
খাগড়াছড়ি: ত্রিপুরা, মারমা আর চাকমা- পার্বত্য অঞ্চলের এ তিন আদিবাসী সম্প্রদায়ের অন্যতম উৎসব বৈসাবিকে ঘিরে এখন পাহাড়জুড়ে চলছে আনন্দ আয়োজন। বর্ষবরণকেন্দ্রিক এ উৎসব পালনে আনন্দযজ্ঞে মেতে উঠেছে এ তিন সম্প্রদায়ের লোক।
ত্রিপুরাদের ‘বৈসু’, মারমাদের ‘সাংগ্রাই’ আর চাকমার ‘বিজু’ শব্দের আদ্যাক্ষরের শব্দ সমষ্টিই হলো বৈসাবি। এটি একটি সামাজিক উৎসব। উৎসবটি চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা সম্প্রদায় পালন করলেও পার্বত্য অঞ্চলের কোনো জনগোষ্ঠীই বাদ পড়ে না এর আনন্দ উপভোগ থেকে। উৎসব উপলক্ষে পুরো এলাকাতেই যেনো চলে আনন্দযজ্ঞ। চৈত্রের শেষ দুটি দিন ও নতুন বছরের পহেলা বৈশাখ- এ তিনদিন বৈসাবি পালন করা হয়। আদিবাসী সম্প্রদায়গুলো বৈসাবি উৎসবের মাধ্যমে তাদের কৃষ্টি-সংস্কৃতি তুলে ধরার চেষ্টা করে।
উৎসবে চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরাদের কিছু বিশেষ আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান থাকে। এর মধ্যে চাকমাদের বিজু নৃত্য, ত্রিপুরাদের গরাইয়া নৃত্য ও মারমাদের ঐতিহ্যবাহী জলকেলি উৎসব বা পানি খেলা অন্যতম।
জেলার আটটি উপজেলায় বর্ষবরণ করার জন্য চলছে ব্যাপক প্রস্তুতি। উৎসব পালনের জন্য খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ, জেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন সম্মিলিতভাবে বৈসাবি ও বাংলা নববর্ষ পালন করবে।
এছাড়া প্রত্যেক আদিবাসী গ্রামে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন, ক্লাব ও সমিতির উদ্যোগে এতিহ্যবাহী বিভিন্ন খেলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনের ব্যাপক উদ্যোগ চলছে। পাশাপাশি চলছে ধর্মীয় অনুষ্ঠানেরও প্রস্তুতি।
বৈসাবি উদযাপন উপলক্ষে খাগড়াছড়ি ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট নিজস্ব প্রাঙ্গণে শনিবার থেকে তিনদিনব্যাপী অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে।
উৎসব পালন উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা চাকরিজীবী, স্কুল-কলেজ ও ইউনির্ভাসিটি পড়–য়ারা নিজ গ্রামে মা-বাবা,আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে উৎসবের আনন্দ ভাগাভাগি করতে পার্বত্য এলাকায় আসা শুরু করেছে।
উৎসব উপলক্ষে নিরাপত্তার ব্যাপারে জেলা পুলিশ সুপার আবু কালাম সিদ্দিক জানান, পাহাড়ে বর্ষবরণ উৎসবকে প্রাণবন্ত করার জন্য পুলিশ প্রশাসন নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করেছে। পাহাড়িদের এ উৎসব আনন্দময় করতে আমাদের সবার্ত্মক প্রচেষ্টা থাকবে।
বৈসাবি উৎসবের এদিক-ওদিক
চাকমা সম্প্রদায়: পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য আদিবাসীদের তুলনায় চাকমারা খুব ফুর্তিবাজ জাতি। চাকমারা প্রথম দিনে ফুল বিজু, মুল বিজু ও গোজ্যেপোজ্যে উৎসব পালন করে থাকে। উৎসবের প্রথম দিনে ঘরবাড়ি ও আঙিনা পরিষ্কার করা ও ফুল দিয়ে সাজানো হয়।
এদিন পাহাড়ি ছড়া, ঝর্না বা নদীতে ফুল ভাসিয়ে দিয়ে মা গঙ্গাকে পূজা করে গোসল করা হয়। এছাড়াও পাড়ার যুবক-যুবতীরা নদী থেকে পানি তুলে প্রবীণদের গোসল করিয়ে আশীর্বাদ নেয়। অনেক এলাকায় দল বেঁধে বুদ্ধমূর্তিগুলোকে গোসল করানো হয়। এরপর সারাদিন প্রস্তুতি চলে পরবর্তী দিন বা উৎসবের মূল দিনের খানাপিনার আয়োজন।
উৎসবের দ্বিতীয় দিনে প্রত্যেকের বাড়িতে নানা মুখরোচক খাবারের আয়োজন করা হয়। এতে ৩০-৩৭ বা তার বেশি উপকরণ দিয়ে তৈরি পাচন এবং পানীয় পরিবেশন করা হয়।
তৃতীয় দিনে দল বেঁধে মন্দিরে গিয়ে নতুন বছরে সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা বা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানাদি পালন করা হয়। এদিন অনেকে পাড়ার মুরব্বিদের বাড়িতে ডেকে ভালো কিছু খেতে দেন। আবার কেউ কেউ উৎসবের তিনদিন মন্দির, বাড়ির আঙিনা, নদীর ঘাট, সবুজ গাছের নিচে এবং গোয়াল ঘরে বিভিন্ন দেব-দেবীর উদ্দেশ্যে মোমবাতি জ্বালান।
মারমা: মারমাদের সাংগ্রাই প্রথম দিনকে পেইংছুয়ে (১৩ এপ্রিল), দ্বিতীয় দিনকে আকে মূল সাংগ্রাই, তৃতীয় দিনকে আক্যে ও চতুর্থ দিনকে আপ্যেইং আতাদা হিসেবে পালন করে।
পুরানো বছরের দুঃখ-গ্লানি মুছে ফেলে নতুন বছরকে বরণ করে ঐতিহ্যবাহী মৈত্রী পানীয় উৎসব বা জলকেলি উৎসবের মাধ্যমে এ সম্প্রদায়ের যুবক-যুবতীরা একে অপরকে বর্ষবরণ ও বিদায় বৃষ্টিতে সিক্ত করে।
মারমারা সাংগ্রাই প্রধান উৎসবের কেন্দ্রস্থল মন্দির বা ক্যায়াং ঘরে প্রথম দিনে ভালোভাবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতায় মেতে ওঠে। দায়ক-দায়িকারা টানা তিনদিন অবস্থান নিয়ে দীক্ষায় অভিভূত হয়ে বুদ্ধ মূর্তির সামনে ফুল রেখে ও মোমবাতি জ্বালিয়ে প্রণাম করে। পাড়ার লোকজন ক্যায়াং ঘরে গুরু, ভিক্ষু, শ্রমন, সাধু-সাধুমাদের উদ্দেশ্যে ছোয়াইং প্রদান করে।
চন্দনের পানি, দুধ ও ডাবের পানি দিয়ে বুদ্ধ মূর্তিকে স্নান করানোর মধ্য দিয়ে সূচনা হয় সাংগ্রাইয়ের নতুন বছর । ভাইবোন সকলেই এসে একত্রে আনন্দ করে কুস্তি খেলা নৌকাবাইচ, খৈঞাং খেলাসহ বিভিন্ন আয়োজন করে থাকে।
ত্রিপুরাদের ‘বৈসুক’: ত্রিপুরাদের বৈসুক সাধারণত সামাজিক উৎসব। ত্রিপুরারা বাংলা সনের শেষ দিনটিকে বৈসুমা বা বৈসুকমা, তার আগের দিনটিকে হারি বৈসু এবং নববর্ষ বা বৈশাখ মাসের প্রথম দিনটিকে তারা আতাডাং বলে।
হারি বৈসুককের দিন তারা বিভিন্ন ধরনের ফুল দিয়ে ঘর সাজায়, গরু, মহিষ, ছাগলসহ গৃহপালিত পশুদের অনেকে ফুলের মালা পড়িয়ে থাকে এবং খুব ভোরে ঘর থেকে ছেড়ে দেয়। নদীতে গিয়ে ফুল দিয়ে নদীমাতা গঙ্গাকে পূজা দেয়। ছেলে-মেয়েরা নতুন কাপড় পড়ে ঘরে-ঘরে ঘুরে বেড়ায়।
হারি বৈসুকের দিনে ত্রিপুরা জাতিগোষ্ঠী জেলার নুনছড়িতে পাহাড়ের শীর্ষদেশে অবস্থিত ‘মাতাই পুখিরি’ বা দেবতা পুকরে যায় এবং বিভিন্ন ধরনের ধর্মীয় পূজাদি সম্পন্ন করে। আবার অনেকে পুকুর থেকে জল এনে তাদের নানা-নানী, দাদা-দাদীসহ স্থানীয় গুরুজনদের স্নান করায় তাদের আর্শীবাদ প্রাপ্তির জন্য।
ত্রিপুরারা তাদের বৈসুমা দিনে অতিথিদের চোয়াক বা মদ, পিঠা, পাচন ও বিভিন্ন ধরনের উপকরণ দিয়ে আপ্যায়ন করে এবং পহেলা বৈশাখের দিনে দেবতাদের উদ্দেশ্যে হাঁস-মোরগ-ছাগল ইত্যাদি উৎসর্গ করে এবং আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের আপ্যায়ন করে খাওয়ায়।
পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাড়াও কক্সবাজার এবং পটুয়াখালী মগ (রাখাইন) সম্প্রদায়ও বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ উৎসব পালন করে থাকে। তারা এ উৎসবকে মহা সাংগ্রাইং বলে। এছাড়াও পাশ্ববর্তী দেশ ভারতের আসাম, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মিয়ানামার (বার্মা), থাইল্যান্ড, লাওসসহ বেশ কয়েকটি দেশে একই সময় অর্থাৎ ইংরেজি মাস এপ্রিলের ১২-১৭ তারিখের মধ্যে উৎসবটি পালন করা হয় বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়।
এ উৎসব আসামে বিহু, মিয়ানমারে ছিংগায়ান এবং থাইল্যান্ডে সংক্রান্ত নামে পরিচিত। কিছু বৈশিষ্ট্য বাদ দিলে সব দেশের পালনের রীতিনীতি একই বলে জানা যায়।
বৈসাবি উৎসব কর্মসূচিতে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদার, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা), পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড চেয়ারম্যান বীর বাহাদুর এমপি, ভারত প্রত্যাগত শরণার্থীবিষয়ক টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান যতীন্দ্র লাল ত্রিপুরা এমপি, তিন সার্কেল প্রধান ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানসহ আদিবাসী পাহাড়ি নেতারা অংশ নেবেন।
বালাদেশ সময়: ০৯১৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ১০, ২০১১