ঢাকা, শনিবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

রাজনীতি

১২ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে নিজামী-মুজাহিদকে জঙ্গিদের মুখোমুখি করা হচ্ছে

সাঈদুর রহমান রিমন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৪৭ ঘণ্টা, জুলাই ১৩, ২০১০
১২ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে নিজামী-মুজাহিদকে জঙ্গিদের মুখোমুখি করা হচ্ছে

ঢাকা: গুরুত্বপূর্ণ ১২ টি প্রশ্নের জবাব পেতে জামায়াতের তিন শীর্ষ নেতা ও জঙ্গি সংগঠন জেএমবি ও হিযবুত তাহরীরের চার নেতাকে মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদ করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা, সিআইডি ও ডিবির উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে ‘ট্রাস্ক ফোর্স ইন্টেরোগেশন’ (টিএফআই) সেলে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মহাপুলিশ পরিদর্শকের অনুমতি চাওয়া হয়েছে।

সিআইডি’র ডিআইজি মোঃ সাইফুল আলমের তত্ত্বাবধানে টানা দু’দিনের বেশি জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন গোয়েন্দারা।

পুলিশ সদর দপ্তরের জঙ্গি বিষয়ক কার্যক্রম তদারককারী অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জান্নাতুল হাসান বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম.বিডি’কে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। এই কর্মকর্তা আরও জানান, টিএফআই সেলে জঙ্গিদের ধারাবাহিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এরই মধ্যে জিজ্ঞাসাবাদের একটি  রুটিনও তৈরি করা হয়েছে।
যাদের টিএফআই সেলে জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন বলে মনে করা হচ্ছে তারা হচ্ছেন,  মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, দেলওয়ার হোসাইন সাঈদী (তিনজনই রিমান্ডে আছেন), হরকাতুল জেহাদ বাংলাদেশ (হুজি) নেতা মুফতি হান্নান (কারাগারে বন্দি), জেএমবি আমীর সাইদুর রহমান (রিমান্ড মঞ্জুর হয়ে আছে), হিযবুত তাহরীর নেতা অধ্যাপক মহিউদ্দিন আহমেদ ও অধ্যাপক ড. সৈয়দ গোলাম মাওলা (কারাগারে বন্দি)। তাদের সঙ্গে আহলে হাদীস আন্দোলনের প্রধান নেতা অধ্যাপক আসাদুল্লাহ আল গালীবকেও জামায়াত নেতাদের মুখোমুখি করা হবে।  

চারদলীয় জোট সরকারের সময় জঙ্গিদের বিভিন্ন দল ও উপদলের ৩ শতাধিক নেতাকে  গ্রেপ্তার করা হয়। তখন গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে তারা কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেন। এসব সংগঠন নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ ও সমন্বয় রেখে কাজ করেছে। কিন্তু ওই সময় বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল পুলিশি অনুসন্ধানের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এসবের মধ্যে ছিল ক্ষমতাসীন দলের বাধা ও নানা অসহযোগিতা।   এসব কারণে পারস্পারিক সম্পর্কযুক্ত জঙ্গি নেতাদের একত্র করে অমিমাংসিত প্রশ্নগুলোর জবাব খুঁজে বের করা যায়নি। এ বক্তব্য টিএফআই সেলের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তার।

তিন মাস আগেও বেশ কয়েকজন জঙ্গি নেতা গ্রেফতার এড়িয়ে গোপন আস্তানায় অবস্থান করছিলেন। কেউ কেউ আত্মগোপন করে ছিলেন দেশের বাইরে। বিশেষ করে জেএমবির বর্তমান আমীর সাইদুর রহমানকে খুঁজে পাওয়াটা ছিল গোয়েন্দাদের কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। শেষমেষ তিনিও ধরা পড়লেন।

১। পৃথক পৃথক জিজ্ঞাসাবাদে জঙ্গি নেতারা গোয়েন্দাদের জানান, ১৭ আগস্ট দেশব্যাপী একযোগে বোমা হামলা-নাশকতায় জেএমবি, হুজি, শাহাদাত-ই-আল হিকমা, হিযবুত তাহ্রীরসহ নিষিদ্ধ ঘোষিত সমমনা পাঁচটি জঙ্গি সংগঠন সরাসরি জড়িত ছিল। এর নেপথ্যে ছিল জামায়াতে ইসলামীর মদদ ও সহযোগিতা। নিজেদের শক্তি পরীক্ষা ও সমন্বিত হামলা পরিচালনার সামর্থ্য প্রমাণ করতেই পরিকল্পিতভাবে তারা অপারেশন চালিয়েছিল।

২। বর্তমান সরকার রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসার পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে তৎপর হওয়ায় প্রধান যুদ্ধাপরাধীরা সতর্ক হয়ে ওঠেন। তারা নানাভাবে যুদ্ধাপরাধ মামলা ভণ্ডুল করে দিতে কয়েকটি জঙ্গি সংগঠনের মধ্যে পারস্পারিক যোগসূত্র স্থাপন করেন। পাশাপাশি জঙ্গিদের দিয়ে তারা দেশজুড়ে হামলা ও নাশকতার ঘটনা ঘটাতে চেয়েছিলেন। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে জামায়াতে ইসলামীর বিভিন্ন নেতা অর্থেরও যোগান দিয়েছিলেন বলে জঙ্গি নেতা সাইদুর রহমান, হিযবুত তাহরীরের অধ্যাপক মহিউদ্দিন খান ও ড. সৈয়দ গোলাম মাওলা গোয়েন্দাদের কাছে স্বীকার করেছেন। এদরকে জামায়াত  নেতাদের সামনা-সামনি করে এ বক্তব্য কতটুকু সত্য তা যাচাই করবেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা।

৩। সম্প্রতি জঙ্গি সংগঠনগুলোর তৎপরতা বাড়াতে রাজধানীর শহীদবাগ এলাকার একটি বাড়িতে গোপন বৈঠক হয়। সেখানে ড. গোলাম মওলা, সাইদুর রহমান, শেখ মহিউদ্দিন এবং জামায়াত নেতা  দেলওয়ার হোসাইন সাঈদী, আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদসহ গুরুত্বপূর্ণ ১০/১২ জন নেতা উপস্থিত ছিলেন। ইসলামী ঐক্যজোটেরও একাধিক নেতা ওই বৈঠকে অংশ নেন বলে গোয়েন্দারা জানতে পারেন। তারা যুদ্ধাপরাধ মামলা ভণ্ডুল করতে কি প্রয়োজনে সরকার উৎখাতের পরিকল্পনা নিয়েছিলেন ? জঙ্গি ও জামায়াত নেতাদের মুখোমুখি করে সে প্রশ্নের ও জবাব খোঁজা হবে।

৪। গোয়েন্দারা নিশ্চিত হতে চান যে, জামায়াত কি দলীয়ভাবে, নাকি দলটির নেতাদের কেউ কেউ ব্যক্তিগতভাবে জঙ্গি নাশকতার সঙ্গে জড়িত?   

৫। দেশের কয়েকটি সীমান্ত এলাকায় নানাভাবে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত অস্ত্রবাজদের সাথে উগ্রপন্থী মৌলবাদী ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের চরমপন্থীদের গোপন আঁতাত গড়ে  উঠেছে বলেও তথ্য-প্রমাণ পেয়েছেন গোয়েন্দারা। এসব গ্রুপের আদর্শ-নীতি ও উদ্দেশ্যের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান থাকলেও অস্ত্রশস্ত্র লেনদেন ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ড পরিচালনার ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে পারস্পারিক সহায়তা রয়েছে।

অস্ত্রশস্ত্র লেনদেনের সম্পর্ক এবং এ যাবত তাদের নেটওয়ার্ক দিয়ে কি পরিমাণ অস্ত্র দেশের অভ্যন্তরে ঢুকেছে সেটা জানার পাশাপাশি বিপুল সংখ্যক অস্ত্র ও গ্রেনেডের অবস্থানও নিশ্চিত করতে চান গোয়েন্দারা।

৬। মতিউর রহমান নিজামী চারদলীয় জোট সরকারে শিল্পমন্ত্রী থাকার সময় বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক বোমা বানানোর কাজে বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের হাতে তুলে দেন বলে অভিযোগ আছে। সম্প্রতি দুজন  জঙ্গি নেতা জিজ্ঞাসাবাদে গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের একথা জানিয়েছেন। এ নিয়ে জঙ্গি নেতা সাইদুরও মহিউদ্দিনকে নিজামীর  মুখোমুখি করা হবে টিএফআই সেলে।

৭। বহির্বিশ্ব থেকে বিভিন্ন সংস্থার নামে অর্থ সহায়তা এনে তা জঙ্গি কার্যক্রমে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে নিশ্চিত হয়েছেন গোয়েন্দারা। বিভিন্ন উন্নয়নও  সহায়তামূলক এবং  ধর্মীয় কার্যক্রম পরিচালনার কাজে নিয়োজিত ৭৮টি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এই ৭ নেতার সম্পর্ক  খতিয়ে দেখা হবে।

এসব সংগঠনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, আদর্শ শিক্ষা পরিষদ, আল ফারুক সোসাইটি, আল ইনসান ফাউন্ডেশন, আল আমিন ট্রাস্ট, আল মুদারাবা ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি, মসজিদ সোসাইটি, আল ইসলাহ ট্রাস্ট, ইনস্টিটিউট অব হায়ার ইসলামিক লার্নিং, রিলিফ অর্গানাইজেশন, ফয়সাল ইনভেস্টমেন্ট ফাউন্ডেশন, কৃষিকল্যাণ সমিতি, ইসলাম প্রচার সমিতি, ইসলামিক একাডেমি, কোরআন লার্নার সোসাইটি, দারুসসালাম সোসাইটি, দারুল ইফতা, আলহেরা একাডেমী ইত্যাদি ।

৮। ভারতসহ অন্যান্য দেশের গোয়েন্দা সংস্থা থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের ১৪৮টি অস্ত্র প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে। এসব কেন্দ্রের অবস্থান নিশ্চিত করা।

৯। ৪৫০টি বেসরকারি সংস্থা ও বিভিন্ন ব্যক্তির নামে যে ৫৫৬ টি রহস্যজনক ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, সেগুলোর সঙ্গে এই ৭ নেতার সংশ্লিষ্টতা জানতে চান গোয়েন্দারা।

১০। ভারতীয় উলফা, এনডিএফবিসহ ৬টি উগ্রবাদী সংগঠনের সঙ্গে জঙ্গি নেতা ও জামায়াত নেতাদের সম্পৃক্ততা কি ? এর আগে একাধিক নেতার আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে উলফা’র ২০ জনেরও বেশি নেতার অবস্থান নেওয়ার খবর গোয়েন্দাদের হাতে এসে পৌঁছেছে।

১১। উত্তরা ষড়যন্ত্রে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের কোন কোন কর্মকর্তা জড়িত ছিলেন তাদের চিহ্নিত করা।

১২। ১৯৯১ সালে সংগঠিত বিডিআর বিদ্রোহের সঙ্গে জঙ্গিদের কোনো যোগসাজস ছিলো কি না তা চিহ্নিত করা।

বাংলাদেশ সময় ২২১৫ ঘণ্টা, জুলাই ১২, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।