ঢাকা, রবিবার, ২০ আশ্বিন ১৪৩১, ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ০২ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

ব্যাধিই সংক্রমণ, স্বাস্থ্য নয়

রফিকুল ইসলাম, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০১০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৪, ২০২০
ব্যাধিই সংক্রমণ, স্বাস্থ্য নয়

সমাজবিজ্ঞানে নৈতিক অবক্ষয় সামাজিক ব্যাধি। প্রমথ চৌধুরীও বই পড়া প্রবন্ধেও বলেছেন, 'ব্যাধিই সংক্রমণ, স্বাস্থ্য নয়'।

প্রতিপাদ্য বিষয় এটিই।  

হালে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা যৌন নিপীড়নরোধে `শিশুকে গুড টাচ এবং ব্যাড টাচ শেখান' শীর্ষক বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর পক্ষে যৌন শিক্ষায় নৈতিকতা বিষয়ক সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত ভিডিও বক্তব্যটি মোক্ষম বর্ম হতে পারে। সেসঙ্গে সন্তানকে পঙ্কিলতা থেকে সুরক্ষিত রাখতে যে লেসনও আবশ্যকীয় তা হলো- 'হেলথ্ এডুকেশন এবং সেক্স এডুকেশন'। কেননা, যৌন ধারণার অভাবে অনেক শিশু ও কিশোর-কিশোরীই জানে না সে পারিবারিক যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছে কিংবা দিকভ্রান্ত হচ্ছে।

যৌনতা থাকবে। কিন্তু হিংস্রতা ও অবাধ নয়। যৌন সহিংসতা বর্বরতার কুৎসিত রূপ। নারীর প্রতি শ্রদ্ধা ও সংবেদনশীলতার সংকীর্ণতা যৌনতায় হিংস্ররূপ পেয়েছে। বিবাহবহির্ভূত যে কোনো যৌন-সংযোগই অনৈতিক। নৈতিকতা যৌনতার রক্ষাকবচ। আধুনিক মানবজীবন এক জটিল ও বিস্তৃত ক্ষেত্র। মানুষ আজকাল নানান সমস্যা সমাধানে নিয়োজিত। কেউ গবেষণায় নিয়োজিত রয়েছেন দৈহিক ও মানসিক প্রতিক্রিয়া, কেউবা বিশ্বাস, কেউবা ব্যক্তিত্ব প্রভৃতির সমাধানে। এক কথায় মানবজীবন এক বিরাট ক্ষেত্র- যাতে মানুষের কাজকর্ম, সমস্যা সমাধান, চিন্তা, অনুভূতি, আবেগ, ইচ্ছা, অনুরাগ প্রভৃতির সৃষ্ট জটিল সমস্যার নিরসনকল্পে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।

পুলিশী বক্তব্যে ফুটে উঠেছে যৌন নিপীড়ন রোধে প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই মুখ্য। প্রেম-প্রীতি, ভালোবাসা, অপরের প্রতি সহানুভূতি-সহমর্মিতা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। জ্যোতির্ময় ও বিভুময় এ যুগেও মানুষ পরিবেশ পরিস্থিতির শিক্ষা প্রকৃতি বা স্বভাব-চরিত্রের প্রভাবে হারিয়ে ফেলে পশুবৃত্তিতে মত্ত হয়ে অবিবাহিতদের অবদমিত যৌনাকাঙ্ক্ষা ও বিবাহিতদের অযাচিত যৌন অতৃপ্তির কূপমণ্ডূকতা যৌনতাকে হিংস্রতা বা ভায়োলেন্সে দাঁড় করিয়েছে।

উপযুক্ত পারিবারিক মূল্যবোধ, নৈতিক শিক্ষা, আত্মসংযম ও আত্মশুদ্ধির ঘাটতিসহ আকাশ অপসংস্কৃতি, পর্ণো ভিডিও-জার্নাল-সাহিত্য থেকে শিক্ষা নিয়ে অনেকেই ধাবিত হচ্ছে বিকৃত পথে। রাস্তাঘাটে বাধা, অশ্লীল কটাক্ষ, উত্যক্ত, কৌশলে কিংবা জোরপূর্বক যৌন স্পর্শ, ইভটিজিং বা যৌন হামলা বা আগ্রাসনের শিকার হওয়া ছাড়াও অপহৃত হয়ে হচ্ছে গণধর্ষিত। অনিয়ন্ত্রিত যৌনতার শিকার হচ্ছে ছাত্রীসহ সব বয়সী নারী। এমনকি বাদ যাচ্ছে না নারীর মরদেহও।  

কোনো সমাজে যৌন সহিংসতার উপস্থিতি নিঃসন্দেহে সেই সমাজের মানব উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত শুধু নয়, অন্যান্য আর্থ-সামাজিক সমস্যার চেয়েও অধিক গুরুতর সমস্যা। সেজন্যই মূল্যবোধ পরিপন্থী কোনো কার্যক্রম সমাজে গৃহীত হয় না। যে কারণে মানবজাতি মহাবিপর্যয়ে শ্রেষ্ঠত্বের অন্বেষণ করে। ধর্ষণ হিংস্রতা এমনই একটা বিকৃত যৌনক্ষুধা ও নৈতিক বিপর্যয় যে- আদর্শ পরিবার, কল্যাণরাষ্ট্র, সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও সম্প্রীতিমূলক সমাজব্যবস্থা তথা নৈতিকতায় স্নিগ্ধ-ধ্রুপদী সমাজব্যবস্থা নির্মাণে; কল্যাণ-ভব্যতা, শিষ্ট-সুস্থতা ও উন্নত বৈশিষ্ট্যপূর্ণ তাৎপর্যে প্রাণপ্রবাহ সঞ্চার করতে এবং নিষ্ঠুরতা, বর্বরতা, বুনো-পাশবিকতার ওপর ন্যায়নিষ্ঠ; সাম্য-সম্প্রীতি, মমতা-সৌহার্দ্য, মন্দের ওপর কল্যাণ ও দুষ্টের ওপর শিষ্টের বিজয়চিহ্ন নিশ্চিত করতে শুধু আইন আর শাসন দিয়ে সম্পূর্ণ শোধরানো অসম্ভবই।

নৈতিকতা বা প্রকৃতির প্রশ্নে মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ আবার মানুষই নিকৃষ্ট। শিক্ষায় নৈতিকতার অনুপস্থিতি মানুষকে জংলি বানায়, জাতিকে বিপন্ন করে তুলে। শিক্ষা হলো ব্যক্তির জীবনব্যাপী ক্রমবিকাশের অবিচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া, যা নিত্যনতুন অভিজ্ঞতার মাধ্যমে তার আচরণের প্রত্যাশিত পরিবর্তন সাধনে সমর্থ করে। কিন্তু বাস্তবে আমরা নৈতিক চরিত্রের কাঙ্ক্ষিত ও প্রত্যাশিত পরিবর্তন করতে পারছি না নৈতিকতায় গলদের দরুন।

মূলত নৈতিকতা বিবর্জিত কোনো শিক্ষাই প্রকৃত শিক্ষা নয়। 'মানুষের সুন্দর নৈতিক চরিত্রের বিকাশ সাধন করে শিক্ষা'- হাবার্টের সংজ্ঞার্থ বহুলাংশে প্রাতিষ্ঠানিক উত্তরপত্রেই সীমাবদ্ধ থাকায় জীবনাচরণে নৈতিক চরিত্রের কাঙ্ক্ষিত সেই পরিবর্তন ঘটছে না। এতে বিবর্তনে যৌন হিংস্রতা অপ্রতিরোধ্য গতিতে মাথাচাড়া দিয়ে উঠার ক্ষেত্রে পুলিশ প্রশাসনের 'শিশুকে গুড টাচ এবং ব্যাড টাচ শেখান' প্রতিরোধে প্রতিবিধান বটে।

'ধর্ষণ' তিন বর্ণের ক্ষুদ্র শব্দ হলেও অত্যাধিক ঘৃণিত ও পাপাচারী শব্দ, যা মহাঅপরাধ-- অসামাজিক, অন্যায়, অনৈতিক, অনৈসলামিক ও বেআইনি। মানবজাতির গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান তিনটি- রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবার। এর মধ্যে রাষ্ট্র এগিয়ে এসে ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করা হলেও সংকটের স্থায়ী সমাধানে সমভাবে এগিয়ে আসতে হবে সমাজ ও পরিবারকেও, যা পুলিশী বক্তব্যকেই প্রতিষ্ঠিত করে।

যে কোনো সমস্যার সমাধানে কেবল বিচার নয়, কঠিন সাজা দেয়াও নয়; সমস্যাটি যাতে সমাজে উৎপত্তি না হয় তার পদক্ষেপ নেওয়া অধিক জরুরি। এক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকা অগ্রগণ্য। চিরস্থায়ী এই সামাজিক সংগঠন থেকেই মানবজাতির বিকাশ লাভ হয়েছে। শিশুকে উপযুক্ত সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার প্রাথমিক কেন্দ্রবিন্দু হলো সুগঠিত পরিবার, যা সমাজ জীবনের ভিত্তিস্বরুপ। পারিবারিক পরিবেশে শিশুরা মৌলিক শিক্ষা লাভ করে। প্রতিটি শিশু একটি জীবন্ত সত্তা। যৌনতা অতি স্পর্শকাতর বিষয়। ডাক্তারি কেস স্টাডির বরাতে একটি নিউজ পোর্টাল জানায়, 'বাচ্চাটি প্যান্ট খুলে যা দেখালো তার জন্য মা-বাবা প্রস্তুত ছিল না। তাই সন্তান একটু বড় হলে ঘুমের বিছানা পৃথক করে দেওয়া বাঞ্ছনীয়। শিষ্টাচার ও শালীনতাসহ নারীর মর্যাদা-অধিকার চিত্ত জাগরূকের মোক্ষম ক্ষেত্র পরিবার।

সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, জন্মের সময় বহু কোষবিশিষ্ট মাংসপিন্ডে মস্তিষ্কে পরিচালিত অনেকটা বংশগত গুণাগুণ নিয়ে পৃথিবীতে আসে শিশু। পরবর্তীতে পরিবেশের প্রভাবে প্রভান্বিত হয়ে ভবিষ্যতের কর্মসূচি নির্বাচিত করে। চেতন, অবচেতন ও অচেতন মনে পরিবেশের স্থায়ী প্রভাব তার জীবনে রয়ে যায়। এ মূল পরিবেশকে কেন্দ্র করে পারিপার্শ্বিকতার পটভূতিতে যে শিশু তাল সামলাতে পারে না, সেই শিশু কালক্রমে পঙ্কিলতায় পা বাড়ায়। অপরাধে ঝুঁকে পড়ে। এছাড়া বিবাহিত নর-নারীর পরাসক্ততা পরিবারে বাচ্চাদের মনস্তাত্ত্বিকভাবে বিকারগ্রস্ত করে তোলে।  

সর্বোপরি মানুষ প্রকৃতিগতভাবে ষড় রিপুর দ্বারা আক্রান্ত। অর্থাৎ মানবচরিত্রের প্রবৃত্তি ছয়টি- কাম বা যৌনক্ষুধা, রাগ, লোভ, মোহ, মদ বা দম্ভ ও মাৎসর্য বা পরশ্রীকাতরতা। এ প্রবৃত্তিগুলো মানবের জ্ঞান ও বিবেককে বাধাগ্রস্ত করে বলে তা রিপু তথা শত্রু নামে পরিচিত। অন্যদিকে মানবদেহে ১৪টি ইন্দ্রিয় রয়েছে-- চোখ, কান, নাক, জিহ্বা, ত্বক বা দেহকোষ, বাক বা কথা, হাত, পা, পায়ু বা মলদ্বার, উপস্থ বা জননেন্দ্রিয় মন, বুদ্ধি বা জ্ঞান, অহংকার, আত্মা বা চিত্ত। দেহের এই ১৪টি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ও প্রাণশক্তি, যা দিয়ে বাহ্য বা বাইরের বিষয়ের জ্ঞান অনুভূতি উপলব্ধি হয়।

রিপুদমনই আত্মসংযম। এই প্রবৃত্তি ও ইন্দ্রিয়ের সুনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার মানুষকে সভ্য ও উন্নতর জীবন দেয়। প্রকৃত শিক্ষা পশুকে মানুষ হিসেবে দাঁড় করায়। অন্যদিকে এসব প্রবৃত্তি ও ইন্দ্রিয় প্রভাবান্বিতের অপার দৈবযোগে মনুষ্যত্ববোধ লোপ পায়। দিকভ্রান্তিতে যৌনতার যথেচ্ছাচার ও অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার মানুষকে পশুরও অধম করে দেয়। নিমজ্জিত করে অধ:পতনের অতল তলে।

প্রত্যেক মানুষ আদম (আ.) থেকে জন্ম। নারী-পুরুষ সমাজদেহের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। নারীরা পুরুষের সহোদরা। স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা নারী-পুরুষকে একে অপরের পরিপূরক ও মুখাপেক্ষী বানিয়েছেন। এই মুখাপেক্ষীতে নির্ভরতা সামাজিক, সাংস্কৃতিক, মনস্তাত্ত্বিক ও যৌন সব দিক দিয়েই। তারা একে অপরের প্রতি সদাচার করতে বাধ্য। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নারীর ভূমিকা প্রধান হয়ে উঠেছে। সামাজিক ও সামজিক জীবনের সুষ্ঠু-সুস্থতা ও উন্নতি একান্তভাবে নির্ভর করে নারী সম্পর্কে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গির ওপর। এ উন্নত দৃষ্টিভঙ্গি গড়তে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও রাখতে পারে বলিষ্ঠ ভূমিকা।

মানুষের পরিচয় জানার পর এবং মানবজাতির নারী ও পুরুষ সম্পর্কে সঠিক উপলব্ধির পর সামষ্টিক জীবনের দাবি হলো, একে অপরের সাথে সমান তালে চলবে। সামাজিক জীবনের উন্নতি ও অগ্রগতি একান্তভাবে নির্ভর করে নারী-পুরুষের সুষ্ঠু ও সঠিকতার ওপর। নারী-পুরুষ মিলে গঠিত হয় সমাজ। সমাজের একাংশের প্রতিনিধি নারী আরেকাংশের প্রতিনিধি হচ্ছে পুরুষ। উভয়েই সমাজ, সভ্যতা, সংস্কৃতির নির্মাতা। নারীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে সংসার গঠনে, সুস্থ জাতি ও সুষ্ঠু সমাজ বিনির্মাণে।

যৌন নিগ্রহ মূল্যবোধের বিচ্যুতি। এটি বিহ্যাভিয়ার ডিজিজ বা আচরণবাহিত রোগ। এক্ষেত্রে শিশুকে 'গুড টাচ ও ব্যাড টাচ' শেখানোর পাশাপাশি সন্তানকে 'হেলথ্ এডুকেশন ও সেক্স এডুকেশন এবং বড়দের ক্ষেত্রে আত্মশুদ্ধিও হতে পারে ভ্যারি মাচ।

'আবার তোরা মানুষ হ' খান আতাউর রহমান পরিচালিত ১৯৭৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রটি তখনকার যুব সমাজের অস্থিরতাকে নিয়ে নির্মিত হয়েছিল, যা হালে মনুষ্যোচিত নীতি ও মনুষ্যত্বের নৈতিক ঙ্খলনে সময়েরও আহ্বান।

লেখক: সাংবাদিক।
সহযোগী সম্পাদক, আজকের সূর্যোদয়, ঢাকা

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।