ঢাকা, শনিবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

মুক্তমত

এই যে পেটাচ্ছেন, কোন আইনে?

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৪৯ ঘণ্টা, মার্চ ২৯, ২০২০
এই যে পেটাচ্ছেন, কোন আইনে?

করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে নাগরিকদের ঘরে থাকার বিকল্প নেই। সে কারণে সরকারের পক্ষ থেকে উপযুক্ত পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে। সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে একরকম অঘোষিত ‘লকডাউন’ পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে দেশজুড়ে। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে প্রয়োজনে ঘর ছেড়ে যারা বের হচ্ছেন, তাদের অনেকের সঙ্গেই অমানবিক ও অবমাননাকর অন্যায় আচরণ করছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যারা। তাদের কেউ কেউ নীরিহ মানুষের ওপর লাঠি চালাতেও দ্বিধা করছেন না।

করোনা পরিস্থিতিতে সবাইকে ঘরে থাকতে বলা হলেও অনেকেই সরকারের সেই নির্দেশনা ‘মানছেন না’; কথা সত্য। কারণে তো বটেই কিন্তু অকারণেও অনেকে ঘর থেকে বের হচ্ছেন।

অকারণে বের হওয়াদের ‘শায়েস্তা’ করতে গিয়েই বাধে বিপত্তি। চিকিৎসক, ফোনের ব্যালেন্স রিচার্জের দোকানদারসহ অতি প্রয়োজনীয় বিভিন্ন সেবা খাতের সঙ্গে যারা জড়িত তারাও রেহাই পাচ্ছেন না পুলিশের লাঠিপেটা থেকে।

গত দুদিনে দেখা গেছে, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় রাস্তায় বের হওয়া সাধারণ মানুষকে লাঠিপেটা করছে পুলিশ। সেসব ঘটনার ভিডিওচিত্র ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। মূল ধারার গণমাধ্যমগুলোও এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করেছে।

আইনকানুনের তোয়াক্কা না করে আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছেন আইনের রক্ষকেরা। সবাইকে ঘরে রাখতে তাদের এই ‘দায়িত্বের’ আগ্রাসন থেকে বাদ যাচ্ছেন না খেটে খাওয়া নিম্ন আয়ের মানুষেরাও।

সম্প্রতি দেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের জেলা যশোরের মনিরামপুর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) সাইয়েমা হাসানের কাণ্ড ক্ষুব্ধ করেছে গোটা দেশকে। নাড়িয়ে দিয়েছে বিবেকবান প্রতিটি মানুষের বিবেককে। উনি অবশ্য পেটানোর মতো নিষ্ঠুর কাজ করেননি। অনেক ‘নরম শাস্তি’ দিয়েছেন দেশের তিন প্রবীণ নাগরিককে। কানে ধরিয়েছেন তাদের। কেউ কেউ বলছেন তাদের নাকি কানে ধরে উঠবোসও করানো হয়েছে। অবশ্য দেশের বিভিন্ন স্থানে অনেককেই এই ‘কোমল শাস্তি’ দিয়েছেন আইন রক্ষার মহান ব্রত পালনকারীরা।

আইনি ব্যাখ্যা বলছে, একটি কর্মকাণ্ড তখনই ‘অপরাধ’ যখন তা আইন দ্বারা অপরাধ বলে ঘোষিত। একই সঙ্গে সেই অপরাধের শাস্তি কি হবে আর সেই শাস্তি কিভাবে অপরাধীকে দেওয়া হবে সেই বিষয়েও আইনে বিস্তারিত উল্লেখ থাকবে। তাহলে এই লাঠিপেটা আর কানে ধরে উঠবোস করানো কোন আইনে আছে?

শাস্তির আগে দেখে নেওয়া যাক অপরাধের সংজ্ঞা। খুব সহজ করে বললে ঘর থেকে বের হওয়া নিষেধ হতে পারে যদি সরাসরি কারফিউ জারি করা হয়। বলে রাখা ভালো, ১৪৪ ধারা (দণ্ডবিধি,১৮৬০) মানেই কিন্তু চলাফেরায় নিষেধাজ্ঞা নয় বা ঘরে বসে থাকার আদেশ নয়। তর্কের খাতিরে সেটিও না হয় ধরে নিলাম। কিন্তু দেশে বা দেশের কোথাও কি এই ধারার বলবতে কোনো নির্দেশনা জারি করা হয়েছে? তাহলে ঘর থেকে কেউ বের হলে সেটি অপরাধ কীভাবে? আর যদি অপরাধ না হয়, তাহলে তার শাস্তি কীভাবে হয়? ঘরে থাকার পরামর্শ দেওয়া এবং ঘরে থাকার আদেশ দেওয়া কি এক কথা? আপনাকে একটা কাজ করে দিতে অনুরোধ করা আর আদেশ দেওয়া- এই দুটো বিষয় কি এক মহাশয়?

বরং একটু বড় আইনের দিকে খেয়াল করে দেখি। সংবিধান বলছে, জনস্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ- সাপেক্ষে বাংলাদেশের সর্বত্র অবাধ চলাফেরা, ইহার যে কোনো স্থানে বসবাস ও বসতিস্থাপন এবং বাংলাদেশ ত্যাগ ও বাংলাদেশে পুনঃপ্রবেশ করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে (অনুচ্ছেদ-৩৬)। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, দেশে করোনা পরিস্থিতিতে চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে কোন আইন বা বিধিনিষেধ বলবত করা হয়েছে? নাকি জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে? তাহলে একজন নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার হরণের ক্ষমতা সেই ক্যাডার আর তাদের পোষ্যদের কে দিল? সংবিধানের ১৪১ অনুচ্ছেদে জরুরি অবস্থা জারির ঘোষণা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সেই ঘোষণা কি দেওয়া হয়েছে?

আরও একবার তর্কের খাতির মেনে নিলাম যে এই ঘর থেকে বের হওয়া অপরাধ। তাহলে এভাবে পেটাতে হবে, কান ধরে উঠবোস করাতে হবে এমন শাস্তির বিধান কোথায় আছে? আর সেই শাস্তি মাঠ পর্যায়ের হর্তাকর্তারাই দেবেন, সেটিই বা কোন আইনে আছে? তাহলে দেশে আদালতের দরকার কী? সব পুলিশ আর ম্যাজিস্ট্রেটদের লাঠি ধরিয়ে দিলেই তো হয়!

আবারও একটু দেখি শাস্তির বিষয়ে সংবিধান কী বলছে। অনুচ্ছেদ ৩৫ (১) এ বলা হয়েছে, অপরাধের দায়যুক্ত কার্য সংঘটনকালে বলবৎ ছিল, এইরূপ আইন ভঙ্গ করিবার অপরাধ ব্যতীত কোনো ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করা যাইবে না এবং অপরাধ-সংঘটনকালে বলবৎ সেই আইনবলে যে দণ্ড দেওয়া যাইতে পারিত, তাহাকে তাহার অধিক বা তাহা হইতে ভিন্ন দণ্ড দেওয়া যাইবে না। অর্থ্যাৎ অঘোষিত লকডডাউন অবস্থায় ঘর থেকে বের হওয়াকে আগে থেকে ‘অপরাধ’ হিসেবে ঘোষণা করতে হবে। এই অপরাধের আলোকে শাস্তির বিধান করতে হবে। আর এসবই আইন প্রণয়ণের মাধ্যমে করতে হবে।

তবে শাস্তির ধরনেও কথা থেকে যায়, একই অনুচ্ছেদের উপ-অনুচ্ছেদ ৫ এ বলা আছে, কোনো ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাইবে না কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেওয়া যাইবে না কিংবা কাহারও সহিত অনুরূপ ব্যবহার করা যাইবে না। অর্থ্যাৎ কোনো ব্যক্তিকে লাঞ্ছনাকর শাস্তি দেওয়া যাবে না। তাহলে এই যে, আমাদের শিক্ষিত বিসিএস ক্যাডারগণ, দেশের মেধাবী সন্তানেরা কোন আইনের আলোকে নাগরিকদের লাঞ্ছনাকর শাস্তি দিচ্ছেন। সেই শাস্তি আবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করছেন? তাদের উদ্দেশে বলি কি, মৃত্যুদণ্ডের শাস্তিও গোপনে দেওয়া হয়। আর এমন শাস্তি আপনারা প্রকাশ্যে দিচ্ছেন এবং তা ছড়িয়েও দিচ্ছেন!

আইন বিষয়ে অধ্যয়ন করার সময়কার দুইটা ছবক বলে শেষ করছি। প্রিন্সিপালস অব ন্যাচারাল জাস্টিস বলে এক আজগুবি (!) বিষয় শেখানো হয়েছিল আমাদের। আজগুবি কেন বলছি সেটা একটু পরেই বুঝবেন যখন দেখবেন আইনের এই ছবক বাস্তবে মানা হয় না। এই প্রিন্সিপাল বলছে, ন্যাচারাল জাস্টিসের দুটি নিয়ম আছে।

এক. যিনি একটি বিবাদমান বিষয়ের পক্ষ তিনি নিজেই বিচারক হতে পারবেন না। একটু বুঝিয়ে বলি। যিনি ঘর থেকে বের হচ্ছেন আর যাকে ঘর থেকে বের হওয়া ঠেকাতে রাখা হয়েছে তারা এই ‘ঘর’ থেকে বের হওয়া বিষয়ক বিবাদের দুই পক্ষ। তাহলে ন্যাচারাল জাস্টিসের প্রথম আইন বলছে- পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেট বা সামরিক বাহিনীর কেউ নিজেই বিচারক সেজে শাস্তি দিয়ে দিতে পারেন না। ঘর থেকে বের হওয়া যদি অপরাধও হয় তাহলে অভিযুক্তকে আদালতের মাধ্যমে তৃতীয় পক্ষ বিচারকের সামনে হাজির করে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।

দুই. অপর পক্ষকে অবশ্যই তার বক্তব্য পেশ করার সুযোগ দিতে হবে। অর্থ্যাৎ এই যে, হুটহাট আপনি পেটান, কান ধরান এসব চলবে না। যিনি ঘর থেকে বের হচ্ছেন, তিনি যদি সম্ভাব্য অপরাধের জন্য অভিযুক্তও হন, তাকে তার বক্তব্য পেশ করার, নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার সুযোগ দিতে হবে। আর ঠিক এই জায়গাতেই রাষ্ট্রযন্ত্রের এই স্ক্রু-নাট-বল্টু চুপ থাকবেন, কারণ যারা বাসাবাড়ি থেকে বের হচ্ছেন তাদের অধিকাংশই যৌক্তিক এবং প্রয়োজনীয় কারণেই বের হয়েছেন। জীবিকার তাগিদে বের হয়েছেন। যার ঘরে আজ খাবার নেই তাকে অর্থ উপার্জনের সন্ধানে যেতেই হবে। যার অর্থ আছে তাকে খাবার কিনতে বাইরে যেতেই হবে।

আপনি তো রাষ্ট্র, আপনি তো নাগরিকদের বাসায় খাবার দিয়ে আসার দায়িত্বটা পালন করতে পারলেন না। সংবিধানের ১৫ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, এটা তো রাষ্ট্রের দায়িত্ব ছিল দেশের প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা, যার মধ্যে খাবারও একটি। স্বাধীনতার ৪৯ বছরে এসেও সেই দায়িত্ব তো রাষ্ট্র আপনি পালন করতে পারলেন না, এসেছেন নিরীহ মানুষদের পেটাতে।

কথায় কথায় আমরা ইউরোপ-আমেরিকা, মালয়েশিয়া, সুইজারল্যান্ড হয়ে যাওয়ার গালগপ্প শুনি। করোনা পরিস্থিতিতে তাদের লকডডাউন পলিসি কী আর আমাদের কী? এসব দেশে রাষ্ট্রযন্ত্র নাগরিকদের সব ধরনের চাহিদার জোগান দিচ্ছে। তাদের যেন ঘর থেকে বের হতে না হয় সেজন্য সব ব্যবস্থা করা হচ্ছে। কিন্তু আমাদের এখানে ছোট্ট টোলারবাগের ৪০০ পরিবারের খাবারের দায়িত্ব রাষ্ট্র নিয়েছে, এমন খবর এখনও পাইনি।

‘একটি তুলসি গাছের কাহিনী’ গল্পে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ লিখেছেন, ‘হাতে বন্দুক থাকলে নিরীহ মানুষেরও দৃষ্টি পড়ে পশু-পক্ষীর দিকে’। বিস্ময়কর অর্থনৈতিক সাফল্যের এই রাষ্ট্র নিম্ন আয়ের মানুষদের কয়েকদিনের খাবারের দায়িত্ব নিতে না পারলেও ক্ষুধার্ত নাগরিকদের বেধড়ক পেটাতে পারে, লাঞ্ছিত করতে পারে। এই রাষ্ট্রে তাদের হাতে বন্দুকের বদলে আছে লাঠি। আর ২০৬ খানা হাড় নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাণীগুলো মানুষ না; পশু পক্ষী।

যদি এরপরেও পেটানোর খুব শখ জাগে আপনার, হাত যদি নিশপিশ করে, শাস্তি যদি দিতেই হয় তাহলে আগে প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা করুন। তারপরেও কেউ না শুনলে করলেন না হয় একটু ‘বেত্রাঘাত’!

বাংলাদেশ সময়: ২১৪৯ ঘণ্টা, মার্চ ২৯, ২০২০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।