ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

মুক্তমত

সব বিদেশি পণ্যই বর্জন করুন

ফজলুল বারী, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৪৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৭, ২০১২
সব বিদেশি পণ্যই বর্জন করুন

ভারতীয় পণ্য বর্জনের একটা আওয়াজ উঠেছে অনলাইনে। সীমান্তে ফেলানী হত্যা, বাংলাদেশি যুবককে দিগম্বর করে নারকীয় নির্যাতনসহ বিএসএফ-এর স্বেচ্ছাচারিতার প্রতিবাদে যারা কর্মসূচিটি দিয়েছেন, তাদের উদ্যোগ-অনুভূতিকে সম্মান জানাই।

অন্তত এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ যে তাদের এসব নিষ্ঠুরতা পছন্দ করছেন না, ভারতীয় এসব কার্যক্রমের বিরুদ্ধে ঘৃণা তৈরি হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষের মনে, ভারতীয়দের কাছে সে বার্তাটি পৌঁছে যাক।

কিন্তু উদ্যোগটির সঙ্গে একটু ভুলও আছে। কোকা-কোলার বোতলে তেলাপোকা বা মরা কিছু একটা পাওয়া গেছে বলে রিপোর্ট করে হৈচৈ করলে কে খুশি হয়? বা  বিষয়টি কার পক্ষে যায়? নিশ্চয়ই তা পেপসির! ঠিক একইভাবে বাণিজ্য মেলার সামনে দাঁড়িয়ে ভারতীয় পণ্যের বদলে ভোক্তাদের আমরা কি কিনতে বলবো? চায়নিজ, থাই, মালয়েশিয়ান, বার্মিজ, ইরানি বা পাকিস্তানি পণ্য? তাতে লাভটা কার হচ্ছে বা হবে? এর চেয়ে ভারতীয় পণ্য বর্জনের আওয়াজের সঙ্গে বাংলাদেশি পণ্য কেনার আওয়াজটা যোগ করলে ভালো হতো না? উদ্যোক্তারা আশা করি, ভেবে দেখবেন।


যদিও রাষ্ট্রের যেখানে অর্থনৈতিক নীতি মুক্তবাজার অর্থনীতি সেখানে এমন আওয়াজের বাস্তবতা বা সফলতার বিষয়টিও প্রশ্ন সাপেক্ষ। দেশের মানুষ গরিব। অর্থনৈতিক সমস্যায় পর্যুদস্ত। বাজারে গিয়ে বেশিরভাগ মানুষ যেটি সস্তায় পান সেটিই কেনেন। সেটি ভারতীয় না কোন দেশের তা দেখার তার অবস্থা বা ফুরসত কোথায়? দেশি পণ্যটি তাকে তুলনামূলক কম দামে দিলে তিনি নিশ্চয় দেশিটাই কিনবেন। কিন্তু বাংলাদেশের আকণ্ঠ নিমজ্জিত দুর্নীতি, অবকাঠামোগত নানা ত্রুটি-সীমাবদ্ধতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফার লোভসহ নানা কারণে শুরুতেই পণ্যের দাম তুলনামূলক বেশি পড়ে যাচ্ছে। সেই সুযোগে দেশের বাজারে দেদারসে ঢুকছে বিদেশি পণ্য। নিকট প্রতিবেশী হওয়াতে ভারতীয় পণ্য ঢুকছে বেশি। আবার ভোজ্যতেল যেটি ভারতে হয় না, সেটি মালয়েশিয়ার মতো দেশ থেকে আসে।   এমনকি মসুর ডাল, পিঁয়াজ, আদা-রসুন, চিনি, জিরাসহ গরম মসল্লার বাজার স্থিতিশীল রাখতেও বাংলাদেশ আমদানির ওপর নির্ভরশীল। চিনি কিনতে বাংলাদেশ মাঝে মাঝে ব্রাজিল পর্যন্তও যায়। পিঁয়াজ ভারতের কাছে না পেলে বাজার স্থিতিশীল রাখতে ছুটে যাওয়া হয় মিয়ানমারে। চাল-গম এসবের বিদেশি সরবরাহ ঠিক না থাকলে বাজার আর ভোটের চিন্তায় সরকারের মাথা খারাপ হয়।

ফরহাদ মাযহারের উবিনীগে দেশি অর্গানিক খাদ্য যা বিক্রি হয়, তার দাম অনেক বেশি। দেশের মানুষের যাদের হাতে কাঁচা পয়সা বেশি তারা বেশি টাকায় উবিনীগের স্বাস্থ্যসম্মত অর্গানিক খাবার কেনার যোগ্যতা রাখেন। তাদের টার্গেট মার্কেট নিঃসন্দেহে দেশের আমজনতা না। এক সময় বলা হতো, এপারে মুরগি একটা ডিম পাড়লে তা মুহূর্তে ভারতে চোরাচালান হয়ে যেত, মুক্তিযুদ্ধের পরও রংচটা ভারতীয় কাপড় থেকে শুরু করে নানা পণ্যের এপারে কোনো কদর ছিলো না, এপারে সহজলভ্য চায়নিজ ভিসিপিসহ নানা ইলেক্ট্রনিকস পণ্য চোরাচালান হয়ে গেলে সেটির একজন গর্বিত মালিক বনে যেতে পারলে দাদারা জাতে উঠতেন, সেখানে বৈধ-অবৈধ নানাপথে বাংলাদেশের বাজার ভারতীয় পণ্যে সয়লাব অথবা নির্ভরশীল কী করে হয়ে গেল, তা নিয়ে আমাদের আত্মসমালোচনা কোথায়?

বাংলাদেশের একটা টিভি চ্যানেলকে বছরের পর বছর ধরে ভারতীয়রা তাদের দেশে দেখাবার অনুমতি দেন না, কিন্তু আমাদের এখানে ডিশওয়ালাদের মাসিক টাকা দিয়ে তা গোগ্রাসে দেখা হয়। চাহিদার ভারতীয় চ্যানেল ঠিকমতো না দিলে ডিশ ব্যবসায়ীকে ফোন করে গরম দেখাই! পঞ্চাশ হাজারের বেশি বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রী এখন ভারতে পড়াশোনা করেন। অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশি যে ছাত্র পড়তে আসেন, তিনি কাজ করে পড়েন। আর ভারতে বা মালয়েশিয়া-সিঙ্গাপুরে যারা পড়তে যান, তারা পড়েন দেশ থেকে নেওয়া বাপের টাকায়। প্রাইমারি বা হাইস্কুল লেভেলেও ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার নামে বাংলাদেশি কত পরিবার, দার্জিলিংসহ নানা ভারতীয় শহরে বাসাভাড়া করে থাকেন? বাংলাদেশের বেশিরভাগ ডাক্তার-নার্স রোগীদের সঙ্গে কসাইয়ের মতো ব্যবহার করেন। ভালো করে কথাও বলেন না। তাই অনেকের সর্দি-কাশি না কমলেও ছুটেন ভারতে!

এভাবে অসুস্থতা, ডাক্তার দেখানো, আজমির জিয়ারত, বিয়ের বাজার অথবা কলকাতার পার্ক স্ট্রিট, সদর স্ট্রিটের বারে বসে সংকোচহীন বিয়ার গেলার জন্য কতো বাংলাদেশি প্রতিদিন ভারত যাতায়াতে বৈধ-অবৈধ নানাভাবে কী পরিমাণ ডলার নিয়ে যাচ্ছেন? কলকাতার বাস-ট্রেনের যাত্রীদের কি ৯৯ শতাংশ বাংলাদেশি না? সারা ভারত জুড়ে ওয়ার্ক পারমিটধারী কয়জন বাংলাদেশি আছেন? আর বাংলাদেশে ওয়ার্ক পারমিটধারী ভারতীয় আছে কত হাজার? এসবের বিনিময়ে একটি বিশাল বাজারের ভোক্তার মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানটিও ভারতের কাছে আমাদের নেই।

রাজনৈতিক বাকোয়াজি ছাড়া প্রাপ্য মর্যাদা আদায়ের কিছুও আমরা কোনোদিন করিনি অথবা করতে পারিনি। আজকাল ফেসবুকের ইনফো’র ভাষার জায়গায়ও বেশিরভাগ বাংলাদেশি বাংলা-ইংরেজির পাশে ‘হিন্দি’ জানার কথাও গর্বের(!) সঙ্গে লিখে রেখেছেন, এমন একটি দেশে-সামাজিক বাস্তবতার কোথাও কোনো আত্মসমালোচনা বা কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টাও আছে কি? ভারতীয়রা কী এমনি এমনি বাংলাদেশকে পেয়ে বসেছেন, আর যা খুশি তা করছেন?

সীমান্তে গরু চোরাচালান হয়, এটি ওপেন সিক্রেট। ভারতীয় গরু চোরাচালান হয়ে না আসলে নাকি বাংলাদেশে গরুর মাংসের কেজি হাজার টাকা ছাড়াবে! গরুর মাংসের কেজি ১০০০ টাকা কেন, সরকার জবাব চাই, স্লোগান দিয়ে বিরোধীদল সরকারও ফেলে দিতে পারে! গরুর মাংসের বাজারদর স্থিতিশীল, ভোক্তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে যদি ভারতীয় গরু আমদানির দরকার হয়, তাহলে তা বৈধ পথে আমদানির ব্যবস্থা করা হয় না কেন? বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের জায়গায় জায়গায় ভারতীয় গরু চোরাচালানি হয়ে আসার চিহ্নিত সব স্পট-করিডোর আছে। বিজিবি-বিএসএফ-এর লোকজন বছরের পর বছর ধরে এসব চোরাচালানের গরুর ব্যবসার হিস্যা পাচ্ছেন-খাচ্ছেন! হিস্যায় গোলমাল দেখা দিলেই চাঁপাইনবাবগঞ্জের হাবিবের ঘটনা ঘটছে।

হাবিবের ঘটনাটি মিডিয়ায় আসায় বেশি ভয়ঙ্কর লাগায় আমরা স্বাভাবিক ক্ষিপ্ত হয়েছি। এমন অহরহ ঘটনা হয়তো ঘটছে। যা আমরা জানছিও না। ইন্দোনেশিয়ার মতো বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশও গরুর মাংসের বাজার স্থিতিশীল রাখতে অস্ট্রেলিয়ার গরুর সরবরাহের ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশে কোরবানির সময় রাস্তার পাশে যেভাবে গরু জবাই হয় তেমন একটি জবাইয়ের ছবি অস্ট্রেলিয়ান মিডিয়ায় প্রচারের পর এখানকার প্রাণী অধিকার সুরক্ষা আন্দোলনকারীদের প্রতিবাদের মুখে ইন্দোনেশিয়ায় জীবিত গরু রফতানি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এরপর থেকে  সেখানে যাচ্ছে জবাই-ড্রেসিং করা গরু। ইন্দোনেশিয়ার দরকার মাংস। জীবিত গরু দেখা নয়।

বাংলাদেশের মাংসের বাজার স্থিতিশীল  রাখতে বৈধভাবে ভারতীয় বা মিয়ানমারের গরু আমদানির চেষ্টা কি কখনো হয়েছে? দেশে সরকারের পর সরকার আসছে-যাচ্ছে, ভারতীয় গাড়ির একচেটিয়া বাজার করে দিতে যদি জাপানি-কোরিয়ান গাড়ি আমদানি বন্ধ করা যায়, তাহলে গরু চোরাচালান বন্ধে বৈধ আমদানির ব্যবস্থা করা যাবে না কেন? না ওখান থেকেও জায়গা মতো চলে যাচ্ছে ভাগের টাকা? এর জন্যে কী সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদক মুখের ওপর বলে দিতে পারেন, সীমান্তের ঘটনায় তারা চিন্তিত না? বিরোধী দলের মহাসচিব এর নিন্দা করেন, কিন্তু ভারত বা অন্য কোথাও থেকে বৈধভাবে গরু বা মাংস আনার দাবি করেন না!

এখন বিচ্ছিন্নভাবে যে সব দেশপ্রেমিক তরুণ ভারতীয় পণ্য বর্জনের আওয়াজ দিয়েছেন, এ নিয়ে মিডিয়ায় লেখালেখি হলেও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়াটি তারা নিশ্চয় খেয়াল করেছেন। বিএনপিসহ যেসব দল মুখে মুখে ভারত বিরোধিতার ফেনা তোলে, এরা কিন্তু কখনও ভারতীয় পণ্য বর্জনের কথা বলে না! বা সারাদিন যারা এখানে সেখানে সমর্থন বিলি করে বেড়ায়, এখন এই ভারতীয় পণ্য বর্জনের আহ্বানের পক্ষে তাদের সাড়া নেই! খালেদা জিয়াও যে হিন্দি সিরিয়ালের ভীষণ ভক্ত! বিএনপিও জানে, বাজারে ভারতীয় ভোগ্যপণ্য না থাকলে বাজার তেড়ে বেড়ে চড়ে ভোক্তারা শুধু শেখ হাসিনা না খালেদা জিয়ারও গোষ্ঠী উদ্ধার শুরু  করবেন!

সে কারণে এখানে যদি বিএনপি বা সো-কল্ড ভারত বিরোধী রাজনীতির লোকজন যার যার ফায়দা নিতে আসবেন। কাজেই তারুণ্যের আন্দোলনকে দেশপ্রেমিক পবিত্র সংকল্পের পক্ষে রাখতে চাইলে এখানে রাজনৈতিক ফায়দা নেবার চররা যাতে না ঢুকতে পারেন, সে খেয়াল রাখতে হবে। দেশি পণ্য কিনতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে মানুষকে। দেশি পণ্য যাতে দেশের মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকে সে চেষ্টা করে যেতে হবে।

দেশপ্রেমিক ব্যবসায়ীরা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। অস্ট্রেলিয়ার বাজার চীনা পণ্যে ভর্তি। চীনা পণ্য তুলনামূলক সস্তা।   কিন্তু অস্ট্রেলিয়ান পণ্যের গায়ে লেখা থাকে ‘প্রাউড অস্ট্রেলিয়ান প্রোডাক্ট’। দাম একটু বেশি পড়লেও এ পণ্য কিনে অস্ট্রেলিয়ানরা গর্বিত বোধ করেন। বাংলাদেশেও এমন ‘দেশি পণ্য কিনে হও ধন্য’, আন্দোলনকে আবার ছড়িয়ে দিতে-জনপ্রিয় করে তুলতে হবে। তাতে করে বদলে যাবে দেশ। এখনই গার্মেন্টস শিল্পের বিকাশের কারণে দেশের ছেলেদের পোশাকের জন্য অন্তত বিদেশি জামা কাপড় কেনা লাগে না। অন্য সেক্টরগুলোতেও সৃষ্টি করতে হবে স্বদেশি আন্দোলন।

এমন একটি নিশানা ঠিক না করে শুধু ভারতীয় পণ্য বর্জনের ঘোষণা দিলে-কথা বললে কোকা-কোলার বদনামের লাভ পেপসির ঘরে তুলে দেবার মতো লাভের গুড় খাবে পিঁপড়ায়!

ফজলুল বারীঃ  সিডনি প্রবাসী সাংবাদিক

বাংলাদেশ সময় : ১৭৪০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৭, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।