ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

মুক্তমত

করোনা মোকাবিলায় যেভাবে সফল স্লোভেনিয়া

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯২১ ঘণ্টা, মে ৫, ২০২০
করোনা মোকাবিলায় যেভাবে সফল স্লোভেনিয়া

‘করোনা ভাইরাস’ নিঃসন্দেহে এ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় দুর্যোগের নাম। কোনও ধরনের যুদ্ধ নয়, নয় কোনো সামরিক বা পারমাণবিক অভিযান, অতি ক্ষুদ্র এক ধরনের আলোক আণুবীক্ষণিক বস্তুর কাছে গোটা পৃথিবী অসহায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত বিশ্বের প্রায় ২১২টি দেশে এ প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের প্রমাণ মিলেছে। প্রতিদিন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের হাজারো মানুষ এ প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হচ্ছে, ঝরে যাচ্ছে অসংখ্য প্রাণ। চীনের উহান থেকে শুরু করে পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র নিষ্ঠুর থাবা বসিয়েছে এ প্রাণঘাতী ভাইরাস। 

মধ্য ইউরোপে অবস্থিত ৭,৮২৭.৪ বর্গমাইলের ছোটো দেশ স্লোভেনিয়া। সর্বশেষ ২০১৮ সালের জনগণনা অনুযায়ী দেশটিতে সব মিলিয়ে প্রায় একুশ লাখ লোকের বাস।

সুউচ্চ আল্পস পর্বতমালা, বিভিন্ন ধরনের হৃদ ও স্কি রিসোর্টের জন্য দেশটি পর্যটকদের কাছে এক জনপ্রিয় গন্তব্যস্থল হিসেবে পরিচিত। করোনার ছোবল থেকে নিষ্কৃতি পায়নি ইউরোপের ছোটো ও সুন্দর স্লোভেনিয়া। তবে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ইতালি কিংবা ইউরোপের অন্যান্য দেশ, যেমন- স্পেন, ফ্রান্স, বেলজিয়ামের তুলনায় স্লোভেনিয়াতে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের হার বরাবরই কম। এমনকি মৃত্যুর হার বিবেচনায়ও দেশটি ইউরোপের অন্য যে কোনো দেশ থেকে অনেকটা নিম্ন অবস্থানে। মহামারি করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় দেশটি ইতোমধ্যে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রের কাছে এক রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। তবে দেশটি তেমনভাবে আমাদের দেশের মানুষের কাছে পরিচিত নয়। তাই আমাদের গণমাধ্যমগুলোতে স্লোভেনিয়া নিয়ে সে অর্থে তেমন আলোচনা হয় না বললেই চলে।  

ওয়ার্ল্ডওমিটারে প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী এখন পর্যন্ত স্লোভেনিয়াতে প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হয়েছেন ১,৪৪৫ জন। পাশাপাশি গত চব্বিশ ঘণ্টার ব্যবধানে স্লোভেনিয়াতে প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে আরও একজন মৃত্যুবরণ করেছেন। এ নিয়ে দেশটিতে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ালো ৯৮ এবং এখন পর্যন্ত সুস্থ্য হয়ে বাসায় ফিরেছেন ২৪৪ জন। গত দুই দিনে দেশটিতে নতুন করে আর কেউই এ প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হননি। এ ছোটো পরিসংখ্যানই বলে দেয় করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় কতোটা সফল ইউরোপের ছোটো এ দেশটি।

আজ আমরা জানার চেষ্টা করবো ইতালির প্রতিবেশি রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও কীভাবে স্লোভেনিয়া সফলভাবে এ প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের মোকাবেলা করলো? কেনোই বা ইউরোপ এমনকি পৃথিবীর অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় স্লোভেনিয়াতে সে অর্থে করোনা ভাইরাসের বিস্তৃতি ঘটেনি? এ সকল প্রশ্নেরই আজ উত্তর খুঁজে বের করার চেষ্টা করবো।

প্রথমত সম্পূর্ণ স্লোভেনিয়া ডিসেন্ট্রালাইজড, পৃথিবীর অনেক দেশের ক্ষেত্রে আমরা যেটা লক্ষ্য করি যে দেশটির অভ্যন্তরে বসবাস করা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা একটি নির্দিষ্ট শহর কেন্দ্রিক। হতে পারে সেটি দেশটির রাজধানী শহর, আবার হতে পারে সেটি দেশটির বৃহত্তম কোনও একটি নগরী। উদাহরণস্বরূপ আমরা আমাদের বাংলাদেশের কথা বলতে পারি। প্রায় সতেরো কোটি মানুষের বসবাস আমাদের বাংলাদেশে যাদের মধ্যে দেড় কোটির ওপরে মানুষ বসবাস করে রাজধানী ঢাকায়। আমাদের দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য সেবা থেকে আরম্ভ করে যাবতীয় রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কার্যকলাপ সব কিছুই ঢাকাকে ঘিরে। আমাদের দেশের সচেতন যে সকল নাগরিক রয়েছেন বিশেষ করে আমাদের প্রজন্মের লোকজন যারা সবাই একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর ঢাকাতে এসেই স্থায়ী হতে চায়।  

আবার দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ব্রাজিল। আয়তনে পৃথিবীর পঞ্চম বৃহত্তম এ দেশটির জনসংখ্যা প্রায় তেইশ কোটির মতো। ব্রাসিলিয়া দেশটির রাজধানী হলেও দেশটির মানুষের জীবনযাত্রা অনেকটা সাও পাওলো এবং রিও ডি জেনিরোকে ঘিরে। তাই জনবসতির বিবেচনায় ব্রাজিলের এ দুইটি শহর দেশটির অন্যান্য শহরগুলোর তুলনায় অত্যাধিক ঘনত্ববিশিষ্ট। স্লোভেনিয়ার ক্ষেত্রে বিষয়টি এ রকম নয়, স্লোভেনিয়ার রাজধানী লুবলিয়ানা যা দেশটির বৃহত্তম নগরী। তবে স্লোভেনিয়ার সাধারণ মানুষের জীবন শুধু এ লুবলিয়ানাকেন্দ্রিক নয়। স্লোভেনিয়ার প্রায় সর্বত্র জনবসতির বণ্টন রয়েছে এবং সমগ্র স্লোভেনিয়া সুউচ্চ আল্পস এবং ডিনারাইডস পর্বতমালা দ্বারা আচ্ছাদিত থাকায় স্লোভেনিয়াতে এ জনবসতির বণ্টন অনেকটা ছড়ানো ছিটানো। স্লোভেনিয়ার প্রত্যেকটি মিউনিসিপ্যালিটি স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং খুব বেশি প্রয়োজন না হলে কারও আসলে এক মিউনিসিপ্যালিটি থেকে অন্য মিউনিসিপ্যালিটিতে যাতায়াতের তেমন প্রয়োজন পড়ে না। এমনকি স্লোভেনিয়াতে আমার বসবাস যে এলাকায় সেটি আক্ষরিক অর্থে একটি নিভৃত পল্লী অথচ ছোটো এ এলাকাতেই আমার জীবনের সকল প্রয়োজনীয় চাহিদা ভালোভাবে পূরণ করা সম্ভব।  

করোনা ভাইরসের মহামারি বিস্তার প্রতিরোধে স্লোভেনিয়ার সরকার গত ১৯ মার্চ থেকে সম্পূর্ণ স্লোভেনিয়াকে জরুরি অবস্থায় নিয়ে আসে, যার পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষ অনুমতি ব্যতিরেকে এক মিউনিসিপ্যালিটি থেকে অন্য মিউনিসিপ্যালিটিতে যাতায়ত নিষিদ্ধ করা হলেও ডিসেন্ট্রালাইজড ব্যবস্থার কারণে মানুষের খুব বেশি দেশটির অভ্যন্তরে এক স্থান থেকে অন্যস্থানে বিশেষ করে লুবলিয়ানা, মারিবোর, ছেলইয়ে, ক্রানিয়ের মতো বড় শহরগুলোতে যাতায়াতের তেমন প্রয়োজন পড়েনি।  

স্লোভেনিয়া উত্তর দিক থেকে অস্ট্রিয়া, উত্তর-পূর্বে -হাঙ্গেরি, দক্ষিণ-পূর্বে ক্রোয়েশিয়া, পশ্চিমে ইতালি এবং দক্ষিণে ভূ-মধ্যসাগরের শাখা আড্রিয়াটিক সাগরের সাথে সংযুক্ত। করোনা ভাইরাস পরিস্থিতির কারণে গোটা ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে নাজুক অবস্থানে ছিলো ইতালি আর স্পেন এবং এ হিসেবে ইতালির সীমান্তবর্তী স্লোভেনিয় অংশে করোনা ভাইরাস পরিস্থিতি সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থায় থাকার কথা ছিলো অথচ স্লোভেনিয়ার এ অংশে অর্থাৎ পশ্চিম স্লোভেনিয়াতে দেখা যায় যে দেশটির অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় করোনা ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা সবচেয়ে কম। সমগ্র স্লোভেনিয়াতে যখন করোনা ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা এক হাজার ছুঁই ছুঁই তখনও স্লোভেনিয়ার এ অংশে করোনা ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা পঞ্চাশেরও কম। ইতালিতে করোনা ভাইরাস পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করার সাথে স্লোভেনিয়া সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী আলেস শাবেদার সম্পূর্ণ স্লোভেনিয়াতে সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি করেন।  

ঐতিহাসিকভাবে ইতালি এবং স্লোভেনিয়া বিভিন্নভাবে একে অপরের সাথে সংযুক্ত। স্লোভেনিয়ার রাজধানী লুবলিয়ানা হলেও প্রকৃতপক্ষে ইতালির ত্রিয়েস্তে ছিলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্ববর্তী সময় পর্যন্ত সবচেয়ে বড় শহর যেখানে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক স্লোভেনিয়ান জাতিগোষ্ঠীর মানুষের বসবাস ছিলো। এছাড়াও স্লোভেনিয়া এবং ক্রোয়েশিয়ার আড্রিয়াটিক সাগরের উপকূলবর্তী এলাকা যেমন- কপার, ইজোলা, পোর্তোরস কিংবা ক্রোয়েশিয়ার পুলা অথবা পরেচ এ সকল জায়গায় প্রচুর ইতালিয়ানদের বসবাস রয়েছে। এমনকি এ সকল জায়গায় যারা স্থায়ী হন তাদেরকে স্লোভেনিয়ান অথবা ক্রোয়েশিয়ান এবং ইতালিয়ান দুইটি ভাষায় দক্ষ হতে হয় এবং এ সকল জায়গার শিক্ষা-প্ৰতিষ্ঠানগুলোও উভয় ভাষায় পাঠদান করে থাকে। এছাড়াও সাগরের তীরবর্তী এলাকায় অবস্থিত হওয়ায় এ অঞ্চলগুলোতে সব সময় জনসমাগম থাকে কিন্তু ইতালিতে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করতে না করতে স্লোভেনিয়ার সরকারের পক্ষ থেকে সর্বপ্রথম এ অঞ্চলগুলোতে মানুষের অবাধ বিচরণ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে কঠোর পদক্ষেপ ঘোষণা করা হয়। এমনকি সাগরের তীরবর্তী অঞ্চলে মানুষের জমায়েতকে কমিয়ে আনার জন্য স্পেশাল পুলিশ ফোর্স মোতায়ন করা হয়। পাশাপাশি ইউনিভার্সিটি অব প্রিমোরস্কাসহ এ সকল জায়গার সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাময়িকভাবে ছুটি ঘোষণা করা হয়।  

গত চার মার্চ স্লোভেনিয়াতে সর্বপ্রথম করোনা ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত রোগী শনাক্ত করা হয়। আক্রান্ত ব্যক্তি মরক্কো থেকে ইতালি হয়ে স্লোভেনিয়াতে প্রবেশ করেছিলেন। স্কি স্লোভেনিয়ার একটি জনপ্রিয় খেলা এবং স্লোভেনিয়ার বেশির ভাগ মানুষ স্কির প্রতি আসক্ত। স্থানীয় বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে বলা হয় স্লোভেনিয়াতে সংক্রমণের প্রাথমিক পর্যায়ে যাদের শরীরে কোভিড-১৯ পজিটিভ ধরা পড়ে তাদের একটি বড় অংশ পজিটিভ ধরা পড়ার কয়েক দিন্ আগে ইতালিতে গিয়েছিলো স্কি খেলার জন্য। যেহেতু স্লোভেনিয়াতে করোনা ভাইরাসের অনুপ্রবেশ ঘটে ইতালির মাধ্যমে এবং একই সাথে ইতালিতে যখন করোনার ছোবল সবচেয়ে তীব্র পর্যায়ে ঠিক তখনই স্লোভেনিয়ার সরকার ইতালির সাথে স্লোভেনিয়ার সীমান্ত সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ইতালি থেকে যারা যারা স্লোভেনিয়াতে প্রবেশ করেন সবাইকে মেডিকেল চেক আপের আওতায় আনা এবং তাদেরকে আইসোলেশনে রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পরবর্তীতে অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি, ক্রোয়েশিয়াসহ অন্যান্য সীমান্তবর্তী অঞ্চলের ক্ষেত্রেও একই পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।  

মার্চের ১৯ তারিখ থেকে স্লোভেনিয়াতে বাস, ট্রেনসহ সকল ধরণের পাবলিক ট্রান্সপোর্ট পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং একই সাথে রাজধানী লুবলিয়ানাতে অবস্থিত দেশটির একমাত্র বিমানবন্দর ইয়োজে পুচনিক ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকেও সকল ফ্লাইট স্থগিত করে দেওয়া হয় যা আজও কার্যকর রয়েছে। এমনকি বিভিন্ন ধরণের কার রাইড শেয়ারিং সার্ভিসও সাময়িকভাবে স্থগিত রাখা হয়েছে। ট্যাক্সিচালকদের বলা হয়েছে প্রত্যেকবার যাত্রী বহনের শেষে তাদের ট্যাক্সিগুলোকে নিয়মিতভাবে পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত রাখতে যাতে করোনা ভাইরাসের বিস্তার অনেকটা রোধ করা যায়।

স্লোভেনিয়াতে প্রথম করোনা ভাইরাস রোগী শনাক্ত হওয়ার দুই সপ্তাহের মধ্যে সম্পূর্ণ স্লোভেনিয়াকে জরুরি অবস্থার মধ্যে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং তখনও স্লোভেনিয়াতে করোনা ভাইরাস পরিস্থিতি জটিল পর্যায়ে পৌঁছায় নি। ছোটো বাচ্চাদের করোনা ভাইরাসে সংক্রমণের ঝুঁকি প্রবল থাকায় সবার প্রথমে বাচ্চাদের স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং পর্যায়ক্রমে ইউনিভার্সিটিসহ সকল শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানও বন্ধ ঘোষণা করা হয়। সকল ধরণের গণজমায়েত নিষিদ্ধ করা হয় এবং স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে সবাইকে মোবাইলে ম্যাসেজের মাধ্যমে জানানো হয় যে কোনও পাবলিক প্লেসে যাতায়াতের ক্ষেত্রে সবাইকে মুখে মাস্ক ও হাতে হ্যান্ড গ্লাভস পরিধান করতে হবে। পারস্পরিক ১.৫ মিটারের এর দূরত্ব বজায় রাখতে সবাইকে নির্দেশ দেওয়া হয়। কেউ যদি তাদের এ নির্দেশনা লঙ্ঘন করে তাহলে তাকে ন্যূনতম ৪০০ ইউরো জরিমানা করার কথা বলা হয় স্লোভেনিয়ার পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে। লুবলিয়ানা, মারিবোর, ক্রানিয়ে, ছেলইয়ের মতো বড় শহরগুলোতে পুলিশ প্রশাসনকে যতোটা সম্ভব কড়া অবস্থানে থাকতে দেখা গিয়েছে যাতে এ সকল শহরে বসবাসরত জনসাধারণ এ নির্দেশনা যথাযথভাবে মেনে চলতে পারে।

স্লোভেনিয়ার সরকার তো বটেই এমনকি দেশটির সাধারণ মানুষের মধ্যেও সচেতনতা ছিলো চোখে পড়ার মতো। ব্যাংক, পোস্ট অফিস, সুপার শপ, খাবারের দোকান, পেট্রোল স্টেশন, হাসপাতাল, ফার্মেসি অর্থাৎ নিত্য প্রয়োজনীয় সেবামূলক যে সকল প্রতিষ্ঠান এ অবস্থার মধ্যেও কাজ করে গিয়েছে সকল প্রতিষ্ঠানে এক সাথে একজন কিংবা একই পরিবারের সদস্য ছাড়া অন্য কাউকে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়নি। প্রথম দিকে অবশ্য মুখে মাস্ক এবং হাতে হ্যান্ড গ্লাভস পরিধান না করা থাকলে কাউকে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হতো না। কয়েক দিন্ পূর্বে হ্যান্ড গ্লাভসের বাধ্যবাধকতা শিথিল করে নেওয়া হলেও প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানের সামনে হ্যান্ড স্যানিটাইজার রাখা হয়েছে এবং এখন থেকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত সবাইকে এ সকল প্রতিষ্ঠানের ভেতর প্রবেশ করতে হলে সবার প্রথমে হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার করতে হবে বাধ্যতামূলকভাবে।

করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও যে সকল ফ্যাক্টরি তাদের কার্যক্রম পরিচালিত করেছে, তাদেরকে স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্বের সাথে বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে স্লোভেনিয়া সরকারের প্রশাসনের পক্ষ থেকে। প্রত্যেকটি ফ্যাক্টরিতে থার্মাল স্ক্যানারের ব্যবস্থা ছিলো যাতে নিয়মিত ফ্যাক্টরির অধীনে কাজ করা সবাইকে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরীক্ষার আওতায় নিয়ে আসা যায়। এছাড়াও স্লোভেনিয়ার সরকারের পক্ষ থেকে স্পেশ্যাল হট লাইন চালু করা হয়। কেউ শরীরে ব্যথা, সর্দি, কাশি, জ্বরসহ কোভিড-১৯ এর সাথে সম্পর্কিত কোনও উপসর্গের সম্মুখীন হলে তাকে তৎক্ষণাৎ ১১২, ০৮০১৪০৪ এবং +৩৮৬৩১৬৪৬৬১৭ এ  তিনটি নাম্বারের যে কোনও একটিতে ফোন দিতে বলা হয়। প্রত্যেক মিউনিসিপ্যালিটি এলাকায় ১১২ এ বিশেষ নাম্বারের লোগো সম্বলিত বিশেষ গাড়ি টহলে নিয়োজিত ছিলো যা এখনও তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। কেউ যদি মনে করেন যে তার শরীরে কোভিড-১৯ এর কোনও লক্ষণ প্রকাশ পেয়েছে তাকে নিকটস্থ হাসপাতালে ততক্ষণাৎ স্থানান্তর করার জন্য সব সময় ১১২ এ বিশেষ নাম্বারের লোগো সম্বলিত বিশেষ গাড়িটি কাজ করছে।  

আগের থেকে সতর্কতা গ্রহণ করায় স্লোভেনিয়াতে করোনা ভাইরাসে মৃত্যুর হার তুলনামূলক কম। ০৪ মে,২০২০ পর্যন্ত স্লোভেনিয়াতে করোনা ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হয়েছেন ১৪৩৯ জন এবং মৃত্যুবরণ করেছেন ৯৭ জন। যারা মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের বেশির ভাগেরই বয়স ৬৭ এর ওপর এবং তাদের অনেকের ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, অ্যাজমাসহ অন্যান্য শারীরিক জটিলতা ছিলো বলে স্লোভেনিয়ার বিভিন্ন গণমাধ্যমসূত্রে জানা গিয়েছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গিয়েছে স্লোভেনিয়াতে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর ২৪.১ শতাংশের বয়স ১৫ থেকে ২৯ এর মধ্যে। এছাড়াও স্লোভেনিয়ার সরকারের ঘোষিত আর্থিক বিভিন্ন পদক্ষেপ দেশটির সাধারণ মানুষের মাঝে বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছে। কৃষক এবং স্লোভেনিয়াতে যারা পেনশনভোগী তাদের জন্য এ সময় স্লোভেনিয়া সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদেরকে মাসে ১৫০ ইউরো করে অনুদানের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে এবং এ পরিস্থিতির কারণে সাময়িকভাবে যাদের কাজ নেই তাদেরকে বেতনের ৮০% করে দিতে বলা হয়েছে স্লোভেনিয়া সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে। তবে একটি বিষয়ে অস্পষ্টতা রয়ে গিয়েছে আর সেটি হচ্ছে স্লোভেনিয়াতে যে সকল বিদেশি নাগরিক রয়েছেন তাদের ক্ষেত্রে স্লোভেনিয়া সরকারের ঘোষিত সুস্পষ্ট কোনও নীতিমালা এখন পর্যন্ত চোখে পড়েনি।  

করোনা ভাইরাসের চিকিৎসায় বর্তমানে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে স্টেম সেল থেরাপি কিংবা প্ল্যাজমা থেরাপির কথা বলা হচ্ছে। স্টেম সেল নামক এক বিশেষ ধরণের কোষ রয়েছে যারা আমাদের শরীরের প্রতিরক্ষায় বিশেষ ভূমিকা পালন করে, স্টেম সেলকে মেমোরি সেল হিসেবেও আখ্যা দেওয়া হয়। আমরা যখন কোনো রোগ জীবাণুর সংক্রমণ থেকে সুস্থ্য হয়ে উঠি পরবর্তীতে যখন ঐ একই ধরণের রোগ জীবাণু আমাদের শরীরে আক্রমণের চেষ্টা করে স্টেম সেল সেগুলোকে পূর্বের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে শনাক্ত করার চেষ্টা করে এবং এ সকল রোগ জীবাণুকে ধ্বংস করে ফেলে। বর্তমানে করোনা ভাইরাসের চিকিৎসায় আলোচিত এ স্টেম সেল থেরাপি যেখানে বলা হচ্ছে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে সাম্প্রতিক সময়ে সুস্থ্য হয়েছেন এমন কোনও ব্যক্তির প্লাজমা বা রক্তরস আক্রান্ত অন্য কোনও ব্যক্তির শরীরে প্রতিস্থাপনের মধ্য দিয়ে সে ব্যক্তিকে সুস্থ্য করে তোলা সম্ভব। করোনা ভাইরাসের চিকিৎসায় স্টেম সেল থেরাপি নিয়ে যে সকল ইনস্টিটিউট গবেষণা করেছে তার মধ্যে স্লোভেনিয়ার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পাবলিক হেলথের ডিপার্টমেন্ট অব ইমিউনোলজি এবং ডিপার্টমেন্ট অব ভাইরোলজি অন্যতম, যাদের সমন্বিত গবেষণালব্ধ ফলাফল যা পৃথিবীর অনেক দেশই অনুসরণ করার চেষ্টা করছে। এছাড়া স্লোভেনিয়ার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পাবলিক হেলথও করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে কার্যকরী ভ্যাকসিন উদ্ভাবন প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এবং ইতোমধ্যে তাদের প্রস্তুত করা ভ্যাকসিনের নমুনা পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগ করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

করোনা ভাইরাস পরিস্থিতি দেশটিতে এখন অনেকটা উন্নতির দিকে, কেননা গত দুই দিন নতুন করে কেউই এ ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হন নি। প্রতিবেশি রাষ্ট্র অস্ট্রিয়ার মতো ধীরে ধীরে স্লোভেনিয়াতেও মার্চ মাসের ১৯ তারিখ থেকে জারি করা জরুরি অবস্থা তুলে নেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে এতো দিন্ বিশেষ অনুমতি ব্যতিরেকে স্লোভেনিয়ার অভ্যন্তরে এক মিউনিসিপ্যালিটি থেকে অন্য মিউনিসিপ্যালিটিতে যাতায়াতের ব্যাপারে যে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিলো গত বৃহস্পতিবার থেকে তা শিথিল করা হয়েছে।  

পাশাপাশি সোমবার (০৪ মে, ২০২০) থেকে নির্দিষ্ট শর্তসাপেক্ষে কফিশপ, বার এবং রেস্টুরেন্টগুলোকে খোলা রাখার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া গত ২৯ এপ্রিল থেকে বিভিন্ন মিউজিয়াম, আর্ট গ্যালারি, থিয়েটার, লাইব্রেরিগুলোকেও পুনরায় চালু করে দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।

স্কুল, কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুলে দেওয়ার ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। তবে স্থানীয় বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে জানা গিয়েছে যে এই সপ্তাহের মধ্যে স্কুল, কলেজ, কিন্ডারগার্টেনসহ বিভিন্ন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়ন করা কতিপয় শিক্ষার্থীদের থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হবে এবং তাদেরকে কোভিড-১৯ টেস্টের আওতায় আনা হবে। যদি সন্তোষজনক ফলাফল পাওয়া যায় তাহলে এ মাসের মাঝামাঝি সময়ে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়া হতে পারে। এছাড়াও পরিস্থিতি এ রকম স্থিতিশীল থাকলে মে মাসের শেষের দিকে যথাসময়ে স্টেস্ট মাতুরা এক্সাম অনুষ্ঠিত হবে। স্টেট মাতুরা এক্সামকে আমাদের দেশের মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষার সাথে তুলনা করা যেতে পারে। তবে কবে নাগাদ বাস কিংবা ট্রেনসহ গণপরিবহন সেবা আবার সচল করে দেওয়া হবে সে ব্যাপারে স্লোভেনিয়ার সরকারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কিছু জানানো হয় নি। এছাড়াও পরবর্তী ঘোষণা না আসা পর্যন্ত স্লোভেনিয়ার রাজধানী লুবলিয়ানাতে অবস্থিত দেশটির একমাত্র বিমানবন্দর ইয়োজে পুচনিক ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকেও সকল ধরণের ফ্লাইটের চলাচল বন্ধ থাকবে।

অপেক্ষাকৃতভাবে নতুন একটি রাষ্ট্র স্লোভেনিয়া কেননা দেশটি ১৯৯১ সালে যুগোস্লাভিয়া ফেডারেশন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। প্রতিবেশি রাষ্ট্র ইতালি কিংবা অস্ট্রিয়া অথবা পশ্চিম ইউরোপের দেশ যেমনঃ জার্মানি, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডসের তুলনায় অর্থনৈতিকভাবে বেশ পিছিয়ে স্লোভেনিয়া।  

বেশির ভাগ ক্ষেত্রে একজন কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত কোনও রোগীর মৃত্যু ঘটে যখন তার স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণে বিঘ্ন ঘটে আর এ কারণে তার স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাসকে ফিরিয়ে আনতে ভ্যান্টিলেশনের প্রয়োজন হয়। জনসংখ্যা অনুপাতে দেশটিতে ভ্যান্টিলেশনও নেই খুব বেশি। বিশেষ করে জার্মানি, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া, সুইজারল্যান্ড, ইতালি এ সকল দেশের তুলনায় স্লোভেনিয়াতে ভ্যান্টিলেশনের সংখ্যা একেবারে নগন্য। শুধুমাত্র সরকারের উদ্যোগ, দেশটির সাধারণ মানুষের সচেতনতা, মানসিক দৃঢ়তা ও ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের বিপক্ষে দেশটিকে জয়ী করেছে।

আপাতদৃষ্টিতে স্লোভেনিয়াতে সব স্বাভাবিক অবস্থায় যাচ্ছে বলে দেশটির স্থানীয় অধিবাসীদের অনেকে মনে করছেন। তবে স্লোভেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী ইয়ানেজ ইনশার গত বৃহস্পতিবার এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেছেন, শিগগিরই সব কিছু স্বাভাবিক অবস্থানে ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই। পাশাপাশি তিনি সবাইকে যথাসম্ভব সতর্ক থাকার আহবান জানিয়েছেন এবং তিনি দাবি করেছেন যে কোনও মুহূর্তে চেহারা পরিবর্তন করে গত শতাব্দীতে মহামারি আকারে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়া স্প্যানিশ ফ্লু ভাইরাসের মতো দ্বিতীয় ধাপে যে কোনও সময় আবার এ ভাইরাসটি ফিরে আসতে পারে, যদি পরিস্থিতি ভালো হয়ে যাওয়ার পরও আমরা যথার্থ সতর্কতা অবলম্বন না করি।

লেখক: শিক্ষার্থী। ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়া
[email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।