ঘাতক থেকে মন্ত্রী!

অশোকেশ রায়, অ্যাক্টিং আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম | আপডেট: ১৪৩১ ঘণ্টা, অক্টোবর ৯, ২০১৩

ঢাকা: মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয়ের পর মানবতাবিরোধী ঘৃণ্য অপরাধের দায়ে যাকে লোহার খাঁচায় পুরে জনগণের দেখার জন্য প্রদর্শনী করা হয়েছিল, মাত্র কয়েক বছরের মাথায় জিয়াউর রহমান সেই যুদ্ধাপরাধীর গাড়িতেই তুলে দেওয়া হয় জাতীয় পতাকা।

একাত্তরের রাজাকার কমান্ডার, শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান আর ঘাতক থেকে মন্ত্রী-এমপি বনে যাওয়া সেই ব্যক্তির নাম আব্দুল আলীম।

জীবন সায়াহ্নে এসে অবশ্য তার কৃতকর্মের শাস্তি ঠিকই পেলেন এই ঘৃণ্য যুদ্ধাপরাধী। বুধবার তার আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশ দিয়ে রায় ঘোষণা করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। তার বিরুদ্ধে আনা ১৭টি অভিযোগের মধ্যে ৯টি প্রমাণিত হলেও শারীরিক-মানসিক অক্ষমতার কারণে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে এ শাস্তি দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।      

কে এই আলীম
আবদুল আলীম ১৯৩০ সালের ১ নভেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হুগলি থানার পাঁদুয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম আব্দুল ওয়াহেদ। ১৯৫০-৫১ সালে আলীমের পরিবার তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের বগুড়া জেলার জয়পুরহাট মহকুমা সদরের থানা রোডে এসে বসবাস শুরু করেন। আলীম ১৯৫৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করার জন্য ঢাকায় আসেন। স্যার সলিমুল্লাহ্ হলে থেকে তিনি লেখাপড়া করতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামের ইতিহাসে এমএ পাস করে তিনি ঢাকা ও জয়পুরহাট এই দুই স্থানে বসবাস শুরু করেন।

১৯৫৮ সালে আব্দুল আলীম মুসলিম লীগে যোগ দেন এবং ১৯৬২ সালে দলের বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পান। একাত্তরে তিনি কনভেনশন মুসলিম লীগের প্রভাবশালী নেতা ছিলেন। আইয়ুব খান সে সময় তাকে বগুড়া জেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত করেন। পরে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। পাকিস্তানের পার্লামেন্ট সেক্রেটারিও ছিলেন আলীম।

আলীমের যতো মানবতাবিরোধী অপরাধ
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বগুড়ার কনভেনশন মুসলিম লীগের নেতা বগুড়া জেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল আলীম অন্য স্বাধীনতাবিরোধী লোকদের নিয়ে জয়পুরহাট মহকুমা শান্তি কমিটি গঠন করেন। এর চেয়ারম্যান হিসেবে পরবর্তী সময়ে রাজাকার বাহিনী গঠন করে নেতৃত্ব দেন। তারই নির্দেশে ও পরিচালনায় আক্কেলপুরসহ জয়পুরহাটের নানা থানা, ইউনিয়ন ও গ্রামে শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়।

সে সময় পাকিস্তানি বাহিনীর মেজর আফজালের সঙ্গে তিনি জয়পুরহাটে বিভিন্ন অপকর্মের নেতৃত্ব দেন। জামায়াতের প্রয়াত নেতা আব্বাস আলী খান ও আব্দুল আলীমের নেতৃত্বে পাকিস্তানি বাহিনী এবং এ দেশীয় রাজাকার-আলবদর ও শান্তি কমিটির সদস্যরা জয়পুরহাটে বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি করে।

আলীমের বিরুদ্ধে হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ, শারীরিক নির্যাতন, দেশান্তরকরণ এবং অপহরণের সাত ধরনের মোট ১৭টি অভিযোগে সর্বমোট ৫৮৫ জনকে হত্যা ও গণহত্যার অভিযোগ আনা হয়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে: ডা. কাশেমসহ চারটি জায়গা থেকে ৪৫ জনকে ধরে এনে নির্যাতন ও হত্যা, জয়পুরহাট চিনিকলে ২৩ জনকে হত্যা, পাঁচবিবির নওদা গ্রাম থেকে ছয়জনকে ধরে নির্যাতন ও হত্যার পর কালি সাহার পুকুরে গণকবর দেওয়া, পেঁচুলিয়া গ্রামের ছয়জনকে ধরে এনে নির্যাতন ও হত্যা, নূরপুর গ্রাম থেকে ১০ জনকে ধরে এনে নির্যাতন ও নয়জনকে হত্যা, কড়ইকাঁদিপুর গ্রাম ও আশপাশের হিন্দুপাড়ায় অগ্নিসংযোগ ও ৩৭০ জনকে গণহত্যা, পাহুনন্দা গ্রামের বিভিন্ন মসজিদ থেকে ২৮ জন মুসল্লিকে অপহরণ করে নির্যাতন ও পরে ২২ জনকে গণহত্যা করে গণকবর দেওয়া, কোকতারা পুকুরে ৮৪ জনকে গণহত্যা, জয়পুরহাট কলেজের সামনের পুকুরে দু’টি ট্রাকে ১১ জনকে ধরে নির্যাতনের পর গণহত্যা, পাহাড়পুরের মঙ্গলবাড়ী এলাকা থেকে ২৬ জন মুক্তিযোদ্ধাকে ধরে এনে নির্যাতনের পর গণহত্যা ও গণকবর দেওয়া, মুক্তিযোদ্ধা খোকন পাইকারসহ ১৫ জনকে ধরে এনে নির্যাতনের পর গণহত্যা ও গণকবর দেওয়া এবং খাস পাহুনন্দা ও আশপাশের গ্রাম থেকে ৬৭ জনকে ধরে এনে নির্যাতনের পর গণহত্যা।

এছাড়া তদন্ত প্রতিবেদনে আলীমের বিরুদ্ধে রামচন্দ্রপুর গ্রামের তিনজনসহ অসংখ্য নারী ধর্ষণের অভিযোগ রয়েছে।

আলীমের বিরুদ্ধে আনা ১৭টি অভিযোগের মধ্যে ১৫টিতে বিভিন্ন ঘটনায় মোট ৫৮৫ জনকে হত্যার অভিযোগ রয়েছে। বাকি দু’টি অভিযোগ আনা হয়েছে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, আটক ও দেশান্তরে বাধ্য করার ঘটনায়। এসব অভিযোগ আনা হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন’১৯৭৩ এর ৩(১), ৩(২)(এ), ৩(২)(সি), ৩(২)(জি), ৩(২)(আই), ২০ (২) এবং ৪ (১) ও ৪ (২) ধারা অনুসারে।

হত্যার অভিযোগের ১৫টি ঘটনার মধ্যে তিনটি গণহত্যার অভিযোগ রয়েছে, যাতে মোট ৪০৬ জনকে হত্যা করা হয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। শহীদদের বেশিরভাগই ছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়ের।

এছাড়া যুদ্ধাপরাধের ঘটনায় ‘সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটির’ জন্যও অভিযুক্ত হয়েছেন আব্দুল আলীম।

দশ হাজার মানুষের বধ্যভূমি
মুক্তিযুদ্ধের সময় জয়পুরহাটের সীমান্ত দিয়ে আসা-যাওয়া করতেন মুক্তিযোদ্ধারা। শহর থেকে ১৮ কিলোমিটার পশ্চিম-উত্তরে যে সীমান্তরেখা রয়েছে সেই সীমান্ত পথ ধরেই মুক্তিযোদ্ধারা আসতেন। ট্রেনিং নেওয়ার জন্যও একই পথ ধরে যেতেন তারা। এ পথেই ভারতে যেতেন বিভিন্ন স্থান থেকে আসা শরণার্থীরাও। রাজাকারেরা এই পথে ও আশপাশ থেকে হত্যা করতো মুক্তিযোদ্ধাদের। হত্যা করা হতো শরণার্থী শিবিরে যাওয়া উদ্বাস্তুদেরও।

ওই পথেরই পাগল দেওয়ান গ্রামে মাজারের পাশ থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার এলাকা জুড়ে দশ হাজারেরও বেশি মানুষের লাশ চাপা দেওয়া হয়েছে। এ বধ্যভূমিতে অনেককে হত্যা করা হয়েছে আব্দুল আলীমের নির্দেশে। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে পাগলা দেওয়ান গ্রামে প্রায় ১০ হাজার নারী-পুরুষ ও শিশুকে হত্যা করে মাটি চাপা দেওয়া হয়।

শাওনলালের গদিঘর দখল করে শান্তি কমিটির অফিস
একাত্তরের ২১ এপ্রিল পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী জয়পুরহাট মহকুমা এলাকা দখল করে। ওই দিনই আব্দুল আলীমের নেতৃত্বে জয়পুরহাট থানা রোডের তারই বাড়ির পাশের ধনাঢ্য ব্যক্তি শাওনলাল বাজলা ও তার পরিবারকে তাড়িয়ে শাওনলাল বাজলার গদিঘর (বাণিজ্যিক দফতর) দখল করা হয়। এর আগে তাকে ও তার পরিবারকে হত্যার হুমকি দেওয়া হলে তারা ভারতে চলে যান। পরবর্তীতে ২১ এপ্রিল তার বাড়ি দখল করা হয়।

শাওনলাল বাজলার গদিঘরকে মহাকুমা শান্তি কমিটির অফিস, পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্প ও রাজাকারদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র করা হয়। সেখানে গদিঘরের দোতলায় পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা মেজর আফজালের থাকার ব্যবস্থা করা হয়। আব্দুল আলীম ও তৎকালীন শান্তি কমিটির নেতা জামায়াতের আব্বাস আলী খান (বর্তমানে মৃত) পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করার জন্য সেখানে যেতেন।

এখানকার অফিস ও রাজাকার ক্যাম্প থেকেই যাবতীয় মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেন মহাকুমা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান আলীম। তার নির্দেশে জয়পুরহাটের বিভিন্ন থানা, ইউনিয়ন ও গ্রামে শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় আব্দুল আলীমের নিজের বাড়িটিও ছিল জয়পুরহাটের রাজাকার রিক্রুটমেন্ট ক্যাম্প। আব্দুল আলীমের দায়িত্ব ছিল রাজাকার রিক্রুট করা।

আলীম ও পাকিস্তানি মেজর আফজালের নীলনকশা ও পরিকল্পনায় জয়পুরহাটের বিভিন্ন থানা, পার্শ্ববর্তী নওগাঁ এবং দিনাজপুরের সীমান্তবর্তী এলাকায় শান্তি বাহিনীর সহায়তায় ধ্বংসযজ্ঞ চালায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী।

কড়ই কাঁদিপুর গণহত্যা
একাত্তরের ২৬ এপ্রিল জয়পুরহাট মহাকুমার কড়ই কাঁদিপুর এলাকায় গণহত্যা চালায় আলীমের নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, শান্তি কমিটির সদস্য ও রাজাকাররা। দিনভর এ নারকীয় হত্যাযজ্ঞে হত্যা করা হয় হিন্দু জনগোষ্ঠীর ৩৭০ জনকে, যাদের মধ্যে এক জনকে জীবন্ত কবর দেওয়া হয়।  

সকাল আনুমানিক ৯টার দিকে আলীম তার নেতৃত্বাধীন পাঁচবিবি শান্তি কমিটির সভাপতি কাসেম উদ্দিন চৌধুরী (বর্তমানে মৃত), আজগর বিহারি (বর্তমানে মৃত) রমজান মাস্টার (বর্তমানে মৃত), রিয়াজ মণ্ডল (বর্তমানে মৃত) ও শান্তি কমিটির অন্যান্য সদস্য এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে নিয়ে সম্পূর্ণ ধর্মীয় বিদ্বেষে হিন্দু সম্প্রদায়কে নিশ্চিহ্ন করার জন্য রওনা হন। তারা জয়পুরহাট মহকুমার কড়ই কাঁদিপুর এলাকার কড়ই, কাঁদিপুর বা কাঁদিপাড়া, চকপাড়া, সোনার পাড়া, পালপাড়া, মুন্সিপাড়া, যুগীপাড়া ইত্যাদি হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামে অতর্কিত হামলা চালান।

তারা সেখানে প্রত্যেক বাড়িতে হামলা চালিয়ে বাড়ির সমস্ত মালামাল লুটপাট ও বাড়িঘর অগ্নিসংযোগে ভস্মীভূত করাসহ সম্পূর্ণ ধ্বংস করেন। ওই ধ্বংসযজ্ঞ চালানোকালে এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে সমগ্র এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করা হয়।

আবদুল আলীম ও তার দুষ্কর্মের সঙ্গীরা এলাকার বিভিন্ন গ্রাম থেকে পুরুষ ও নারীদের ধরে এনে দু’কাতারে ভাগ করে যুবক ও বৃদ্ধদের আলাদাভাবে আটক করেন। আটককৃত এসব ব্যক্তিদের মধ্যে কাঁদিপুর আখের চুল্লির কাছে ৭০ জন, কাঁদিপুর ডোমপুকুরে ৯০ জন, চকপাড়ার কুড়ালপুরে ২৬ জন, চকপাড়া কুড়ালপুরের কাছের রাস্তার লাগোয়া উত্তর পাশে পাইকগাছে (বটগাছ) প্রাণরক্ষার্থে আশ্রয় গ্রহণকারী ৫ জনসহ মোট ৩৭০ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

বিকেল ৫টা পর্যন্ত এই গণহত্যা চলে। পরে গ্রামবাসী মাটি খুঁড়ে তাদের গণকবর দেন।

শহীদদের মধ্যে রয়েছেন লক্ষণ চন্দ্র দেবনাথ, অশ্বিনী চন্দ্র দেবনাথ, দেবেন্দ্র চন্দ্র দেবনাথ প্রকাশ ননী, যোগেন্দ্র চন্দ্র দেবনাথ, মহেন্দ্র চন্দ্র দেবনাথ, জ্যোতিষ চন্দ্র দেবনাথ, ক্ষিতিশ চন্দ্র দেবনাথ, পরীক্ষিত চন্দ্র দেবনাথ, যতন চন্দ্র দেবনাথ, দিলীপ চন্দ্র দেবনাথ, আমিন্দ্র চন্দ্র দেবনাথ, সুরেশ চন্দ্র দেবনাথ, অনাথ চন্দ্র দেবনাথ, গোপীনাথ চন্দ্র দেবনাথ, সুধাংশু চন্দ্র দেবনাথ, গোপেন চন্দ্র দেবনাথ, ক্ষুদিরাম চন্দ্র দেবনাথ, শিবেন চন্দ্র দেবনাথ, খোকন চন্দ্র দেবনাথ, সুখচান চন্দ্র দেবনাথ, রতন চন্দ্র দেবনাথ, ভুলাচন্দ্র দেবনাথ, যোগেশচন্দ্র দেবনাথ, কানচিরা হোমন্ত, সেদরা চন্দ্র বর্মণ, কৃষণ চন্দ্র বর্মণ, তরমুজা বর্মণ, বাণীকান্ত চন্দ্র বর্মণ, ঘোনাচন্দ্র বর্মণ, ব্যাঙ্গা চন্দ্র্র বর্মণ, দুকা চন্দ্র বর্মণ, সন্তোষ চন্দ্র বর্মণ, গৌর চন্দ্র বর্মণ, শিবেন চন্দ্র বর্মণ, প্রিয়বন্দ বর্মণ, দীননাথ বর্মণ, নুশাদ চন্দ্র বর্মণ ও পাঁচকড়িচন্দ্র বর্মণ। অশ্বিনী কুমার দেবনাথ নামের একজনকে জীবন্ত কবর দেয় হামলাকারীরা।
abdul-alim-old
পাহনন্দা গণহত্যা
একাত্তরের বাংলা আষাঢ় মাসের প্রথম সপ্তাহে শুক্রবার বেলা ২টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত এই গণহত্যা চালানো হয়।

শুক্রবার জুমার নামাজ আদায় শেষে এবং আদায়ের আগে আব্দুল আলীমের পরামর্শ ও প্ররোচনায় চিরোলা গ্রামের শান্তি কমিটির সদস্য রিয়াজ মৃধার (বর্তমানে মৃত) সহযোগিতায় ১১ জন পাকিস্তানি সেনা ২২ জন মুসল্লিকে আটক করে। তারা নওপাড়া, চরবরকত, চিলোরা গ্রামের আনুমানিক ৫০০ জন লোককেও আটক করে। সেখানে আটককৃত সবাইকে আফাজের বাড়ির উঠানে নিয়ে লাইন করে দাঁড় করায়।

রাজাকাররা আলীমের দেওয়া একটি তালিকা দেয় পাকিস্তানি সেনাদের। ওই তালিকা দেখে আওয়ামী লীগ, মুক্তি সংগ্রামী ও তাদের আত্মীয় ২৮ জনকে রেখে বাকিদের ছেড়ে দেওয়া হয়। ২৮ জনকে পিছমোড়া করে বেঁধে আফাজের বাড়ির মাটির ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। এক গ্রুপে ৮ জনকে করে ২২ জনকে হত্যা করা হয়। বাকি ৬ জন বেঁচে যান।

যাদের হত্যা করা হয় তারা হলেন, মফিজ উদ্দিন দেওয়ান (৭০), খোকা (৩৫), বাহারউদ্দীন (৪৫), নেকুল (৫০), মমতাজ (২৫), অনেস (৬০), জয়মুদ্দীন (৬০), আজিম উদ্দিন (৩৫) ও আরও অজ্ঞাতনামা ১৪ জন। আহতরা হলেন আবেদ হোসেন (৬২), মোজাফফর (৬২) ও মোজাম্মেল হোসেন (৩২)।

২৬ মুক্তিযোদ্ধা হত্যা
একাত্তরের জুন মাসের শেষের দিকে এক রাতে পাহাড়পুরের মঙ্গলবাড়ী এলাকা থেকে ২৬ জন মুক্তিযোদ্ধাকে ধরে আনা হয়। পরদিন সকালে আব্দুল আলীম জয়পুরহাট সদর রোডের শাওনলাল বাজলার গদিঘরে শান্তি কমিটির অফিসে শান্তি কমিটির সভায় আটককৃত ২৬ যুবককে হত্যার সিদ্ধান্ত নেন। এ সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে শান্তি কমিটির অফিসের সামনে ২টি ট্রাকে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের জয়পুরহাট রেলস্টেশনের পশ্চিমে ফাঁকা জায়গায় নিয়ে যান তিনি। সেখানে তাদের ট্রাক থেকে নামিয়ে হাত বেঁধে লাইন করে বসান।

আটককৃত যুবকদের সামনে নিজেদের হেফাজত থেকে কয়েকটি অস্ত্র রেখে দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, শান্তি কমিটির সদস্য ও রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা পাহারা দিতে তাদের পেছনে দাঁড়ায়।

আব্দুল আলীম আটককৃত মুক্তিযোদ্ধাদের এভাবে তাদের হেফাজতে রেখে সকাল আনুমানিক ১০টার দিকে স্থানীয় ‘আলোখেলা’ স্টুডিওতে যান। সেখানে গিয়ে স্টুডিওর মালিক এইচএম মোতাছিম বিল্লাকে বলে, মুক্তিযোদ্ধাদের ছবি তুলতে হবে। রিকশায় ওঠো। তার সঙ্গে একই রিকশায় একটি ক্যামেরাসহ যুবকদের আটককৃত স্থানে আসেন।

এরপর আটককৃত যুবকদের পেছনে আগেই দাঁড়ানো পাকিস্তানি দখলদার সেনাবাহিনীর সদস্যদের পাশে শান্তি কমিটির সদস্য মিনা মোখলেছ (বর্তমানে মৃত), মেজর আফজাল ও নিজে দাঁড়িয়ে আব্দুল আলীম এইচএম মোতাছিম বিল্লাকে ছবি তুলতে নির্দেশ দেন। এরপর নিজ ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলে মোতাছিম বিল্লা নিজ স্টুডিওতে ফিরে যান এবং নির্দেশ মতো ছবির কাজ শুরু করেন।

ছবি তুলে নিয়ে যাবার পর আব্দুল আলীম মেজর আফজালের সঙ্গে শলা-পরামর্শ করেন। শলা-পরামর্শের পর আটককৃত ২৬ মুক্তিযোদ্ধাকে পুনরায় ট্রাকে তুলে তাদের জয়পুরহাট সরকারি কলেজে নিয়ে যান এবং সেখানে তাদের হত্যা করা হয়। সেখানে আব্দুল আলীম উপস্থিত ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, কলেজ ছাত্ররা, তোমরা বুঝতেই পারছো মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থা। এরা কিছুক্ষণ পরেই মারা যাবে। তোমরা যদি এ রকম মুক্তিযোদ্ধা হও তোমাদের পরিণতিও এমন হবে।

ছবি তোলার পরের দিন আব্দুল আলীম স্টুডিওতে এসে স্টুডিওর মালিকের কাছ থেকে নেগেটিভসহ তিন কপি ছবি নিয়ে গেলেও স্টুডিওর মালিক এর কয়েকটি কপি নিজের কাছে রেখে দেন।

২৬ গাড়োয়ালকে হত্যা
মুক্তিযুদ্ধের সময় এপ্রিল মাসের শেষের দিকে স্থানীয় গাড়োয়াল সম্প্রদায়ের মোট ২৬ জনকে আটক ও হত্যা করা হয় আলীমের নির্দেশে। যাদের হত্যা করা হয় তারা হলেন- মোঃ মোখলেসুর রহমান, আহাদ আলী, নজের আখন্দ, আমজাদ হোসেন, আব্দুল গফুর, আবের জোয়ারদার, ভিকন প্রামাণিক, আছির আকন্দ, লজের আখন্দ, মোয়াজ্জেম, তোফাজ্জল ও অপরিচিত আরও ১৫ নিরীহ নিরস্ত্র গাড়োয়াল।

জানা গেছে, আব্দুল আলীমের নির্দেশে পাকিস্তানি সৈন্যরা সড়ক থেকে ২৬ জন নিরীহ গাড়োয়ালকে ধরে আব্দুল আলীমের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল। বাড়ির চাতালে ৩/৪ দিন আটকে রাখার পর আব্দুল আলীমের নির্দেশে গাড়োয়ালদের খঞ্জনপুর কুঠিবাড়ি ব্রিজের কাছের বধ্যভূমিতে নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরে তাদের মরদেহ নদীতে ফেলে দেওয়া হয়।

৯ জনকে হত্যা
একাত্তরের মে মাসের প্রথম দিকে কোনো একদিন আক্কেলপুরে আব্দুস ছালাম, আব্দুল কুদ্দুস, সমির উদ্দিন মণ্ডল, আবুল হোসেন মাঝি, আজিম হোসেন মাঝি, আব্দুর রহমান মোক্তার, এবারত আলী মণ্ডল, আব্দুস ছাত্তার, ফজলুর রহমানসহ ১০ জনকে আটক করা হয়।

এরপর তাদেরকে পাকিস্তানি সেনাবহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয়।

পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাদের পাঁচবিবি থানার বাগজানা পুরনো রেলওয়ে স্টেশনের এক মাইল উত্তরের দিকে কোকতারা বকুলতলা নামক স্থানে নামিয়ে পুকুর পাড়ে খেঁজুর গাছের নিচে গুলি করে। গুলিতে ৯ জন শহীদ হন। গুলিবিদ্ধদের মধ্যে মোফাজ্জল প্রাণে বেঁচে যান। পাকিস্তানি সৈন্যরা চলে যাবার পর স্থানীয় লোকজন মৃতদের মাটিচাপা দিয়ে রাখেন।

দোগাছি হত্যাকাণ্ড
একাত্তরের ১২ মে জয়পুরহাট মহাকুমার দোগাছি, চকবরকত, নামুজানিধি, পাওনন্দা, ছিটপাওনন্দা, নওপাড়া, বিল্লা, রূপনারায়ণ, চরভারুলিয়া, জগদীশপুর, ভুটিয়াপাড়া, মল্লিকপুর পেচুয়াসহ আশপাশে গ্রামে হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়।

শহীদদের মধ্যে ছিলেন আব্দুল মোতালিব, শফির উদ্দিন, নয়া মিয়া মণ্ডল, বশির উদ্দিন মণ্ডল, মংলা ও ইয়াকুব আলী।

জানা গেছে, তাদেরকে আওয়ামী লীগের সমর্থক হিসেবে চিহ্নিত করে ১২ মে সকাল আনুমাণিক ১০টার সময় চতুর্দিক থেকে গ্রামগুলোতে সশস্ত্র হামলা চালায় আলীমের নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা। হামলাকালে প্রায় প্রত্যেক বাড়িতে প্রবেশ করে বাড়ির মালামাল লুটপাটের পর আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। গুলি করে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে আব্দুল মোতালেবসহ ওই ৬ জনকে হত্যা করা হয়।

নওদা গ্রামে ৪ জনকে হত্যা
একাত্তরের ২৬ মে সকাল ১১টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত নওদা গ্রামের ৪ জনকে অপহরণ ও আটক করে পরে হত্যা করা হয়। যাদেরকে অপহরণ করে হত্যা করা হয়েছে তাদের মধ্যে ছিলেন, ইলিয়াস উদ্দিন সরদার, ইউসুফ উদ্দিন সরদার, ইউনুস উদ্দিন সরদার ও আবুল কাদের মণ্ডল।

আব্দুল আলীমের পরামর্শে ও প্ররোচনায় ২৬ মে সকাল ১১টায় শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে জযপুরহাট মহাকুমার পাঁচবিবি থানার নওদা গ্রামে সশস্ত্র হামলা চালায়। হামলা চলাকালে ওই ৪ জনকে তাদের নিজ নিজ বাড়ি থেকে শান্তি কমিটির সভায় যোগ দেওয়ার মিথ্যা আশ্বাসে বালিঘাটা ইউনিয়ন পরিষদের একটি কক্ষে আটকে রাখা হয়।

তাদের আত্মীয়-স্বজনরা আব্দুল আলীমের কাছে এসে তাদেরকে ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য অনেক আকুতি-মিনতি করেন। কিন্তু আব্দুল আলীম তাতে কোনো কর্ণপাত করেননি। বরং তিনি বলেন, আটককৃতদের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি হিসেবে ইতোমধ্যে চিহ্নিত করে আটক করা হয়েছে। ওই দিনই সন্ধ্যায় কালী সাহার পুকুর পাড়ে নিয়ে তাদেরকে গুলি করে হত্যা করে মাটিচাপা দেওয়া হয়।

ক্ষেতলালে গণহত্যা
একাত্তরের মে মাসের শেষের দিকে কোনো একদিন সকালে ক্ষেতলাল থানার হিন্দুপল্লী উত্তর হাট শহর, হারুনজা হাটসহ বিভিন্ন স্থানে গণহত্যা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। আলীমের নির্দেশে সেদিন ১০ জনকে হত্যা করা হয়। তাদের মধ্যে ছিলেন, বাদল, সচীন ওরফে ভানু, প্রবাস চন্দ্র শীল, মনিভূষণ চক্রবর্তী, কার্তিক চন্দ্র বর্মণ, নিমাই চন্দ্র বর্মণ, প্রিয়নাথ বর্মণসহ অপরিচিত আরও ৩ জন।

জানা গেছে, রোজার ঈদের আগে ওই দিন আনুমানিক বিকেল ৩টায় মেজর আফজাল ও আলীম একটি জিপ গাড়িযোগে উত্তর হাট শহর হাটের পশ্চিম পাশে আসেন। সঙ্গে ছিল বহু পাকিস্তানি সেনা। ৫০০/৭০০ জনকে নিয়ে সেখানে মাইক লাগিয়ে জনসভার আয়োজন করা হয়। আব্দুল আলীম জনসভায় বলেন, আগামী ঈদে আমরা কলকাতা গড়ের মাঠে নামাজ পড়বো। সাধারণ মানুষের সাহস বৃদ্ধির জন্য হিন্দুদের ক্ষমা করা যাবে না। এদের যা পাও লুট করে নাও। হত্যার জন্য ওই ১০ জনকে ক্ষেতলাল সদরে নিয়ে যাওয়া হয়।

১১ যুবক হত্যা
একাত্তরের সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহের একদিন স্কুল চলাকালে দু’টি ট্রাকে করে মুখে কালি মাখানো ১১ যুবককে জয়পুরহাট মহাকুমার সদর রোডের মৃত আলহাজ আজিম উদ্দিন সরদারের বাড়ির সামনে নিয়ে আসা হয়। ট্রাক দু’টি পাকিস্তান দখলদার বাহিনী ঘিরে রাখে।

আটককৃতদের একজন পানি চাইলে মৃত আলহাজ আজিম উদ্দিন সরদারের স্কুলপড়ুয়া পুত্র সরদার আব্দুল হাফিজ মাটির বদনা দিয়ে টিউবওয়েল থেকে পানি এনে খাওয়ানোর চেষ্টা করলে সেখানে থাকা তার প্রতিবেশী আব্দুল আলীমের বডিগার্ড রাজাকার ফজলুর রহমান রাইফেলের বাঁট দিয়ে আঘাত করে বদনা ভেঙ্গে ফেলেন।
এরপর আটককৃতদেরসহ তাদের বহনকারী ট্রাক দু’টি নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকাররা ফাঁকা গুলি করতে করতে সরকারি ডিগ্রি কলেজে নিয়ে যায়। সেখানে মাঠের উত্তর-পূর্ব কোনায় বারঘাটি সংলগ্ন স্থানে দাঁড় করায়।

এর কিছুক্ষণের মধ্যে একটি জিপে চড়ে জয়পুরহাট মহকুমা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান, রাজাকার কমান্ডার আব্দুল আলীম সেখানে আসেন। তিনি জিপে দাঁড়িয়ে বলেন, ১১ আদমী ভারতকা চর হ্যায়। পাকিস্তানি দুশমন। মুক্তিফৌজ হ্যায়। ইসকো ভেজ দাও।

এই নির্দেশ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আনুমানিক বেলা ১১/১২টার দিকে মুখে কালি মাখানো ১১ যুবককে ট্রাক থেকে নামিয়ে বারঘাটি পুকুরের দক্ষিণ পাড়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গুলি করে হত্যা করে। শহীদদের ৬ জনের মরদেহ লিচু গাছতলায় ও ৫ জনের মরদেহ আম গাছতলায় গর্ত খুঁড়ে আব্দুল আলীমের নেতৃত্বাধীন রাজাকাররা মাটিচাপা দেন।

ফজলুসহ ৩ মুক্তিযোদ্ধা হত্যা
পাহাড়পুরে পাকিস্তানিদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে আহত হয়েছিলেন জয়পুরহাটের আক্কেলপুর সদরের মৃত আলহাজ আব্দুর রহিমের পুত্র মুক্তিযোদ্ধা ফজলুল করিম। একাত্তরের ৭ অক্টোবর মেজর আফজালের নেতৃত্বে শান্তি কমিটির লোকজন এবং রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা ফজলুসহ আরও ২ মুক্তিযোদ্ধাকে আটক করে ট্রাকে জয়পুরহাটের সিও (ডেভ) অফিসের সামনে হাজির হয়।

এ সংবাদ পেয়ে আব্দুল আলীম সিও অফিস থেকে বের হয়ে সেখানে আসেন। পরে আটককৃতদের মুখে চুনকালি লাগিয়ে আব্দুল আলীম ও মেজর আফজাল ট্রাকে উঠে নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালিদের ভয় দেখানোর উদ্দেশ্যে জয়পুরহাট শহর প্রদক্ষিণ করতে থাকেন।

প্রদক্ষিণকালে আব্দুল আলীম ও মেজর আফজালসহ মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেন। আলীম তার বক্তব্যে বলে, মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। ফজলুল করিমের বাবা আমার বন্ধু। তাকে তার ছেলেদের বিপথ থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য বারবার বলা সত্ত্বেও তাদের ফেরত আনেনি, বিরত করেনি। সুতরাং আজকে তার শাস্তি তাকে গ্রহণ করতে হবে। তার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। তার ছেলেকে জীবন দিতেই হবে। এখনও যারা আপনাদের বাড়ির আশপাশে জয় বাংলার কথা বলে তাদেরকে লাঠিপেটা করে মেরে ফেলেন।

শহর প্রদক্ষিণ শেষে ওই ৩ মুক্তিযোদ্ধাকে জয়পুরহাটের খঞ্জনপুর কুঠিবাড়ি ঘাটে নিয়ে নির্যাতনের পর গুলি করে হত্যা করা হয়। তাদের মরদেহও পাওয়া যায়নি।

চিনিকলে গণহত্যা
২৫ অক্টোবর সকাল থেকে ৯ দিন (শুক্রবার) পর্যন্ত জয়পুরহাট চিনিকলে আটকে রেখে ২৫ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। আটককৃত আরও ৪ জন আহত হন। আহতরা হলেন সোলেমান আলী ফকির, আব্দুল খালেক, আফতাব হোসেন, আব্দুস সামাদ।

অভিযোগে বলা হয়, একাত্তরের ২৫ অক্টোবর সকালে রাজাকার উমর আলী মণ্ডল পাঁচবিবি থানার সৈয়দ আলী ফকিরের বাড়িতে গিয়ে তার পুত্র সোলেমান আলী ফকিরকে বলেন যে, এলাকায় থাকতে হলে শান্তি কমিটির কাছ থেকে পরিচয়পত্র নিতে হবে। না নিলে এলাকায় ঘোরাফেরায় সমস্যা হবে।

এই একই কথা সোলেমান আলী ফকিরের অপর বন্ধু আব্দুস সামাদ মণ্ডলকেও বলেন উমর। তার কথায় বিশ্বাস স্থাপন করলে ওই ২ বন্ধুকে পাঁচবিবি বাজারে নিয়ে গিয়ে দু’জন পাকিস্তানি সেনার কাছে ধরিয়ে দেন তিনি। পাকিস্তানি সেনারা দু’জনকে প্রথমে তাদের পাঁচবিবি থানার পাশে সরকারি প্রাইমারি স্কুলে স্থাপিত পাকিস্তানি সেনাক্যাম্পে হস্তান্তর করে। সেখানে থেকে ওই দিনই পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাদের জয়পুরহাট চিনিকলে পাকিস্তানি সেনাক্যাম্পে জমা দেয়। তাদের সেখানে অফিসার্স কোয়ার্টারের একটি কক্ষে আটক রেখে আব্দুল আলীমের নির্দেশনা ও প্ররোচনায় তার নেতৃত্বাধীন ও পরিচালনাধীন শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীর সদস্য এবং পাকিস্তানি সেনারা নির্যাতন শুরু করে।
abdul-alim-old
নির্যাতনে তাদের শরীরের বিভিন্ন স্থান ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যায়। ওই কক্ষে আরও ২৭ জনকে আগে থেকেই আটকে রাখা হয়েছিল। তাদের মধ্যে দু’জন ছাড়া বাকিরা ছিলেন বানিয়াপাড়া মাধাইনগর এলাকার কোমর গ্রামের।

সেখান আব্দুস সামাদ মণ্ডল ও সোলেমান আলী ফকির ৯ দিন আটক থাকাকালে প্রতিদিন রাতের বেলা তাদেরকেসহ আটককৃত অন্যদের পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা নানাভাবে নির্যাতন অব্যাহত রাখে। প্রতিদিন জয়পুরহাট চিনিকলের ক্লাবঘরে বিচার বসিয়ে আলীম ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এক কর্নেল রায় দিতেন। সে রায়ের আলোকে প্রতি রাতে অনুমান ১০-১১টার দিকে কক্ষ থেকে ২-৩ জনকে বের করে ৮-১০ হাত দূরে চিনিকলের পাকুর গাছের নিচে প্রথমে বেয়নেট চার্জ ও পরে গুলি করে হত্যা করা হতো।

এভাবে ৮ রাতে ২৫ জনকে হত্যা করা হয়। আটকের পর ৯ম দিন শুক্রবার বেলা আনুমানিক ২টার দিকে চিনিকলের ক্লাবঘরে বিচার বসে। সেদিনও কর্নেলের পাশে বসা ছিলেন আব্দুল আলীম। ওই বিচারে সোলেমান আলী ফকির, আবদুল খালেক, আব্দুস সামাদ ও আফতাব হোসেনকে হাজির করা হয়।

আলীম এ সময় তারা কোন দল করেন, কতো তারিখে ভারতে গিয়েছিলেন, ভারতের কোথায় ছিলেন, মুক্তিবাহিনীর পোশাক অস্ত্র কোথায়, ভারতে কি করতেন ইত্যাদি জিজ্ঞেস করেন। আব্দুল আলীম উর্দুতে বলেন, তাদের ৪ জনকে ছেড়ে দিলে তারা ভারতে চলে যাবেন এবং সেখানে রিপোর্ট করলে ব্যাপক ক্ষতি হবে। তাই তাদের ছেড়ে দেওয়া যাবে না। কর্নেলের কাছে আলীমের উর্দুতে বলা এসব কথা আটককৃতরা বুঝতে পেরে কর্নেলকে অনুরোধ করে বলেন, আমরা কখনও ভারতে যাবো না। এক পর্যায়ে কর্নেল আলীমের কথা না শুনে তাদের ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন। সেখান থেকে ছাড়া পেয়ে বাড়িতে এসে গ্রামে থাকা নিরাপদ নয় ভেবে সোলেমান আলী ফকিরসহ আবদুস সামাদ মণ্ডল ভারতে চলে যান।

জব্বল হত্যা
নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে কোনো একদিন সকালে বীর মুক্তিযোদ্ধা জব্বল হোসেনকে অপহরণ করা হয়। এরপর তাকে আটকে রেখে হত্যা করা হয়।

অভিযোগে বলা হয়, জয়পুরহাটের পাঁচবিবি থানার ধুরইল গ্রামের নাজিম উদ্দিনের বাড়িতে চট্টগ্রামের কালুরঘাটের ১৭ উইংয়ের ইপিআর সুবেদার মেজর জব্বল হোসেন গুরুতর জখমপ্রাপ্ত অবস্থায় আশ্রয় নেন। খবর পেয়ে রাজাকাররা তার বাড়ি ঘেরাও করে জব্বলকে অপহরণ করেন।

জব্বল হোসেনের জামাতা গোলাম রসুলসহ আরও অনেকে শান্তি কমিটির অফিসে গিয়ে আব্দুল আলীমের কাছে অনুরোধ করেন, জব্বলকে ছেড়ে দিতে। তখন আলীম জানান, যেহেতু জব্বল চট্টগ্রাম গিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করেছে, তাকে ছাড়া যাবে না।

পরবর্তীতে আবারও জব্বলকে ছেড়ে দিতে আলীমের কাছে বারবার একই অনুরোধ জানান স্বজনেরা। শেষ পর্যায়ে জব্বল হোসেনের আত্মীয়-স্বজনরা জানতে পারেন যে, আব্দুল আলীমের নির্দেশে তাকে হত্যা করা হয়েছে।

ডা. আবুল কাশেম হত্যা
একাত্তরের ২৪ জুলাই গভীর রাতে আব্দুল আলীমের নির্দেশে জয়পুরহাট শহরের নিজ বাড়ি থেকে আওয়ামী লীগ নেতা ডা. আবুল কাশেমকে পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকাররা অপহরণ করে নিয়ে যায়। সে রাতে তারা জয়পুরহাট স্টেশনে আবুল কাশেমের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে পরদিন সকাল ৮টায় তাকে শাওনলাল বাজলার গদিঘরে শান্তি কমিটির অফিসে আব্দুল আলীমের কাছে নিয়ে যায়।

কাশেমের পুত্র ডা. নজরুল ইসলাম ও মেয়ে লাইলী বেগম আলীমের কাছে গিয়ে পিতাকে ছেড়ে দেবার জন্য অনেক আকুতি মিনতি করেন। রাজাকার আতিকুল্লাহ তার মেয়েকে জানান, আলীম হুকুম দিয়েছেন, তাকে মেরে ফেলতে।

আবুল কাশেমকে পরে আব্দুল আলীমের নির্দেশে জয়পুরহাট থানা ও পরে খঞ্জনপুরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ক্যাম্পে একদিন এক রাত আটক রাখার পর ২৬ জুলাই সন্ধ্যায় আব্দুল আলীমের নির্দেশে খঞ্জনপুর কুঠিবাড়ি ঘাটে নিয়ে ডা. আবুল কাশেমকে হত্যা করা হয়। এক মাস পর আখ ক্ষেতে শহীদ ডা. আবুল কাশেমের অর্ধগলিত মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল।

খলিলুর রহমান আটক ও নির্যাতন
আগস্ট মাসের প্রথম দিকে জয়পুরহাট মহকুমার শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ও রাজাকার বাহিনীর কমান্ডার আব্দুল আলীম রাজনৈতিক বিদ্বেষপ্রসূত হয়ে হুরমত আলী মণ্ডলের (মৃত) ভাই আব্দুল মণ্ডলকে তার ভাইপো খলিলুর রহমানকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য বলেন। না হলে পুরো গ্রাম আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হবে বলে হুমকি দেন আলীম।

এ হুমকির কারণে খলিলুর রহমান তার খালার বড়িতে পালিয়ে যান। শান্তি কমিটি ও রাজাকাররা আব্দুল আলীমের নির্দেশে তাকে খুঁজতে থাকেন। খোঁজাখুঁজির মধ্যে আগস্ট মাসের প্রথম দিকে যেকোনো একদিন অত্যন্ত সতকর্তার সঙ্গে বাড়িতে এসে অবস্থান করাকালে ফজরের নামাজের সময় শান্তি কমিটি ও রাজাকাররা পাকিস্তানি সৈন্যদের নিয়ে ওই বাড়ি ঘেরাও করে খলিলুর রহমানকে আটক করে।

সেখান থেকে তারা খলিলুর রহমানকে উড়িরপুর পাকিস্তানি সেনাক্যাম্পে নিয়ে আসে। আলীমের নির্দেশে তার বাম হাতে ও ডান পায়ে নির্যাতন চালায়। খলিলুর রহমান নির্যাতনে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। অজ্ঞান হওয়ার পর দীর্ঘসময় পর্যন্ত জ্ঞান না ফিরে আসলে খলিলুর রহমান মারা গেছেন মনে করে আলীমের দুষ্কর্মের লোকজন তাকে ফেলে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। পরে গ্রামের লোকজন তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন।

পশ্চিম আমাত্রা গ্রামে গণহত্যা
একাত্তরের ১৪ জুন বগুড়ার খোকন পাইকারসহ ১৫ জন যুবক জয়পুরহাটের আক্কেলপুর হয়ে বুড়ায় যাওয়ার পথে আব্দুল আলীমের নেতৃত্বাধীন ও পরিচালনাধীন স্থানীয় শান্তি কমিটির লোকজন ‘মুক্তি বাহিনী’ হিসেবে সন্দেহ করে ধরে শাওনলালের গদিঘরে অবস্থিত শান্তি কমিটির অফিসে নিয়ে আটকে রাখে।

আটককৃতদের ব্যাপারে জয়পুরহাট মহকুমা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ও রাজাকার বাহিনীর কমান্ডার আব্দুল আলীমকে স্থানীয় শান্তি কমিটির লোকজন খবর দিলে তিনি সেখানে এসে নিকটবর্তী আক্কেলপুর সিনিয়র মাদ্রাসায় অবস্থিত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে যান। আলীম সেখানে অবস্থানরত আফজাল বেগের সঙ্গে শলা-পরামর্শ করেন। শলা-পরামর্শ করে তিনি আটককৃতদের নির্যাতনপূর্বক হত্যার সিদ্ধান্ত নেন।

ওই সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে আক্কেলপুরের পশ্চিম আমাত্রা গ্রামে নিয়ে আটককৃতদের হাত-পা বেঁধে নির্যাতন চালানো হয়। নির্যাতন চলাকালে পশ্চিম আমট্র গ্রামের মৃত ময়েন তালুকদারের পুত্রকে তাদের বাড়ি থেকে সেখানে ধরে এনে তাদের দিয়ে গর্ত খোঁড়ান আলীম। এরপর আটককৃতদের হাত-পা বেঁধে ১৫ জনকে হত্যা করেন। এরপর তাদের মরদেহ মোঃ দুলু তালুকদার ও রমজানকে দিয়ে গর্তে ফেলে গণকবর দেওয়া হয়।

বকুলতলা গণহত্যা
মে মাসের প্রথম দিকে রাজাকার কমান্ডার আব্দুল আলীম পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে একটি ট্রেনে চড়ে বকুলতলা রেললাইনের কাছে আসেন। ট্রেন থেকে নেমে তারা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে কোকতারা, ঘোড়াপা, বাগজানা, কুটাহারা গ্রামে হানা দিয়ে সেখানে বাড়িঘরে লুটপাট চালায় এবং লুটের পর বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়।

সেখানে যাদেরকে গুলি করে হত্যা করা হয় তাদের মধ্যে ছিলেন বাহার উদ্দিন, সুকচান, হযরত উল্লাহ, আসাদ আলী, বিশারত উল্লাহ, নাছির উদ্দিন, আয়েজ উদ্দিন, ভাদু আকন্দ, ঘোড়াপা গ্রামের হযরত আলী, আবারী, হুজুর আলী এবং বাগজানা গ্রামের লোজাপ, জফি, আলিফ, রোজা খলিফা, মান্নান খলিফা, আদু খলিফা, নাছির খলিফা ও নেপাল খলিফা।

পাহুনন্দা গণহত্যা
একাত্তরের বৈশাখ মাসের শেষ দিকে কোনো একদিন জয়পুরহাটের দক্ষিণ পাহুনন্দা মিশন স্কুলে আসামি আব্দুল আলীমের নির্দেশে ও প্ররোচনায় ৬৭ জন হিন্দুকে হত্যা করা হয়। রাজাকার বাহিনীর লোকজন ও পাকিস্তানি সেনারা পায়ে হেঁটে ও গাড়িতে করে মিশন স্কুলে আসে। এদের মধ্যে ৫০/৬০ জনের একটি গ্রুপ মিশন স্কুলে যায়।

বাকিরা পাগলা দেওয়ানের দিকে চলে যায়। স্কুলে যাওয়ার পর স্থানীয় গ্রামবাসী ফজলুর রহমান, হামিদ দেওয়ান, গনি, মোঃ ফজলুর রহমান, লুৎফর রহমানসহ আরও অনেককে নিজ নিজ বাড়ি থেকে ডেকে মিশন স্কুলে নিয়ে আসে। পাকিস্তানি সেনারা তাদের দিয়ে স্কুলের পশ্চিম পাশে বাঙ্কার খোঁড়ার কাজ করিয়ে নেয়। বাঙ্কার খোঁড়ার পরে ৬৭ অপরিচিত হিন্দুর লাশ মাটি চাপা দিতে বাধ্য করে।

ময়েন তালুকদারে বাড়িতে হামলা
একাত্তরের মে মাস থেকে ১৩ জুনের মধ্যে যে কোনোদিন জয়পুরহাট মহাকুমার আক্কেলপুর থানার পশ্চিম আম্র গ্রামের ময়েন তালুকদারের বাড়িতে হামলা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও বসত-ভিটেচ্যূত করা হয়।

আব্দুল আলীম রাজনৈতিক বিদ্বেষপ্রসূত হয়ে ময়েন তালুকদার বাড়িতে হামলা করবেন বলে ঘোষণা দেন। এ ঘোষণার ভয়ে ভীত হয়ে ময়েন তালুকদারের পুত্র দুলু তালুকদারসহ পরিবারের সকল সদস্য বাড়ি ছেড়ে গোপীনাথপুর গ্রামে ময়েনের বোনের বাড়িতে আশ্রয় নেন। শুধু ময়েন তালুকদার ওই বাড়িতে অবস্থান করেন। এক সময়ে আলীম লোকজনসহ তার বাড়িতে হামলা চালিয়ে লুপাট করে আগুন ধরিয়ে দেন।
A-alim-bg
ধর্ষণ
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সৈন্য ও রাজাকাররা নিরীহ মা-বোনদের ওপর যে পাশবিক নির্যাতন করেছে সে সম্পর্কে আব্দুল আলীমের বক্তব্য ছিল, যুদ্ধের সময় সেনাবাহিনী এমন ঘটনা ঘটায়ই। এটা কোনো দোষের বিষয় নয়, দেশের স্বার্থে এটা মেনে নিতে হবে।

একাত্তরের ১৮ জুন রাতে দক্ষিণ খাস পাহুনন্দা মিশন স্কুলে কয়েকজন বাঙালি তরুণীকে ১৫ দিন আটকে রেখে ধর্ষণ করা হয়।

১৮ জুন ১৫০ থেকে ২০০ জনের একদল পাকিস্তানি সৈন্য মিশন স্কুলে আসে। সেখানে দুই থেকে আড়াই শ’ জন নিরীহ মানুষকে আটক করে। এর মধ্যে ১৫০ জনকে গুলি করে সেই রাতেই হত্যা করে তাদের লাশ গর্ত করে পুঁতে রাখা হয়। বাকিদের পরদিন ছেড়ে দেওয়া হয়। কয়েকজন বাঙালি তরুণীকে ১৫ দিন আটকে রেখে সেখানে ধর্ষণ করা হয়।

জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে সকাল ১০টা থেকে দুপুর পর্যন্ত আরও তিন নারীকে ধর্ষণ করা হয়। তারা হলেন মোসাম্মৎ সাফিয়া, হাফিজা খাতুন ও আম্বিয়া বেওয়া।

অভিযোগপত্র থেকে জানা গেছে, ১৯৭১ সালের জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহের একদিন সকাল অনুমান ১০টার সময় জয়পুরহাট মহাকুমার পাঁচবিবি থানার পূর্ব রামচন্দ্রপুরের মতিয়ার রহমান, হেছাব উদ্দিন ও আইযুব উদ্দিনের বাড়িতে জয়পুরহাট মহকুমা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ও রাজাকার কমান্ডার আব্দুল আলীমের প্ররোচনায় ও পরামর্শে তার নেতৃত্বাধীন শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীর লোকজন পাকিস্তান হানাদার বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে হামলা চালায়।

হামলার সময় শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীর লোকজনের সহযোগিতায় দখলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্যরা ওই বাড়িগুলোতে অবস্থানকারী মহিলাদের ধর্ষণ করে।

আলীমের নির্দেশে বিভিন্ন সময়ে আরও তরুণী মেয়েদের ধরে এনে স্থানীয় শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী পাকিস্তান সেনবাহিনীর কাছে পৌঁছে দেয়।

মেহের উদ্দিনকে দেশান্তরকরণ
একাত্তরের ২০ এপ্রিল বিকেল আনুমানিক ৫টার দিকে আলীমের নেতৃত্বে পাঁচবিবি থানার দমদমা গ্রামের মেহেরউদ্দিন চৌধুরীর (বর্তমানে মৃত) বাড়িতে হামলা চালায় পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা। এ বাড়ির সমস্ত মালামাল লুটপাট করে বাড়িটি আগুনে ধ্বংস করে দেয় তারা। আসামি আব্দুল আলীমের ভয়ে মেহের উদ্দিন চৌধুরীর বাড়ির সবাই ভয়ে দেশ ত্যাগে বাধ্য হন।

৩০০ জনকে আটক করে নির্যাতন
একাত্তরের জুলাই মাসের মাঝামাঝি একদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত খাস পাহুনন্দা, খামারপাড়া, মিশনপাড়া, ভাদকোটা, দোগাছি, ফুলুপাড়া, দীঘিরপাড়, তালতলা ও পুকুরপাড় গ্রামে হামলা চালিয়ে নিরীহ মানুষকে আটক করে রাজাকার বাহিনী। এরপর তাদের নির্মমভাবে প্রহার করা হয়। এতে আমেদ আলী, মনির উদ্দিন, আবুল হোসেন, গনিসহ আনুমানিক ৩০০ জনকে আটক করে নির্মমভাবে নির্যাতন চালানো হয়।

অভিযোগে প্রকাশ, রাজাকার বাহিনী খাস পাহুনন্দা ও এর আশপাশের গ্রামে একযোগে হামলা চালায়। তারা পাহুনন্দা গ্রামের আবুল হোসেনের দুই বড় ভাই আমেদ আলী ও মনির উদ্দিন, খামারপাড়ার আবুল হোসেন, মিশনপাড়ার গনিসহ ভাদকোট, দোগাছি, ফুলুপাড়া, দীঘিরপাড়া, তালতলী পুকুরপাড় গ্রামের আনুমাণিক ৩০০ জনকে বিভিন্ন স্থান থেকে ধরে এনে খাস পাহুনন্দা মিশন স্কুলের উত্তর পাশে জলা জমিতে লাইন করে বসিয়ে রেখে ইচ্ছে মতো মারধর করে এবং বাঁশডলা দেয়।

এর পরদিন খাস পাহুনন্দা গ্রামের ৬০০/৭০০ জন লোক স্থানীয় চকভারুনিয়া মাদ্রাসায় জড়ো হয়ে বলেন যে, মারলে সবাইকে একসঙ্গে মারতে হবে। এ সময় আব্দুল আলীম পকিস্তানি সেনা কমান্ডার মেজর আফজালকে নিয়ে একটি জিপে করে সেখানে আসেন। আলীমের নির্দেশে সেখানে উপস্থিত পাকিস্তানি সেনা এবং শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা মাদ্রাসায় জড়ো হওয়া লোকজনদের পীর সাহেব মোঃ কোরবান আলীর খানকা শরিফে নিয়ে মাদ্রাসার মাঠে লাইন করে দাঁড় করায়। এ কথা শুনে পীর সাহেব বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে লাইনের সামনে দাঁড়িয়ে মেজর আফজাল ও আলীমকে বলেন যে, এ সমস্ত লোক ভারতে চলে যেতেন। আমার কথামতো তারা একসঙ্গে এখানে জড়ো হয়েছেন। যদি এদের মারেন তাহলে আগে আমাকে গুলি করেন। পীর সাহেবের কথা মতো আটককৃত ও জড়ো হওয়া সকল গ্রামবাসীকে ছেড়ে দেওয়া হয়। পরে আলীম সেনা কমান্ডার মেজর আফজালকে নিয়ে চলে যায়।

ফজলুর রহমান অপহরণ-নির্যাতন
একাত্তরের জুলাই মাসের তৃতীয় সপ্তাহে যেকোনো একদিন দুপুরে জয়পুরহাটের দক্ষিণ খাস পাহুনন্দা গ্রামের আবুল হোসেনের পুত্র ফজলুর রহমানকে অপহরণ করা হয়। এরপর তাকে আটক করে তার ওপর নির্যাতন করা হয়।

অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে জয়পুরহাটের দক্ষিণ খাস পাহুনন্দা ও এর আশপাশের গ্রামে হামলা, নিরীহ লোকজনদের অপহরণ, আটক ও নির্যাতনের ঘটনার এক সপ্তাহ পর কোনো একদিন দুপুরে আলীমের লোকজন তার নির্দেশ ও প্ররোচনায় দক্ষিণ খাস পাহুনন্দা গ্রামের আবুল হোসেনের পুত্র ফজলুর রহমানকে পুনরায় ধরে আনে।

তাকে ধরে এনে প্রথমে মিশন স্কুল ক্যাম্প ও পরে পাগলা দেওয়ান ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে নিয়ে গিয়ে তাকে আমগাছের সঙ্গে বেঁধে নির্যাতন করা হয়। পরে কৌশলে বাঁধন খুলে তিনি পালিয়ে আত্মরক্ষা করেন।

আজিজারকে নির্যাতন
এছাড়া আব্দুল আলীমের নির্দেশে শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা ক্ষেতলাল থানা আওয়ামী লীগের নেতা আলতাফ হোসেন সরদারের পুত্র আজিজার রহমান সরদারকে অপহরণ ও নির্যাতন করে। আজিজারকে তার বাড়ি থেকে আটক করে ক্ষেতলাল থানায় নিয়ে সেখানে তার ওপর পাশবিক নির্যাতন চালানো হয়।

প্ররোচণামূলক বক্তব্য
একাত্তরের মুত্তিযুদ্ধের সময় আব্দুল আলীম বিভিন্ন স্থানে প্ররোচনামূলক বক্তব্য দিয়ে মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডকে উস্কে দেন। এসব প্ররোচণামূলক বক্তব্য দিয়ে তিনিও মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন।

১৯৭১ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে বগুড়ার আলতাফুন্নেছা ময়দানে অনুষ্ঠিত এক সমাবেশে তৎকালীন বগুড়া জেলা প্রশাসক, মুসলিম লীগ নেতা মওলানা সেকেন্দার আলী, জামায়াতের নেতা এএলএম আবদুর রহমান ফকির প্রমুখের সঙ্গে বগুড়া জেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল আলীম উপস্থিত ছিলেন।

তখন সমাবেশে তিনি অন্যদের সঙ্গে একই সুরে বলেন যে, মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসভূমি হিসেবে পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়েছে। এহেন পাকিস্তানের ধ্বংস করার চক্রান্তের জন্য তিনি ভারতীয় শাসকদের তীব্র সমালোচনা করেন এবং ভারতীয় আগ্রাসন থেকে দেশকে রক্ষা করার নিমিত্তে সেনাবাহিনীর পেছনে ঐক্যবদ্ধ থাকার জন্য উপস্থিত শ্রোতাদের প্রতি আহ্বান জানান।

আলীম মুক্তিযোদ্ধাদের ‘দুষ্কৃতকারী’ উল্লেখ করে তাদের কার্যকলাপেরও তীব্র সমালোচনা করেন। তাদের রাষ্ট্রবিরোধী হীন কার্যকলাপ সম্পর্কে জনগণকে সচেতন থাকতে অনুরোধ করেন। তিনি দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে সময়মতো পদক্ষেপ নিয়ে ধ্বংসের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে অভিনন্দন জানান।

আব্দুল আলীম একাত্তরের মে মাসের মাঝামাঝি এক সকালে জয়পুরহাট রেলস্টেশনের প্ল্যাটফরমের উত্তর দিকে প্ররোচণামূলক ভাষণ দেন। বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষকদের ডেকে তিনি বলেন যে, দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসছে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ট্রেনযোগে টহল দিচ্ছে। কাজেই আমাদের এলাকার স্কুলগুলো খুলে দিতে হবে।

স্কুলের সকল ছাত্র-ছাত্রীর সঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর আফজাল এবং জয়পুরহাট শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান আব্দুল আলীম কথা বলতে ইচ্ছে প্রকাশ করছেন বলেও জানান তিনি। এ সময় আলীম বলেন, মুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীনতা যুদ্ধ করছেন ভারতের উস্কানিতে। আওয়ামী লীগ ও হিন্দু সম্প্রদায়ের কিছু লোকজন ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে ডিসটার্ব করছে।

এছাড়া বিভিন্ন সময়ে জামালগঞ্জ এবং আক্কেলপুর সোলায়মান আলী কবিরাজের মিল প্রাঙ্গণ, আক্কেলপুর রেলওয়ে স্টেশন, আক্কেলপুর মাদ্রাসায় প্রতিষ্ঠিত সেনাক্যাম্প, শান্তি কমিটি অফিস, দুর্গাবাবুর দালানঘরে প্ররোচণামূলক বক্তব্য রাখেন আব্দুল আলীম। রাজাকারদের সঙ্গে সভা করে পাকিস্তানের অখণ্ডতাকে রক্ষার নামে বক্তব্য রেখে গণহত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের হুকুম দেন।

খাঁচায় পুরে প্রদর্শনী!    
জয়পুরহাট মুক্ত হবার পর এখানে আব্দুল আলীমকে খাঁচায় পুরে জনসাধারণের দেখার জন্য রেখে দেওয়া হয়েছিল।

জানা গেছে, ৫ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা জয়পুরহাটে ঢুকেছিলেন। সেদিনই শান্তি কমিটির কার্যালয় দখল করে তারা স্থানীয় বুদ্ধিজীবী হত্যার তালিকাসহ অন্য কাগজপত্র পান। তার মধ্যে আগেরদিন ৪ ডিসেম্বর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রী জামায়াত নেতা আব্বাস আলী খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত শান্তি কমিটির সভার কাগজপত্রে আব্দুল আলীমের স্বাক্ষর ছিল।

মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে জয়পুরহাট থানায় দালাল আইনে আব্দুল আলীমসহ দালালদের বিরুদ্ধে ২৩টি মামলা দায়ের করা হয়। ওই সময় থানার দারোগা ফনীভূষণ বাদী হয়ে আলীমের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন (মামলা নং- ১/৭২)। সে মামলার তদন্ত শেষে তার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। মামলাটি বিচারের জন্য তখন বগুড়া সেশন জজ আদালতে প্রেরণ করা হয়, যা বিচারাধীন ছিল। দীর্ঘদিন পলাতক থাকার পর ১৯৭২ সালের শেষ দিকে জয়পুরহাট আদালতে আত্মসমর্পণ করলে আদালত তাকে বগুড়া জেলহাজতে প্রেরণ করেন। থানা রেখে তাকে লোহার খাঁচায় পুরে জনগণের দেখার জন্য প্রদর্শনীও করা হয়।

ঘাতক যখন মন্ত্রী!
পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জেল থেকে ছাড়া পেয়ে যান আব্দুল আলীম। ১৯৭৫ সালে জয়পুরহাট পৌরসভার প্রথম চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৭৭ সালেও জয়পুরহাট পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন আলীম। ১৯৭৯ সালে তিনি বিএনপিতে যোগ দেন। সে বছরই তৎকালীন জিয়া সরকারের প্রথমে বস্ত্র ও পরে যোগাযোগ মন্ত্রী হন। ১৯৮৪ সালে এরশাদ সরকারের সময় উপজেলা চেয়ারম্যান, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে খালেদা সরকারের সময় এমপি নির্বাচিত হন। এক সময় ছিলেন জয়পুরহাট আইনজীবী সমিতিরও সভাপতি।

গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তিনি বিএনপিতে সংস্কারপন্থী হিসাবে নিজেকে প্রকাশ করেন। ফলে ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন বঞ্চিত ও বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত হন।

গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম যে ৫০ জন যুদ্ধাপরাধীর তালিকা প্রকাশ করে, সে তালিকায় ১৩নং স্থানে ছিলেন জয়পুরহাটের আব্দুল আলীম। বর্তমান মহাজোট সরকারের সময় যেসব রাজনীতিক ও বিভিন্ন পেশাজীবীর দেশত্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল সে তালিকায়ও আব্দুল আলীমের নাম ছিল। এছাড়া ইতিপূর্বে তার লাল পাসপোর্টে পুত্র পরিচয়ে আয়ারল্যান্ডে মানুষ পাচারের সময় ভারতের বিমানবন্দরে তার পাসপোর্ট আটক করা হয়েছিল। সে সময় এমপি থাকার কারণে নোট ভারবাল কেসের রায় পরে আর জানা যায়নি। ভারতে লাল পাসপোর্ট আটকের খবর প্রকাশের পর তিনি ঢাকার থানায় পাসপোর্ট হারানোর লোক দেখানো মামলা দায়ের করেন। এ ঘটনায় তার পুত্র জড়িত থাকলেও তিনি এমপি থাকায় তা ধামাচাপা পড়ে যায়।

বাংলাদেশ সময়: ১৪১০ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৯, ২০১৩
এএসআর/এডিবি/জেএম


সম্পাদক : জুয়েল মাজহার

ফোন: +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২১৮১, +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২১৮২ আই.পি. ফোন: +৮৮০ ৯৬১ ২১২ ৩১৩১ নিউজ রুম মোবাইল: +৮৮০ ১৭২ ৯০৭ ৬৯৯৬, +৮৮০ ১৭২ ৯০৭ ৬৯৯৯ ফ্যাক্স: +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২৩৪৬
ইমেইল: [email protected] সম্পাদক ইমেইল: [email protected]
Marketing Department: +880 961 212 3131 Extension: 3039 E-mail: [email protected]

কপিরাইট © 2006-2024 banglanews24.com | একটি ইস্ট-ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের (ইডব্লিউএমজিএল) প্রতিষ্ঠান