ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

মুক্তমত

শ্রদ্ধার্ঘ্য বাংলাদেশের সংগীতের অলরাউন্ডার আজাদ রহমান

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪১১ ঘণ্টা, মে ২৪, ২০২০
শ্রদ্ধার্ঘ্য বাংলাদেশের সংগীতের অলরাউন্ডার আজাদ রহমান

ঢাকা: ডোরাকাটা দাগ দেখে বাঘ চেনা যায়, বাতাসের বেগ দেখে মেঘ চেনা যায়। মুখ ঢাকা মুখোশের এই দুনিয়ায় মানুষকে কী দেখে চিনবে বল?

এই চিরন্তন কথাকে গানে রূপ দিয়ে সারথি পরিচালিত ‘দস্যু বনহুর’ সিনেমায় নিজেই গানটি গেয়ে মানুষের মুখে মুখে জনপ্রিয়তা এনে দেন সংগীতজ্ঞ-কণ্ঠশিল্পী আজাদ রহমান।  ‘মাসুদ রানা’ সিনেমায় তিনি মনের রঙে বনের ঘুম ভাঙিয়ে সাগর পাহাড়কে দিয়ে কথা বলান।

তার প্রিয়তমা স্ত্রী কণ্ঠশিল্পী সেলিনা আজাদকে দিয়ে এই গান করান।  এই গানটির গীতিকারও তিনি। তরুণ-যুবকরা সিনেমা হলে ড্যাশিং হিরো সোহেল রানার ফাইটিং দেখে কবরীর ঠোঁটে এই গান গাইতে গাইতে ফিরত।   

আজাদ রহমানের গানে এক ধরনের নিজস্বতা রয়েছে। আজাদ রহমান উচ্চাঙ্গ সংগীতের সঙ্গে বাংলা গানের সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন; তবলা, হারমোনিয়ামের সঙ্গে গিটারের সমন্বয় করেছেন দারুণভাবে। তার গানের শিল্পী নির্বাচনে তিনি মুনশিয়ানার পরিচয় দিতেন। যে গান যার গলায় মানাতো তাকে দিয়েই তিনি গাওয়াতেন। তাইতো নিজেই মাসুদ পারভেজ পরিচালিত ‘এপার ওপার’ সিনেমায় গাইলেন ‘ভালবাসার মূল্যে কত’! 

খুরশিদ আলম, সেলিনা আজাদ তার গান গেয়ে বিখ্যাত হন। ‘বন্দি পাখির মতো মনটা কেঁদে মরে’ এই গানটি খুরশীদ আলমের প্রথম চলচ্চিত্রে প্লে-ব্যাক করা। নায়ক সোহেল রানার ক্যারিয়ারের শুরুতে আজাদ রহমানের গানগুলি বেশ জনপ্রিয় হয়। নায়িকা অঞ্জনারও তাই। আজাদ রহমানের সুর করা ‘তুমি শুধু তুমি দূর এলো কাছে ...’ ‘দস্যু বনহুর’ সিনেমার এই গান অঞ্জনার লিপে হিট করে।  

‘আমিতো কেবল বলেই চলি...’ মাহমুদুন্নবী ও শাহনাজ রহমতুল্লাহর গাওয়া গানটি বাবুল চৌধুরী পরিচালিত ‘আগন্তুক’ সিনেমার। আজাদ রহমান ১৯৬৯ সালে বাংলাদেশের (পূর্ব পাকিস্তান) এই ছায়াছবিতেই প্রথম গানে সুর আরোপ করেন। ১৯৬৩ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে আজাদ রহমান শকুন্তলা অবলম্বনে নির্মিত ‘মিস প্রিয়ংবদা’ নামের কলকাতার একটি সিনেমায় সংগীত পরিচালনা করার মধ্যে দিয়ে চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনা শুরু করেন। এই সিনেমায় বিভিন্ন গানে কণ্ঠ দেন মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, আরতি মুখার্জি, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ বিখ্যাত কণ্ঠ শিল্পীরা। এছাড়াও ‘জন্ম আমার ধন্য হলো মাগো’ এই দেশের গানের সুর করেন প্রখ্যাত সুরকার আজাদ রহমান।

বাংলা খেয়ালের জনক আজাদ রহমান প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য ‘গোপন কথা’ নামের একটি সিনেমা নির্মাণ করেছিলেন। পরিবার পরিকল্পনা ও নারী স্বাস্থ্য নিয়ে নির্মিত এই সিনেমায় কেন্দ্রীয় চরিত্রে দেখা যায় সোহেল রানা ও কবরীকে। আজাদ রহমান বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত দুই খণ্ডের সংগীতবিষয়ক পুস্তক ‘বাংলা খেয়াল’ গ্রন্থেরও প্রণেতা। আজাদ রহমান বাংলাদেশের অনেক সিনেমাতেই সংগীত আয়োজনের কাজ সম্পাদন করেছেন। এরমধ্যে ‘মাসুদ রানা, ‘এপার ওপার’, ‘দস্যু বনহুর’, ‘বাদী থেকে বেগম’, ‘গুনাহগার’, ‘যাদুর বাঁশি’, ‘কুয়াশা’, ‘আমার সংসার’, ‘অনন্ত প্রেম’, ‘ডুমুরের ফুল’, ‘মতিমহল’, ‘রাজবাড়ি’, ‘আগুন’, ‘মায়ার বাঁধন’, ‘তুফান’, ‘পাগলা রাজা’, ‘আমার সংসার’, ‘নতুন বউ’, ‘দি ফাদার’, ‘খোকন সোনা’, ‘দেশপ্রেমিক’ উল্লেখযোগ্য।

আজাদ রহমান যদি শুধু নিয়মিত গায়ক হতেন, তবে বাংলাদেশের প্রথম সারির অন্যতম গায়ক হতেন। ‘এপার ওপার’, ‘চাঁদাবাজ’, ‘গুনাহগার’, ‘ডুমুরের ফুল’সহ অন্যান্য সিনেমায় তার গাওয়া গান শুনলেই তা বোঝা যায়। কিন্তু সৃষ্টির নেশা তাকে করেছে সুরকার-সংগীত পরিচালক; বাংলা খেয়ালের প্রবর্তক।

সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠা আজাদ রহমান ১৯৪৪ সালে ১ জানুয়ারি তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বর্ধমান জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তৎকালীন সমাজব্যবস্থা ছিল রক্ষণশীল। তাতে কী? প্রতিকূলতা জয় করে আজাদ রহমান রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে খেয়ালে স্নাতক সম্পন্ন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন তিনি ধূপদী-খেয়াল ছাড়াও টপ্পা গান, কীর্তন, তুমরি’র ও চর্চা করেন। এছাড়াও কাওয়ালি, রবীন্দ্রসংগীত, ফোক গান, পঞ্চকবির গানও শিখেছেন। আজাদ রহমান পিয়ানো বাজানো থেকে শুরু করে সংগীতের সকল শাখায় সমভাবে বিচরণ করেছেন।

পারিবারিক জীবনে তার স্ত্রী সেলিনা আজাদ একজন সংগীতশিল্পী। তার প্রবাসী তিন মেয়ে কেউ গান করেন, কেউবা গান লিখেন আবার কেউ গানের সুরও করেন।

আজাদ রহমান ১৯৭৭ সালে আব্দুল লতিফ বাচ্চু পরিচালিত ‘যাদুর বাঁশী’ সিনেমায় শ্রেষ্ঠ সুরকার হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। এরপর ১৯৯৩ সালে তিনি কাজী হায়াৎ পরিচালিত ‘চাঁদাবাজ’ সিনেমায় শ্রেষ্ঠ সংগীতপরিচালক এবং শ্রেষ্ঠ গায়ক হিসেবেও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। এছাড়াও তার লেখা, সুরারোপিত এবং সংগীত পরিচালনায় গানগুলো দর্শকপ্রিয়তা পায়। তিনি ২০১৬ সালে সংস্কৃতি কেন্দ্র আজীবন সম্মাননা পুরস্কার লাভ করেন। ‘খালা বল চাচী বলো কেউ মায়ের সমান নয়’- মাকে নিয়ে তাঁর সুভাষ দত্ত পরিচালিত ‘ডুমুরের ফুল’ সিনেমার এই গানটিও দর্শকদের মাঝে সমাদৃত হয়।  

কোনো এক অজ্ঞাত কারণে ক্ল্যাসিক সুরকার আজাদ রহমান নব্বইয়ের দশকের মাঝা-মাঝি থেকে আড়ালে চলে যান। এরপর তার কোনো গান আর দর্শক সিনেমায় খুব একটা উপভোগ করতে পারেননি। আজাদ রহমান আমৃত্যু সংগীতের সাধনাই করেছেন। পশ্চিমবঙ্গ থেকে ফিরে আজাদ রহমান শিক্ষকতা করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে, অধ্যক্ষ ছিলেন সরকারি সংগীত কলেজে, মহাপরিচালক ছিলেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির।  

আজাদ রহমান বলতেন, ‘ধানের দেশ গানের দেশ বাংলাদেশ। সংগীত হলো সমুদ্রের মতন; সংগীত দিয়ে, প্রেম দিয়ে মানবতার কাছে যেতে চাই। ’ 

অশোক ঘোষ পরিচালিত ‘তুফান’ সিনেমায় খুরশীদ আলম ও রুনা লায়লা আজাদ রহমানের সুরে গাইলেন ‘হীরার চেয়ে দামী, ফুলের চেয়ে নামী আমার নুরজাহান। আমি বলবো, হীরার চেয়ে দামী, ফুলের চেয়ে নামী আমার আজাদ রহমান। তার বিখ্যাত সেই গানের কথাই বলি আকাশ বিনা চাঁদ হাসিতে না পারে! তেমনি বাংলাদেশের গানের কথা বললেও আজাদ রহমানের কথা চলে আসে।  

সুরকার ও সংগীত পরিচালক আজাদ রহমান। এর বাইরে তিনি গীতিকার ও গায়ক, পরিচালক হিসেবেও সমাদৃত। এত পরিচয়ে সফল অলরাউন্ডার সংগীতজ্ঞ আর আছে কী এই দেশে? শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের এই পণ্ডিত ১৬মে আমাদের ছেড়ে পাড়ি জমান পরপারে। শ্রদ্ধা আজাদ রহমান; তার মৃত্যু অপূরণীয় ক্ষতি এই দেশের সংগীতে।

লেখক: রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিতে কর্মরত
ইমেইল: [email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১৪১০ ঘণ্টা, মে ২৪, ২০২০
জেআইএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।