ঢাকা, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

সিঙ্গাপুর

ওয়েলকাম টু সিঙ্গাপুর

‘স্যরি’টা এক সময় যন্ত্রণা হয়ে উঠছিল’

মাজেদুল নয়ন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৫৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ১১, ২০১৪
‘স্যরি’টা এক সময় যন্ত্রণা হয়ে উঠছিল’ ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

সিঙ্গাপুর থেকে: ধৈর্য্যের বাঁধ ধরে রাখা মুশকিল হয়ে পড়লো। ইন্টেসিভ রুমে নিয়ে গিয়ে বুকিত বিনতাংয়ে গ্রেনেড হামলার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা শুরু করলেন ভারতীয় অফিসার রাজেশ।

ব্যাগে তল্লাশী চালাচ্ছেন অপর এক মালয় অফিসার। হাতের ভিডিও ক্যামেরায় রেকর্ড হচ্ছে আমার ভঙ্গি আর কথোপকথন। কল্পনায় নিজেকে ভারতীয় সিনেমা, ‘মাই নেম ইজ খান’ এর প্লটে ফেললাম। এবার বুঝি পিঠের উপর লাঠি ভাঙ্গা হবে। মনে মনে শার্ট-প্যান্ট খোলার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। সামনাসামনি দাঁড়িয়ে তখন।
 
অফিসার: বুকিত বিনতাংয়ে গ্রেনেড হামলা হয়েছে জান?
আমি: হুম, জানি।
অফিসার: কিভাবে জান?
আমি: মালয়েশিয়ার স্টার পত্রিকার অনলাইন নিউজে দেখেছি।
অফিসার: মালয়েশিয়া সর্ম্পকে আর কি কি খবর রাখো?
আমি: যেহেতু আমি সাংবাদিক, সবজায়গার গুরুত্বপূর্ণ খবরই রাখি। মালয়েশিয়াতে আগামী নভেম্বরে একটা বড় মেলা হবে, ওআইসি দেশের প্রধানমন্ত্রীরা আসবেন।
অফিসার: বুকিত বিনতাং যাও?
আমি: হুমম, ওখানে অনেক বাংলাদেশি থাকে। তাদের সঙ্গে দেখা করতে।
অফিসার: গ্রেনেড হামলা দেখেছিলে?
আমি: না, তখন আমি ক্লাং লামায় বাসায় ঘুমাচ্ছিলাম।
অফিসার: বাসে সিঙ্গাপুর এলে কেন? প্লেনেও আসতে পারতে।
আমি: বাসে এলে মালয়েশিয়াটা দেখতে দেখতে আসা যায়।
 
এরই মধ্যে বুকিত বিনতাংয়ে টাকা ভাঙ্গানোর একটি রিসিট পেলেন ব্যাগ চেক করা দ্বিতীয় অফিসার। আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা অফিসারকে জানালেন, স্যার বুকিত বিনতাংয়ের ম্যামো।
 
অফিসার: বুকিত বিনতাং থেকে টাকা ভাঙ্গিয়েছো?
আমি: হুমম, ওখানে মানি এক্সচেঞ্জ বেশি। দাম ভালো পাওয়া যায় এই দোকানে। আর আমি বাসে উঠেছি টাইম স্কয়ারের সামনে থেকে।
অফিসার: তুমি বলেছো, সিঙ্গাপুরে রিপোর্ট করবে, কি ধরনের রিপোর্ট?
আমি: তোমার দেশের জীবন যাপন নিয়ে। সুন্দর জায়গাগুলো নিয়ে।
অফিসার: কি কি সুন্দর জায়গা রয়েছে।
আমি: ঘুরে দেখবো কি কি সুন্দর জায়গা রয়েছে। না দেখে বলবো?
অফিসার: (মৃদু হেসে) তা সত্যি। বোমা মেরে সিঙ্গাপুরে নাকি সবাই চলে আসছে?
আমি: মালয়েশিয়া থেকে কি তাই বলেছে? সাংবাদিক হিসেবে কিন্তু এটা আমার নিউজের একটা উপাদান।

(এরই মধ্যে দ্বিতীয় অফিসার আমার ক্যামেরা ওপেন করে, জিজ্ঞাসা করলেন, ব্যাক্তিগত কিছু না থাকলে চেক করতে চাই। আমি সানন্দে সায় দিলাম। )

অফিসার: হাহ হাহ হাহ, না এমনি বললাম। আবার কবে ফিরবে মালয়েশিয়া। নাকি ফিরবে না।

আমি: ১৩ তারিখে ফিরবো। আর ১৫ অক্টোবর দেশে ফিরবো। (এর আগে দুইবার দেশে ফেরার টিকেট দেখানো হয়ে গেছে)। না ফিরলে, আমার চাকরি হারাতে হবে।

অফিসার: (হাতে পাসপোর্ট দিয়ে) ওকে, ওয়েলকাম টু সিঙ্গাপুর। ডোন্ট মাইন্ড। প্রথমবার এসেছো তাই এতো ঝামেলা। আর বুকিত বিনতাং ইস্যুতে আমরা চিন্তিত।
 
এর আগেও আরো সিনিয়র অফিসার দু’দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল। আমি কার কাছে যাব? তার ঠিকানা? কেন যাবো? সবকিছুই কয়েকবার করে জিজ্ঞাসা করা হলো। আমার মতোই ইন্দোনেশিয়ান আর দুইজন চায়নিজ নাগরিককেও চলছিল জিজ্ঞাসাবাদ।
 
ব্যাগে সবকিছু ঢোকাচ্ছিলাম। দ্বিতীয় অফিসার সাহায্য করলেন। আমাকে দেরি করিয়ে দেওয়ার জন্য কিস্তিতে কিস্তিতে সরি বললেন। এসবে আরো যন্ত্রণা মনে হচ্ছিল নিজের কাছে। গরু মেরে জুতো দানের মতো।
 
চোখ মুখ শক্ত করে, থ্যাংক্যু দিয়ে ইমিগ্রেশন থেকে বের হলাম। লে-হালুয়া। আমার বাস রেখে চলে গেছে আমাকে। এবার? এতো খাঁ খাঁ মাঠ। যারা ইমিগ্রেশন পার হচ্ছে, তারা দ্রুত নির্দিষ্ট বাসে উঠে যাচ্ছে। এক চায়নিজ চালককে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, আমাকে নেয়া যাবে কিনা? তিনি উত্তর দিলেন, সুপার নাইচ বাসের দ্বিতীয় গাড়িতে আমাকে যেতে হবে। অন্য উপায় নেই। যাত্রী হিসেবে আমার ইন্স্যুরেন্স নাকি ওই বাসেই হয়েছে। হায়! নিজের অজ্ঞাতসারেই ইন্স্যুরেন্সের জ্বালা।
 
মনের ক্ষোভ তখন মাথায়। এমনিতেই মালয়েশিয়া ইমিগ্রেশন পার হওয়ার সময় ঢাকা থেকে এডিটর-ইন-চিফ ফোন দিয়ে মৃদু ঝাড়ি দিয়েছেন, দেরিতে রওনা দেয়ার জন্যে। নিজেকে মনে হচ্ছিল তেপান্তরে এসে পড়েছি। যা হয় কপালে। রওনা দিলাম বাস যেখান দিয়ে বের হয়, ওই রাস্তায়। উদ্দেশ্য মেইন রোডে গিয়ে একটা ট্যাক্সি নেবো।
 
কিন্তু শেষ প্রান্তে আসতে আরেক পুলিশ অফিসার জানালেন, নাহ বের হওয়া যাবে না। হয় ইমিগ্রেশন পার হওয়া বাসে বের হতে হবে, না হয় ইমিগ্রেশনে গিয়ে খোঁজ নাও কি করতে হবে।
 
মালয়েশিয়া এয়ারপোর্টে নেমে কোনরকমে কাচঁঘর পেরিয়ে চিন্তা কমাতে ধূম্র শলাকায় টান দেয়া যায়, কিন্তু এখানে আশপাশে দেখি কোনো ধূমপায়ী নেই। বসে পড়লাম একটা জায়গায়। আবার যেতে হবে ইমিগ্রেশনে! কি আর করা, ঢুকলাম আবার।
 
চায়নিজ তিন অফিসার বসে আড্ডা দিচ্ছেন। বললাম, ইমিগ্রেশনের কাহিনীতে আমার বাসতো আমাকে রেখে চলে গেছে। তিনজনই আমার বাসের টিকেট দেখলেন। একটা ফোন নাম্বার দেখিয়ে বললেন, এটায় ফোন দিয়ে বলো। জানালাম, আমার কাছে সিঙ্গাপুরের সিম নেই। একজন অফিসার নিয়ে গেলেন, আবার সেই অভিশপ্ত অফিসে। চায়নিজ এক বৃদ্ধা এখানকার বড় অফিসার বোঝা গেলো। কোনো অসুখের কারণে হয়তো তার ডান চোখটা শুধু লাফায়। বিস্তারিত বললাম। আবারো দুঃখ প্রকাশের পালা।
 
চায়নিজ বৃদ্ধা নিজেই ফোন দিলেন বাসের অফিসে। আমি মোবাইলে আমার বাসের ছবিটা দেখালাম। বাসের অফিসে ফোন দিয়ে বললেন, ইমিগ্রেশনে দেরির কারণে তোমাদের একজন যাত্রী এখানে রয়ে গেছে। তাকে নিয়ে যাওয়ার ব্যাবস্থা করো।
 
অপর পার্শ্বের সঙ্গে কথা বলে আমার টিকেটে একটা বাসের নাম্বার লিখে আমার সঙ্গে থাকা চায়নিজ অফিসারকে দিলেন। সেই অফিসার আমাকে বাসের লবিতে নিয়ে গিয়ে বসালেন। কোথায় বাসের নাম্বার উঠবে এবং কত নাম্বার রো থেকে আমাকে উঠতে হবে বলে দিলেন।
 
জানালেন এক থেকে দেড় ঘণ্টা লাগবে বাস আসতে, একা বসে থাকতে বোরিং হবো কিনা জানতে চাইলেন? মনে মনে ভাবলাম, টাকা খাওয়ার ধান্ধা নাতো!
 
নাহ্, বেশ অন্তরিক এ অফিসার। তিন ওয়া সু নামে অফিসার বসলেন পার্শ্বে। আবার দুঃখ প্রকাশ। দেশের আইন অনেক বেশি কড়া এসব এসব। এবার কিন্তু সত্যি কিছুক্ষণ আগের দুঃখগুলো লাঘব হয়ে গেলো। মনে হলো, সত্যি এটা অনেক বেশি নিরাপদ দেশ। আর আমাকে চেক করাটা তাদের দ্বায়িত্ব ছিল, তবে আন্তরিকতার অভাব নেই।
 
আমি যখন জানালাম, মোবাইলে গান শুনে আমার সময় কেটে যাবে, চলে গেলেন অফিসার। এরপরের ১০ মিনিটে ২ বার এসে জিজ্ঞাসা করলেন, পানি খাবো কিনা! বা গরম লাগলে ভেতরে যেয়ে বসতে পারি।
 
কিছুক্ষণ পর অন্য একটি বাস এলো। ভারতীয় চালক আমাকে দেখে কাছে ডাকলেন। একই ধরনের চামড়া দেখে তার আমাকে দেশি মনে হলো। বললেন, ১০ ডলার দিলে তিনি আমাকে শহরে নিয়ে যাবেন। তিনি ভারতীয়, আমিওতো বাংলাদেশি! বললাম, তুমি আমাকে এমনিতেই নিয়ে যেতে পারো, কারণ তোমার বাস খালি দেখা যাচ্ছে।
 
ভারতীয় চালক ৪ ডলারে রাজি হলেন। একই ধরনের চামড়ায় আর ইন্স্যুরেন্স-টিন্সুরেন্সের ঝামেলা নেই। উঠে পড়লাম। বাস সাঁই সাঁই করে চলে এলো বিচ রোডে। সবাই নেমে গেলো।
 
তামিল চালক জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কোথায় যাবে?

বললাম, দেস্কার রোডে। চালক বললেন, ওটাই ইন্ডিয়ানদের জায়গা। ওখানেই নামিয়ে দেবো, তুমি বসো। কিছু সময় পর আমাকে নামিয়ে দেওয়া হলো নির্দিষ্ট গন্তব্যে। বুঝলাম ৪ ডলার দিয়ে আসাটাই লাভ হয়েছে।
 
নেমে হাঁটতে থাকলাম, মোস্তফা মার্টের সামনে দিয়ে। মনে হচ্ছিল ওই চায়নিজ অফিসারটা হয়তো আবাবো খোঁজ নিতে আসবেন আমার।
 
বাংলাদেশ সময়: ১৪৫১ ঘণ্টা, অক্টোবর ১১, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।