ঢাকা, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

মুক্তমত

জেগে আছে বাংলাদেশ

ড. আবুল হাসনাৎ মিল্টন, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬১০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৩, ২০১২
জেগে আছে বাংলাদেশ

সিডনি, অস্ট্রেলিয়া থেকে: ‘বর্তমান সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবে না, এটা তাদের রাজনৈতিক স্ট্যান্টবাজি’। ‘শীর্ষ রাজাকার-ঘাতক গোলাম আযমকে গ্রেপ্তার করার দুঃসাহস বর্তমান সরকারের নেই’।

‘যুদ্ধাপরাধী গো. আযম গংকে গ্রেপ্তার করলে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের সব দেশ থেকে মৌমাছির মত ঝাঁকে ঝাঁকে বাংলাদেশী শ্রমিকদের ছাটাই করে দেশে ফেরত পাঠানো হবে’।

জামায়াত-বিএনপি এবং তাদের পোষ্য বুদ্ধিজীবীরা আরো কত সংশয়-আশঙ্কা সুকৌশলে বাঙালিদের মনে প্রবেশ করানোর চেষ্টা করেছে। পাশাপাশি কয়েক শ’ কোটি টাকা খরচ করে বিদেশে লবিং ফার্ম নিয়োগ করেছে। দেশে-বিদেশে এইসব প্রোপাগা-া-লবিংয়ের একটাই উদ্দেশ্য: যে করেই হোক একাত্তরের ঘাতক যুদ্ধাপরাধী-মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধকারী গো. আযম, নিজামী, মুজাহিদী, সাঈদী গংকে রক্ষা করা।

এই সব ঘাতকদের রক্ষায় তারা এতোটাই মরিয়া হয়ে উঠেছে যে, স্বয়ং বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াও রাখঢাক না রেখে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকানোর জন্য সোচ্চার হয়েছেন। তথাকথিত নিরপেক্ষতার নামাবলী গায়ে দিয়ে ঘুরে বেড়ানো জামায়াত-বিএনপির স্বার্থ রক্ষাকারী বুদ্ধিজীবী আসিফ নজরুলরাও মুখোশ খুলে নেমে পড়েছেন এদের রক্ষায়। টেলিভিশন চ্যানেলের টকশো’তে তারা এখন স্পষ্টই মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধকারীদের পক্ষ নিয়েছেন। নানা খোঁড়াযুক্তিতে তারা জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

এতো কিছুর পরেও মনে হয় না, যুদ্ধাপরাধীদের শেষ রক্ষা হচ্ছে। কিছুটা সময় নিয়ে হলেও সরকারও বেশ আটঘাট বেধেই নেমেছে। কতিপয় বাচাল মন্ত্রীর লাগামহীন কথা বার্তায় মাঝে মাঝে কিছু বিভ্রান্তি সৃষ্টি হলেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এখন স্রেফ সময়ের ব্যাপার। সর্বশেষ গো. আযমকে গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে সরকার দেশবাসীর কাছে সেই বার্তাটাই পৌঁছে দিয়েছে।

গোলাম আযমকে যখন বিশেষ ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয় তখন আদালতের বাইরে রাজপথ জুড়ে ছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে স্বজন হারানো মানুষের দীর্ঘ কাফেলা। ছিলেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে আন্দোলনরত অধ্যাপক মুনতাসির মামুন, শাহরিয়ার কবিরসহ শ্রদ্ধেয় নেতৃবৃন্দ। আর তথ্য প্রযুক্তির কল্যাণে মুহূর্তের মধ্যে গো. আযমের গ্রেপ্তারের খবর সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়লে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বসবাসরত মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ভাসিত বাঙালি কম্যুনিটিতে বয়ে যায় আনন্দের বন্যা। সেই সঙ্গে দৃঢ়তার সঙ্গে মানুষের মুখে উচ্চারিত হতে থাকে মুক্তিযুদ্ধের কালজয়ী শ্লোগান।

সারা বাংলাদেশেরও একই চিত্র। গোলামের গ্রেপ্তারে শহরের রাজপথে, মহল্লায় মিছিল হয়েছে। দেশবাসীর আবেগও মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়েছে ইন্টারনেটে, ফেসুবকে, ব্যক্তিগত এসএমএসে।

মুক্তিযুদ্ধে গিয়ে আর ফেরেননি  শিশু নাজমুলের বাবা, বাবার লাশটিও দেখা হয়নি তার। আজ বড় হয়ে ডা. নাজমুল লাল-সবুজের পতাকায় বাবার মুখ খুঁজে পান। গোলাম আযমের গ্রেপ্তারের সংবাদে আনন্দে উদ্বেল নাজমুলের সামনে বারবার ভেসে ওঠে অস্পষ্ট হয়ে যাওয়া শহীদ বাবার মুখ। এক সময়ের ছাত্রলীগ নেতা আজাদ রাজপথের মিছিল থেকেই ফোন করেন, তার কণ্ঠস্বরে বাজছে যুদ্ধের দামামা। ফেসবুকের পাতা জুড়ে পরিচিত চাঁদপুরের রতন মজুমদার, ঢাকার শারমিন রূপা, কানাডার ভজন সরকার, সুইডেনের সাব্বির খানসহ সহযোদ্ধাদের দৃঢ় উচ্চারণ।

মনে পড়ে, শহীদ জননী জাহানারা ইমামের মুখ। একানবব্বইয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে শিক্ষক সমিতি আর ছাত্র সংসদের যৌথ আয়োজনের দুটি অনুষ্ঠানে এসেছিলেন তিনি। আমার বক্তৃতার পরে কাছে ডেকে এনে আশীর্বাদ করলেন। বললেন, ‘বাসায় এসো’। আমাদের চেতনার খুব কাছের স্বজন ডা. আলিম চৌধুরী ও ডা. ফজলে রাব্বীর সহধর্মিনী  দুজন ছিলেন আমাদের সুখ-দুঃখের নিত্যসঙ্গী।

আমার সদ্য প্রয়াত মায়ের কথাও বারবার মনে পড়ছিল। সেই যে একাত্তরে, আমি তখন পাঁচ বছরের শিশু, মা আমাকে নিয়ে রাতের আঁধারে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন গ্রাম-গ্রামান্তরে। খুলনা থেকে অবশেষে যখন আমরা গোপালগঞ্জে নানাবাড়ি পৌঁছালাম, তখনো স্বস্তি নেই। পাকিস্তানি বাহিনীর হামলার ভয়ে আমরা সারাদিন বিলের ভেতরে জল-কাঁদায় পালিয়ে থাকতাম। একদিন গ্রামে সত্যি সত্যি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এল, জ্বালিয়ে দিল ঘর-বাড়ি-খড়ের গাদা। গুলি করে জলে ভাসিয়ে দিয়েছিল মায়ের দাদার লাশ। নানা শেষ মুহূর্তে পুকুরে লাফিয়ে পড়ায় গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হল।

মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর খুলনা ফিরে এলে মা আমাকে নিয়ে গেলেন গল্লামারী রেডিও স্টেশনের কাছের বধ্যভূমিতে। দীর্ঘ সবুজ চত্বর জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মুক্তিযুদ্ধের অসংখ্য শহীদের হাড়-গোড়, মাথার খুলি। মুক্তিযোদ্ধা ইয়াদ আলি মামা এসে নিয়ে গেলেন শিপইয়ার্ড, বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধারা সেখানে ক্যাম্প গেড়েছেন।

সত্তর কিংবা বাহাত্তর আমার তেমন মনে পড়ে না, কিন্তু একাত্তর এখনো চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে ভাসে। মুক্তিযুদ্ধ এমনি তীব্র এক উপাখ্যান। সেই উপাখ্যানে, আমাদের স্বাধীনতা অর্জনে জীবন দিয়েছিলেন কমপক্ষে ত্রিশ লক্ষ শহীদ, ধর্ষিত হয়েছিলেন ন্যূনতম সাড়ে চার লাখ মা- বোন। আর এই নারকীয় হত্যাকা-, ধর্ষণ, অগ্নিকা-সহ সকল প্রকার মানবতা বিরোধী অপরাধে পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছিল মানুষ নামের কলঙ্ক, ঘৃণ্য ঘাতক গোলাম আযম, নিজামী, মুজাহিদী, কাদের মোল্লা, দে হো সাঈদী, ফজলুল কাদের চৌধুরী, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীরা।

মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ চল্লিশ বছর পর আজ সেই পরম প্রতীক্ষিত মাহেন্দ্রক্ষণ এসেছে। গোলাম আযমসহ অন্যান্য যুদ্ধাপরাধীরা স্বাধীন বাংলাদেশে আইনের কাঠগড়ায়। শীর্ষ ঘাতক গোলাম আযমের গ্রেপ্তারে অনুগত জামায়াত-শিবিরের দৃশ্যমান প্রতিক্রিয়া ছিল নগন্য। বরং রাজপথ দখলে ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের শক্তির। জামায়াতের দোসর বিএনপি তাদের চেতনার নেতা গোলাম আযমের গ্রেপ্তারে তাৎক্ষণিক সামান্য প্রতিক্রিয়া পর্যন্ত দেখায়নি।

তারপর ও নিশ্চিন্ত হবার সুযোগ নেই।   রক্তখেকো জামায়াত-শিবির ও তার দোসররা দেশে-বিদেশে চুপচাপ বসে নেই। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে হত্যার মাধ্যমে জিয়াউর রহমানের দ্বারা যেমন তারা যুদ্ধাপরাধীদের চলমান বিচার প্রক্রিয়াকে  থামিয়ে দিয়েছিল, প্রয়োজনে তারা সেরকম আরেকটি অঘটন ঘটানোর ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাবে।

নিজের জীবনের নিরাপত্তাকে অধিক সংকটে ফেলেও মুজিব কন্যা শেখ হাসিনা দেশবাসীর প্রত্যাশার প্রতি সন্মান জানাতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়াকে দৃঢ়তার সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। তার এই দৃপ্ত পথচলায়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও রায় কার্যকর করার দাবিতে জেগে আছে বাংলাদেশ।   প্রিয় স্বদেশকে দিন-রাত পাহারা দেয়, আগলে রাখে ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মা, নির্যাতিত সাড়ে চার লাখ মা-বোনের দীর্ঘশ্বাস।

রাজনীতির কূটচালে সাময়িকভাবে শক্তিশালী মনে হলেও দিনের শেষে গোলাম আযম গংদের স্থান হয় কেন্দ্রীয় কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে, ফাঁসির মঞ্চে আর বাঙালির ঘৃণার শীর্ষে।

ড. আবুল হাসনাৎ মিল্টন: আহবায়ক, জাস্টিস ফর বাংলাদেশ জেনোসাইড ১৯৭১, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।
 
বাংলাদেশ সময়: ১২৫৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৩, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।