ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

মুক্তমত

মান্না-আখতার পরিষদ

আবিদ রহমান, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৪৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৯, ২০১২
মান্না-আখতার পরিষদ

এক
আজকের বাংলাদেশের সামাজিক-বাণিজ্যিক-প্রশাসনিক ক্ষমতায় বা শীর্ষে যারা আছেন তাদের কমবেশী সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন ৭৯-৮১ সালে। কেউ কেউ সরাসরি ছাত্র রাজনীতির সংগে জড়িত ছিলেন।

কেউবা ছিলেন নীরব সমর্থক। দলমত নির্বিশেষে এইসব গুণী মানুষদের কাছে ছাত্র রাজনীতির আইডল ছিলেন ডাকসুতে ছাত্রলীগ জাসদের মাহমুদুর রহমান মান্না , আখতারুজ্জামান ও জিয়াউদ্দিন বাবলু, মুজিববাদী ছাত্রলীগের ওবায়দুল কাদের, বাহলুল মজনুন চুন্নু, খ ম জাহাংগীর ও মহিবুর রহিম বাবুল, ছাত্র ইউনিয়নের কাজী আকরাম ও কামরুল আহসান খান, জাগ ছাত্রদলের শামসুজ্জামান দুদু প্রমূখ। রাকসুতে ছাত্রমৈত্রীর ফজলে হোসেন বাদশা। নিজ গুণ ও যোগ্যতায় উল্লেখিত নেতারা ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত করেছিলেন সহনশীলতা, ভ্রাতৃত্ববোধ ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ। হানাহানি-মারামারির বদলে দেশের শীর্ষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো হয়ে উঠেছিলো সকল দল ও মতের স্বাধীন উৎসারণ। সেই সম্প্রীতির প্রভাবেই তিন ঘনিষ্ট বন্ধু অকালপ্রয়াত রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, কবি কামাল চৌধুরী ও শিক্ষক আলী রীয়াজ তিন দলের ব্যানারে মিলে মিশে একই পদে নির্বাচন করেছিলেন। বন্ধু আলী রীয়াজের বিজয়কে রুদ্র ও কামাল নিজেরই বিজয় ভেবে উল্লসিত হয়েছিলেন। তাদের সেই সম্প্রীতি আজো অটুট। সম্প্রীতির আরেক ধাপে রীয়াজের সাথে একই পদে নির্বাচন করে বিজয়ী হয়েছিলেন ‘মোটা কবি’ জাফর ওয়াজেদ। সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে মানুষ কখনো নিজেকে একক ভাবেন না। মানুষ ‘আমি’র সীমাবদ্ধ গণ্ডিছাড়া ‘আমরা’-তে পরিণত হন। আমাদের সেই প্রজন্মের বেশির ভাগ বন্ধু এখনো সেই শিষ্টাচারের নিবিড় চর্চা করে যাচ্ছেন।

কাজী আকরাম অনেক আগেই অকালপ্রয়াত। হালে আমাদের ছেড়ে গেছেন ‘আমি তোমাদেরই লোক’খ্যাত মহিবুর রহিম। মান্না ও আখতার ডাকসুর ভিপি-জিএস হয়েছিলেন। নির্বাচিত হয়েছিলেন বাবলুও। ছাত্র নেতাদের মধ্যে প্রথম ডিগবাজির নজির সৃষ্টি করেছিলেন বাবলু। মান্না-আখতার দু’জনেই শেষাবধি ’ফিরে গিয়েছিলেন’ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক মহীরুহ আওয়ামী লীগের ছায়ায়। দু’জনেই নিজ যোগ্যতায় পেয়েছিলেন সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব। শুনি সাফল্যের সঙ্গে অর্পিত দায়িত্ব পালন ক’রেছিলেন উভয়েই। আখতার পদে থাকলেও  মান্না এখন দলীয় কোন্দলে নিঃসঙ্গ এক রাজনৈতিক নেতা। কাদের আরো উজ্জ্বল হয়েছেন আওয়ামী রাজনীতিতে। সাধারণ সম্পাদক পদের জন্যে বহুবার আলোচিত হলেও তিনি শেষাবধি প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং মন্ত্রী হয়েছেন। তবে বন্ধু বৎসল নিপাট দুদু জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে খুব একটা সুবিধা করতে পারেন নি। এখন কৃষক দলে পড়ে আছেন। কামরুল আহসান খান স্বেচ্ছায় প্রবাসী। মধ্যিখানে হারিয়ে গেছেন মেধাবী চুন্নু। মান্না-আখতারদের সৃষ্ট সৌহার্দ্যপূর্ণ ছাত্র রাজনীতির পরিবেশকে শেষাবধি যিনি টিকিয়ে রেখেছিলেন তিনি হচ্ছেন স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ছাত্রলীগ থেকে একমাত্র নির্বাচিত ডাকসু ভিপি সুলতান মনসুর। রাজ্জাকের জানাজায় হূদরোগে আক্রান্ত মনসুরের আর কোনো খবর জানা নেই।

দুই
দীর্ঘ ভূমিকা দেবার একটা স্বার্থ আছে।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে আজ সহিষুতার তীব্র অভাব। যোগ্যদের বদলে অযোগ্যদের ভীড়-বাট্টা সর্বত্র। ৭৯-৮১’র ছাত্ররাই আজ বাংলাদেশের ভাগ্য নিয়ন্তা। সচিবেরা সবাই সেই সময়ের। আজো মনে পড়ে সচিব আবু আলম শহীদের, কবি মোহাম্মদ সাদিকের দিল খোলা হাসি। ব্যবসা-বাণিজ্যে আমাদের প্রজন্ম এখন প্রতিষ্ঠিত। শিল্প-সাহিত্যেও জাঁকিয়ে বসেছেন আমাদের প্রজন্ম। সাংবাদিকতায় প্রতিষ্ঠিতরাও একই প্রজন্মের। আমাদের প্রজন্ম একবার পেরেছিলো যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের হতাশাক্রান্ত ছাত্র সমাজকে সুস্হ ও সুষ্ঠু পরিবেশ দিতে। জিয়া ও এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে নিয়মতান্ত্রিক প্রতিবাদে উৎসাহী ও অনুপ্রাণিত করতে। যে যার রাজনৈতিক অবস্হান থেকে সততা ও নিষ্ঠার সাথে অর্পিত দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। গেলো জাতীয়তাবাদী সরকারের এতো দূর্নীতির মধ্যেও দুদু এখনো নিষ্কলংক। চুন্নুতো বেকার ও বন্ধুদের ঘাড়ে চেপে বসা এক শ্বেতহস্তী! আখতার দলীয় পদে থেকেও যেন উধাও যমুনা! এই সফল ও সম্ভাবনাময় মানুষগুলোকে কেন অকর্মণ্য করে রাখা হচ্ছে বুঝি না। যোগ্যতার যেকোনও মানদন্ডে দুদু হতে পারেন  বিএনপি যুগ্ম সম্পাদক। চুন্নু-মনসুর  অনায়াসে আওয়ামী লীগের যুগ্ম কিংবা সাংগঠনিক সম্পাদক। কিন্তু যোগ্য এসব মানুষদের কারা পৃষ্ঠপোষকতা করবেন ? সবাই এখন রাজনীতির ইয়া নফসিতে বিভোর ও আত্মমগ্ন। অন্যকে ল্যাং মেরেই টিকে থাকেন রাজনীতিবিদদের অনেকেই। যোগ্যতা ও সৎ গুনাবলি এখন নেতৃত্বের যোগ্যতার পূর্বশর্ত নয়। এখন কানেকশনই সাফল্যের চাবিকাঠি।
 

বাংলাদেশের রাজনৈতিক-সামজিক জীবনে আবারো চাই সৌহার্দ্য। চাই তাবেদারহীন যোগ্য নেতৃত্ব। দলের অভ্যন্তরীণ কলহে বিএনপি-আওয়ামী লীগ দুটোই পর্যুদস্ত। বিরোধী বিএনপি নেতারা ক্ষমতা পুনর্দখলের দাঁত কামড়ানো জেদে শত বিভেদ সত্ত্বেও পরস্পরকে আঁকড়ে আছেন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে এই বিলাসিতা অনুপস্হিত। তৃণমূল পর্যায়ের সাথে মন্ত্রী-নেতাদের দূরত্ব এখন এক অনতিক্রম্য বাধা। ছাত্রলীগ-যুবলীগ এখন করছে রক্তক্ষরণ। সাংগঠনিক কাঠমোতে কোনো গোছানো ভাব লক্ষ্য করা যায় না। দলীয় কোন্দল কিংবা দলীয় প্রধানের রাজনৈতিক এক্সপেরিমেন্টে তিন তিনটি পৌর নির্বাচনে পরাজিত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মনোবলে নিসন্দেহে চিড় ধরেছে। ভুল প্রার্থী মনোনয়ন ও জনগনের ইচ্ছা-অনিচ্ছা বুঝতে অক্ষম আওয়ামী লীগ নিজেই যেন ডোবার অপেক্ষায় এক বিশাল টাইটানিক। অহংবোধ বাদ দিয়ে দলীয় নেতা-কর্মীদের কথা শুনে মহিউদ্দিন চৌধুরীর মতো স্বেচ্ছাচারের বদলে অন্য কাউকে মনোনয়ন দিলে চাটগাঁ পৌর কর্পোরেশন এখনো আওয়ামীদের পতাকা তলে থাকতো। নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লায় এভাবে রাজনৈতিক বেইজ্জতি হতে হতো না।

রাজধানী ঢাকার কাঙ্ক্ষিত ও প্রত্যাশিত বিভাজনের প্রক্রিয়ায় ঢাকাবাসী ক্ষুব্ধ। সেই জনরোষ আরো চাঙ্গা হচ্ছে আওয়ামী মনোনয়ন প্রত্যাশিতদের নাম-উচ্চারণে। একবার আওয়ামী লীগ ডুবেছিল মোফাজ্জেল হোসেন চৌধুরী মায়ার পুত্র দীপু(দের) কল্যাণে!  এখন দীপুর ভাইর নামও বেশ সরব। পুরো উত্তরা-গুলশান-বারিধারা-মহাখালী-ডিওএইচএস এখন শুনি মায়া-পুত্রদের চাঁদা-আদায়ের অর্থ-ফিল্ড। পুত্রস্নেহে অন্ধ মায়ার নাম উচ্চারিত হচ্ছে উত্তরের মেয়র পদের মনোনয়নে। মায়ার মনোনয়ন নিশ্চিত হওয়া মাত্রই জনগণ মানসিকভাবে আওয়ামী বিরোধী বিএনপি বা তাদের সমর্থক কোনো নেতার হাতে তুলে দেবেন উত্তরের পৌরপিতার পদটি। ইচ্ছা-বিরুদ্ধে হলেও আওয়ামী প্রার্থীকে ভোট দিয়ে কেউই নিত্য চাঁদাবাজির অফিশিয়াল শিকার বনতে চাইবেন না।

দক্ষিণে শোনা যাচ্ছে হানিফ-পুত্র সাঈদ খোকন ও হাজী সেলিমের নাম। আওয়ামী নেতৃত্ব কী অবগত আছেন যে পুরান ঢাকার ডেমোগ্রাফি বদলে গেছে! পুরান ঢাকায় এখন আদিবাসী ঢাকাইয়্যাদের একক কব্জা ও নিয়ন্ত্রণে নেই। নোয়াখালী-বরিশাল-ভোলা-বগুড়া-রংপুরের মানুষেরাও এখন পুরান ঢাকার অন্যতম কন্ঠস্বর। কামরাংগীর চরের বস্তিগুলো এখন ভিন জেলার মানুষের সমষ্টি। মাজেদ সর্দারদের প্রভাব এখন পুরান ঢাকায় কিছুটা ক্ষীণ। সেই বিচারে সাঈদ খোকন ও হাজী সেলিম ঘোড়দৌড়ের সেরা বাজি নন। এখন পুরান ঢাকায় চাই সর্বজনপ্রিয় একজন প্রার্থী। পুরান ঢাকার কানেকশন ধন্য হলে সেই প্রার্থীর ভোট সংখ্যাও বাড়বে বৈকি।        

ডাকসুর আখতারুজ্জামানের আদি নিবাস কালীগঞ্জে হলেও দুই পুরুষ ধরে এই ‘পাঠন’ পদবীর পরিবারের রয়েছে পুরান ঢাকায় বসবাসের রেকর্ড। দীর্ঘদিন র‌্যাকিন স্ট্রিটের বাসিন্দা ছিলেন আখতার। সাংগঠনিক দক্ষতায় আখতার পরীক্ষিত। নির্বাচনের রাজনীতিতেও আখতার বহুবার উত্তীর্ণ। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হবার সুবাদে পুরানো ঢাকা সহ দক্ষিণ ঢাকার প্রতিটি ওয়ার্ড ও মহল্লার তৃণমূল ও নেতৃত্ব দু’টোর সংগেই আখতারের নিবিড় যোগাযোগ থাকার কথা। পুরোনো ঢাকার একজন বাসিন্দার যোগ্যতায় আখতার নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলো জানেন ও বোঝেন।

অন্যদিকে আখতারের সাবেক নেতা মান্না পেতে পারেন উত্তরের পৌর পিতার আওয়ামী মনোনয়ন। সর্বস্তরের মানুষের কাছে মান্নার গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে।
অনলবর্ষী বক্তা, টিভি উপস্হাপক, সৎ ও মার্জিত রাজনীতিক হিসেবে মান্নার পরিচিতি ব্যাপক। মায়ার তুলনায় মান্না কেবল সেরাই নন অবশ্যম্ভাবী এক বিজয়ীর নাম। মান্নার বিরুদ্ধে প্রার্থী দিতে গেলে বিরোধী বিএনপি’কে গলদঘর্ম হতে হবে। মান্না হবেন দলমত নির্বিশেষে সাধারণ মানুষের সেরা চয়েস।

তিন
রাজধানী ঢাকা ক্রমেই বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে। নগরটিকে আধুনিক রাজধানীতে পরিণত করার কোনো কার্যকর পরিকল্পনা ও উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। হয়ও নি। শোনা যায় ২০১৫-র পর এই নগরটিকে নিয়ে কোনো পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা নেই। যানজট, গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটের পাশাপাশি অচিরেই সুয়ারেজ সিস্টেম কলাপস করার আশংকায় আছেন নগর পরিকল্পনাবিদেরা। রাজধানী ঢাকাকে টিকিয়ে রাখতে হলে সমন্বিত দূরদৃষ্টি সম্পন্ন পরিকল্পনা চাই। চাই সৎ ও আন্তরিক নেতৃত্ব। চাই সবার মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে ’আমি ঢাকাবাসী’ মানসিকতার অবসানে ’আমরা ঢাকাবাসী’ মনোবৃত্তি। সবার মধ্যে নাগরিক দায়-দায়িত্ববোধ জাগিয়ে তোলা জরুরি।

সেই বিবেচনায় ডাকসুর সফল মান্না-আখতার পরিষদকে ঢাকার নেতৃত্ব দিলে কেমন হয়? আপনাদের কী অভিমত?

প্রত্যাশা করি ক্ষমতার শেষ দুই বছরে আওয়ামী নেতৃত্ব চিন্তা-ভাবনায় কিঞ্চিৎ প্রসারিত হবেন দলীয় রাজনীতির স্বার্থে।       

ইমেলঃ [email protected]

বাংলাদেশ সময় ১৪৩৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৯, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।