ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

মুক্তমত

পলিটিক্যাল টাইমিং

আবিদ রহমান, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৪২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১১, ২০১২
পলিটিক্যাল টাইমিং

রাজনীতি কেবল মারপ্যাঁচের খেলাই নয়। এই খেলায় টাইমিংটাও গুরুত্বপূর্ণ।

ব্যাটসমান রাজনীতিবিদদের সবকিছু ব্যাটে-বলে হতে হয়। সামান্য বিভ্রান্তিতে, অন্যমনস্কতায় রাজনৈতিক উইকেটটি খোয়া যেতে পারে। কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন হতে পারে বিঘ্নিত। বোলার বা আক্রমণাত্মক রাজনীতির খেলায় টাইমিং নিখুঁত না হলে প্রতিপক্ষ ঘায়েল হয় না। রাজনীতিতে পক্ষ-বিপক্ষ দু’দলই পরস্পরকে ঘায়েল করতে পরিকল্পনা আঁটেন দিন-ক্ষণ তাল-লয় মিলিয়ে।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ‘আনপড়’ ও দলের নীতি নির্ধারণ থেকে যোজন মাইল দূরে থাকা ‘বাচ্চা’ মন্ত্রীরা বারবার চিৎকারে যুদ্ধাপরাধীদের গ্রেপ্তার ও বিচারের দিন-ক্ষণ ঘোষণায় মাঠ গরম রাখছিলেন। দলীয় পরিকল্পনা বাস্তবায়নের টাইমিং সম্পর্কে এইসব নেতার হাস্যকর আর বাচাল বাতচিতে হেসেছি। বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের ফাঁসি বাস্তবায়নের আগে আমরা দেখেছি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কূটনৈতিক তৎপরতা। যেকোনও বড় ধরনের গ্রেপ্তারের আগেকার সতর্কতা ভালো লেগেছে।  

চল্লিশ বছর ধরে আলোচিত-সমালোচিত ব্যক্তিদের একজন গোলাম আযমের গ্রেপ্তারে আওয়ামী টাইমিংয়ের মুন্সিয়ানা লক্ষ্যণীয়। মাত্র দিন তিনেক আগে প্রধান বিরোধী দলের নেত্রী খালেদা জিয়া তৃতীয় রোড মার্চ শেষে চাটগাঁতে যুদ্ধাপরাধী জামায়াতিদের মুক্তির লক্ষ্যে ‘চলো চলো ঢাকা চলো’ শো ডাউনের ডাক দিয়েছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ব্যাহত করতে মরিয়া হয়ে উঠছিলেন মুক্তিযোদ্ধা জিয়ার স্ত্রী খালেদা জিয়া। গদি পুনরুদ্ধারে জামায়াতিদের একমাত্র ভরসা খালেদা ভুলতে বসেছিলেন যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি দেশের মানুষের রয়েছে তীব্র ঘৃণা। কার্যকলাপে খালেদা জিয়া হয়ে উঠছিলেন জামায়াতের অলিখিত আমীর।

জামায়াতিদের দেওয়া শত কোটি টাকার রোড মার্চে জন-উপস্হিতিতে স্টারডম-কাতর খালেদা জিয়ার মালুম হচ্ছিলো উনি বিকল্পহীন এক রাজনৈতিক শক্তি। ক্ষমতার স্বপ্নে তিনি সেনাবাহিনীকেও উস্কে দিতে চেয়েছেন। কিন্তু তিনি বঙ্গবন্ধুকন্যার সৎসাহস ও কূটনৈতিক যোগ্যতা সম্পর্কে পুরোপুরি ওয়াকিবহাল ছিলেন না। জিয়ার চার দিনের কুলখানির মোনাজাতের সময়ই রাজাকার প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজ জিয়ার ঘনিষ্ঠদের ‘সাইজ’ করে খালেদা জিয়াকে কিছুদিনের জন্যে অসহায় করে রেখেছিলেন।

 আর এবার ‘বাঘে ধরলে ছাড়ে কিন্তু শেখ হাসিনা ধরলে ছাড়েন না’ এই সত্য প্রমাণে শেখ হাসিনা ‘অপ্রস্তুত’ খালেদা জিয়াকে ধরাশায়ী করেছেন রাজনৈতিক লেগ-বিফোরে। গোলাম আযমকে যখন গ্রেপ্তার করা হয় তখন খালেদা জিয়াকে দলীয় ‘মীর জাফররা’ বুঝিয়ে-শুনিয়ে বঙ্গভবনে নিয়ে গিয়েছিলেন রাষ্ট্রপতির সঙ্গে ‘লোক দেখানো’ সংলাপে। প্রতিবাদে জ্বলে ওঠার আগেই, তীব্র প্রতিবাদ জানানোর আগেই কেল্লা ফতে। ততক্ষণে গোলাম আযম নাজিমুদ্দিন রোডের যাত্রী। নিরবে দেখে যাওয়া ছাড়া খালেদা জিয়ার আর কিছুই করার নেই!

ওয়ান ইলেভেন বাংলাদেশের রাজনীতিতে উল্ল্যেখযোগ্য এক ঘটনা। পরিবর্তনের আশা জাগানিয়া এক স্বপ্ন ছিলো ওয়ান ইলেভেন। ওয়ান ইলেভেন ব্যর্থ হলেও দলীয় রাজনৈতিক স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদ ছিলো ওয়ান ইলেভেন। সব রাজনৈতিক দল ওয়ান ইলেভেনের শিকার হলেও সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত রাজনৈতিক শক্তি ছিলো বিএনপি। খালেদা জিয়া ও তার পরিবারের সাজানো নির্বাচনের নীল নক্সা ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করা ওয়ান ইলেভেন খালেদার পারিবারিক রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষে এক মোক্ষম আঘাত। বিএনপি’র বেদনার সেই দগদগে ক্ষতে আবারও লবণ ছিটিয়ে দিয়ে ওয়ান ইলেভেনেই গ্রেপ্তার করা হলো গোলাম আযমকে। বেগম জিয়ার রাজনৈতিক ফাইন্যান্সার জামায়াত নিশ্চয় গোলাম আযমকে গ্রেফতারে নিষ্ক্রিয় থাকার জন্যে খালেদাকেই দুষবে। খালেদার  ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক জীবনে ওয়ান ইলেভেন এক বিভীষিকাময় দুঃস্বপ্নই হয়ে থাকবে। ওয়ান ইলেভেন ব্যাটে-বলে-না-হওয়া বিএনপি’র এক সংক্ষিপ্ত রাজনৈতিক ইনিংস।

আওয়ামী নীতি-নির্ধারকদের এই টাইমিং খুবই নিখুঁত। পাশাপাশি সৌভাগ্যক্রমে গোলাম আযমদের ’তীর্থভূমি’ পাকিস্তানের রাজনীতি ও দেশটির সেনাবাহিনীর বর্তমান টালটামাল অবস্হা অনুকুল বাতাবরণ তৈরি করে দিয়েছে। অঘটন পটিয়স পাকি গোয়েন্দা সংস্হা আইএসআই নিজেই আছে ঝামেলায় আছে। আশংকা করা হচ্ছে, যে কোনো মুহূর্তে পাকি জেনারেলরা ‘পাবলিক রাজনীতিবিদদের’ হটিয়ে পুনরায় ইসলামাবাদের ভাগ্যবিধাতা বনে যেতে পারেন।

রাজনীতির কূটনীতির এই রাউন্ডে ধরাশায়ী খালেদা জিয়া ও তাঁর আজ্ঞাবহ পারিবারিক রাজনৈতিক দল বিএনপি কী করে সেটাই দেখার বিষয়। তবে কূটনৈতিক দুনিয়ায় জোর গুজব, জামায়াতের তরুণ নেতারা ‘রাজাকার’ অপবাদ ঘুচিয়ে অনুকুল পরিবেশে রাজনীতি করার স্বার্থে গোলাম আযমসহ কিছু নেতাকে ‘নেকি নিয়তে’ কোরবান দিতেই আগ্রহী। প্যাচ আপের টাইমিংটা নিখুঁত না হলে সব ভেস্তে যাবে কিন্তু!

তবে আম-জনতা কেবল ফাঁসির টাইমিংয়ে আগ্রহী। দিন-ক্ষণ জানতে চাই আগাম। ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে  হলে কেমন হয়? ২৬ মার্চ রাতেই এই নরাধমেরা হিংসা আর পৈশাচিক তাণ্ডবে উন্মত্ত হয়ে উঠেছিলো। একাত্তরের অমানুষ আর পশুতে কোনো তফাৎ দেখি না। আর পশুহত্যা সব সমাজেই জায়েজ।

ইমেলঃ [email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।