান্তি ও ব্যাপক কল্যাণ এনে দেয়। অন্য এক বর্ণনায় বলা হয়েছে, এ সূরা কেয়ামতের দিন অধিক সংখ্যক মানুষের জন্য সুপারিশকারী হবে এবং তা আল্লাহ অবশ্যই কবুল করবেন।

আবার এ সূরার নাম ‘মুদাফিয়া’ও বর্ণিত আছে। অর্থাৎ এ সূরা তার পাঠকদের থেকে বালা-মুসিবত দূর করে। অন্য রেওয়ায়েতে এর নাম ‘কাজিয়া’ও উল্লিখিত হয়েছে; অর্থাৎ এ সূরা পাঠকের সব ধরনের প্রয়োজন মেটায়। -রূহুল মায়ানি

হজরত আবু যর (রা.) বলেন, আমি হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছ থেকে শুনেছি তিনি বলেছেন, মরণোন্মুখ ব্যক্তির কাছে সূরা ইয়াসিন পাঠ করলে তার মৃত্যু যন্ত্রণা সহজ হয়ে যায়। -মাজহারি

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়ের (রা.) বলেন, যদি কোনো ব্যক্তি সূরা ইয়াসিন অভাব-অনটনের সময় পাঠ করে তাহলে তার অভাব দূর হয়, সংসারে শান্তি ও রিজিকে বরকত লাভ হয়। -মাজহারি

ইয়াহইয়া ইবনে কাসির বলেন, ‘যে ব্যক্তি সকালে সূরা ইয়াসিন পাঠ করবে সে সন্ধ্যা পর্যন্ত সুখে-স্বস্তিতে থাকবে। যে সন্ধ্যায় পাঠ করবে সে সকাল পর্যন্ত শান্তিতে থাকবে। ’ -মাজহারি

এ ছাড়াও সূরা ইয়াসীনের বহু ফজিলত হাদিসে বর্ণিত আছে, তাই এই সূরা প্রতিদিন সকালে অন্তত একবার করে অবশ্যই সবার পড়া উচিত।

সূরা ইয়াসীনের ২১নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, তোমরা এরূপ লোকদের অনুসরণ করো যারা তোমাদের নিকট কোনো বিনিময় চায় না এবং তারা নিজেরাও দ্বীনের উপর অবিচল থাকে।

বাংলাদেশ সময়: ১৪৩০ ঘন্টা, জুলাই ০৬, ২০১৫
এমএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।