
বাগেরহাট: ১৫ নভেম্বর দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের মানুষের জন্য এক ভয়াল দিন। আঘাতহানা প্রলয়ঙ্করি ঘূর্ণিঝড় সিডরের ষষ্ঠতম বর্ষপূতি আজ।
২০০৭ সালের এ দিনে বাগেরহাটসহ উপকূলের জনপদে আঘাত হানে সুপার সাইক্লোন সিডর। কিছু বুঝে উঠার আগেই লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় উপকূলীয় এলাকা।
ঘণ্টায় ২৪০ কিলোমিটার গতিবেগে ছুঁটে আসা বাতাস (ঝড়) আর বঙ্গোপসাগর থেকে ধেয়ে আসা জলোচ্ছ্বাসে মুহূর্তে মৃত্যুপুরিতে পরিণত হয় উপকূলের জনপদ। প্রায় ১০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস সেদিন এ জনপদের সর্বস্ব ভাষিয়ে নেয়।
সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল বাগেরহাট জেলার শরণখোলা এবং সাউথখালি এলাকা। ব্যাপক ক্ষতি হয় সাতক্ষীরা, খুলনা, পটুয়াখালী, বরগুনা এবং ঝালকাঠি জেলাতেও। সেদিন সিডর ধ্বংসলীলা চালায় সুন্দরবনের একাংশের উপরও। মারা যায় প্রায় সাড়ে তিন হাজারের মতো মানুষ। গবাদি পশু, ফসল সবকিছু হারিয়ে আশ্রয়হীন হয় কয়েক লাখ মানুষ।
ওই সময়কার এক সরকারি প্রতিবেদন অনুযাই সিডরে কারণে তখন নষ্ট হয়েছে প্রায় ৬ লাখ টন ধান। মারা যায় প্রায় ২ লাখ ৪২ হাজার গৃহপালিত পশু এবং হাঁস-মুরগী। ধ্বংস হয় ৯ লাখ ৬৮ হাজার ঘর-বাড়ি। নষ্ট হয় ২১ হাজার হেক্টর জমির ফসল। মারা যায় সুন্দরবনের বিপুল সংখ্যক প্রাণী।
ছয় বছর পার হয়েছে। অনেকটাই ঘুরে দাঁড়িয়েছে অসম্ভব সাহসী আর উদ্যমী সাগর পাড়ের মানুষ গুলো। কিন্তু কেউই ভুলতে পারেনি সেদিনের সে ভয়াল স্মৃতি। সেই দিনের সেই বিভীষিকাময় দুর্বিসহ স্মৃতি মনে করে এখনও কেঁদে ওঠেন স্বজন হারানো মানুষেরা।
শুধু স্বজন হারারাই নয় ত্রাণ আর সাহায্য নিয়ে দুর্গতদের কাছে ছুটে যাওয়া সে মানুষ গুলোও ভুলতে পারে নি নদী, খালবিলে পশুপাখি আর মানুষের একাকার হয়ে ভাসতে থাকা লাশের মিছিলের স্মৃতি।
নাসিমা বেগম, সিডরে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত শরণখোলার উপজেলার সাউথখালি ইউনিয়নের সুন্দরবন সংলগ্ন সোলাতলা বাসিন্দা। সিডরে হারিয়েছেন পরিবারের একমাত্র উপার্যনক্ষম ব্যক্তিটিকে।
তার নিজ বাড়িতে বসে কথা হয় তার সঙ্গে। বাঁধের বাইরের একটুকরো জমিতে ছোট একটি টিনের ঘর। সেখানেই থাকেন দুই মেয়ে আর এক ছেলেকে নিয়ে। সিডরে ঘর, হাঁস-মুরগী, গবাদি পশুর সঙ্গে হারিয়েছেন তার স্বামীকেও।
নাসিমা জানান, সেদিন তার স্বামী মাছ ধরতে সুন্দরবনে ছিল। ঝড়ের দু’দিন পর তার লাশ পাওয়া যায়। বেশ দূরের এক সাইক্লোন শেন্টারে ৩ ছেলে মেয়েকে নিয়ে প্রাণ বাঁচালেও পরণের কাপড় ছাড়া আর কিছুই রক্ষা করতে পারেনি তিনি।
বেশ দুর্গম হওয়া ত্রাণ পেয়েছিলেন প্রায় আড়াই দিন পর। তারপর পেয়েছেন অনেক সাহায্য সহযোগিতা। নানা নিয়ম আর অনিয়মের পর পাওয়া সে সাহায্যে যেমন খুশি তিনি, তেমনি কৃতজ্ঞ সেদিন পাশে দাঁড়ানো সে মানুষ গুলোর প্রতি।
তিনি বলেন, তাদের সাহায্যেই চলেছে পুরো এক বছর। মিলেছে মাথা গোজার ঠাঁইও। এরপর ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া এবং নিয়মিত স্কুলে পাঠাবার জন্য এক সঙ্গে কিছু টাকা পান। তা দিয়ে দু’টি গরু ও কিছু হাঁস-মুরগি কেনেন। বড় ছেলে এখন আয়করে। এভাবে আস্তে আস্তে এখন অনেকটা সামলে উঠেছেন তিনি।
তাদের বাসা থেকে দু-তিনশ গজ দূরের এক বৃদ্ধার সঙ্গে কথায়। সে দিনের তিনি হারিয়েছে ৪ ছেলে আর ৩ নাতিকে। এমন স্বজন হারানো আর ঘুরে দাঁড়ানর গল্প এখানকার প্রায় সব ঘরে।
সাউথখালির সবুর হাওয়ালাদার সিডরে হারিয়েছেন পরিবারের ৭ জনকে। জানালেন সাইক্লোনের আঘাতের পরদিন দেখেছিলেন তার গ্রামের সবকিছু মাটিতে মিশে গেছে। আক্রান্ত অনেকেই আজও নিজ পেশায় ফিরতে পারেননি। জানালেন সিডরের কারণে সেখানকার ধনী এবং গরীব সবাই এক কাতারে নেমে এসেছে।
সিডরের পরই মরদেহ প্রতি সরকার ক্ষতিগ্রস্তদের ১০ হাজার করে টাকা দান করে এবং পরে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে ১১ জন করে একত্রে মাছ ধরার ট্রলার দিয়েছিল।
সবুর হাওয়ালাদার বলেন, এনজিও থেকেও কিছু সাহায্য তারা পেয়েছেন। তবে তাতে সবাই পুরোপুরি উঠে দাঁড়াতে পারেননি।
সিডরে ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে কথা বলে আমার ব্যবহৃত ব্যাগটি কাঁধে নিয়ে ফিরছিলাম। আর পথে দেখা মেলে এনজিও শব্দটার ভয়াবহতার সঙ্গে। ছোট একটি বাচ্চা, বয়স আনুমানিক সাড়ে ৩ বা ৪ হবে। দেখেই বলে উঠল মা বড়িতে নাই। আমি অবাক! কিছুই বুঝতে পারলাম না। পরে কথা বলে জানতে পরলাম বাচ্চাটি আমাকে সমিতির লোক ভেবেছিলো।
’সমিতি’ কিস্তিও দিতে হয় তাদের। এনজিও এর একটি ব্যতিক্রমী ধারা। লোন দিয়ে কিস্তিতে কিস্তিতে টাকা নেওয়া হয়। আমাকে সেই টাক নিতে আসা সমিতির লোক ভেবেই বাচ্চাটার ওই উক্তি করে।
সিডরের আগে থেকেই এ অঞ্চলে কাজ করতো বেশ কয়েকটি এনজিও। আর সিডরের পরে তার সংখ্যা বেড়েছে ময়লা পানিতে মশা বৃদ্ধির মতো। আর এখন অনেক এনজিওই এমন আতঙ্কের পরিস্তিতি সৃষ্টি করেছে এখানে।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বা এনজিওকে এক তরফা এমন অপবাদ দেওয়া আবার ঠিক নয়। তাদের অনেকেই এখানকার মানুষের ভাগ্য বদলে সাহায্যা করেছেন। তবে ঋণ নেওয়া বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অভিশাপ এখানে।
বেসরকারি সংস্থার সাহায্যে এলাকা এক ফসলি জমিতে এখন চাষ হচ্ছে নতুন ধরনের রবি শস্যের। ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াইয়ে তাদের এমন প্রচেষ্টায় আশায় বুক বেঁধেছেন সেখানকার মানুষ।
সেদিন সিডরের সে নিষ্ঠুরতায় সহস্রাধিক মানুষের হারিয়ে যাওয়া, ঘরবাড়ি, গাছপালা, ফসল, গবাদি পশুর নিশ্চিহ্ন হওয়ার দিনটিকে প্রতিবছর বেসরকারি বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবি সংগঠন নানা আয়োজনে ‘সিডর’ দিবসটি পালন করে থাকে। নিহতদের স্মরণে ঘরে ঘরে কোরআন খানি, মসজিদ-মন্দিরে বিশেষ দোয়া ও প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হয়। সে রকম প্রস্তুতি চলছে এবারেও।
কিন্তু দেশের সব ক্ষেত্রের মতো এখানকার মানুষ গুলোর সমস্যা আর তা সমাধানের জন্য প্রকৃতপক্ষে কতটা কাজ করা হয়েছে এখানে?
হ্যাঁ, প্রচুর প্রচুর সাহায্য এসেছে। প্রচুর পেয়েছেও এখান কার মানুষ। আবার তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও আছে এখানে। অকপটে শিক্ষিত অনেকেই স্বীকার করেন তা। একতরফা সাহায্য অলস আর অতিমাত্রায় সাহায্য প্রত্যাশী করেছে এখানকার লোকদের। অনেকেই আছেন কাজ নয় সাহায্য পেতেই বেশি প্রত্যাশী। যদিও এখন বাধ্য হয়েই তাদের বের হতে হয় কজের জন্য। কিন্তু সেইভাবে কাজ নেই এখানে। আর থাকলেও তার সারা বছর ধরে নয়।
তাই তো সিডর আক্রান্ত এসব এলাকায় মানুষের মাঝে দিন দিন বাড়ছে শহরমুখী প্রবণতা। পিছু ছাড়ছেনা ঋণ কিংবা কিস্তি বেড়াজাল।
এলাকায় কাজ করা উন্নয়ন কর্মী, জনপ্রতিনিধি ও শিক্ষক দের সঙ্গে কথা বলে জানান যায়, এসব এলাকায় দরকার দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পান নিয়ে কাজ করা। শুধু কাবিখা, টিআর, ভিজিবি বা কার্ডধারীদের সাহায্য নয়, দরকার এলাকার সার্বিক উন্নয়ন। কাজের সুযোগ সৃষ্টি। আর এর জন্য দরকার সমীক্ষা।
তারা জানা, সমীক্ষা হয়েছে অনেক। এখন দরকার সেগুলোর সমন্বয় করে বাস্তবমুখী সিদ্ধান্ত গ্রহণ। দরকার যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, সামাজিক নিরাপত্তা আর সমন্বিত উদ্যোগ। আর তাদেই ফিরবে এসব এলাকার আর্থসামাজিক অবস্থা। কমবে শহর মুখিতা।
বাংলাদেশ সময়: ১৩০২ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৫, ২০১৩
এসএইচ/জিসিপি