ঢাকা, শনিবার, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

ফেনী ইউনিভার্সিটি দিবস:নস্টালজিক ১৫ মে ও গৌরবের অর্ধযুগ

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪১৫ ঘণ্টা, মে ১৫, ২০১৯
ফেনী ইউনিভার্সিটি দিবস:নস্টালজিক ১৫ মে ও গৌরবের অর্ধযুগ ফেনী ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাস, ইনসেটে লেখকের ছবি।

ঢাকা: ২০১৩ সালের বুধবার (১৫ মে) ফেনী ইউনিভার্সিটির একাডেমিক কার্যক্রমের প্রথম দিন। ইউনিভার্সিটির তখনকার বইবিহীন কেন্দ্রীয় পাঠাগারে সামার সেমিস্টার-২০১৩ এর ওরিয়েন্টশন প্রোগ্রামের মাধ্যমে কার্যক্রম শুরু।

প্রথম ব্যাচের প্রায় ৫৪ জন শিক্ষার্থীর উপস্থিতিতে তৎকালীন উপাচার্য প্রফেসর ড. মো. ফসিউল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওরিয়েন্টেশন প্রোগ্রামে প্রধান অতিথি ছিলেন ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আবদুস সাত্তার, বিশেষ অতিথি ছিলেন ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য আবদুর রইস কাইজার। এছাড়া ছিলেন তৎকালীন ডেপুটি রেজিস্ট্রার ড. মোয়াজ্জেম হোসেন।

কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের মধ্যে ছিলেন সৈয়দ মহিউদ্দিন হায়দার, মো. রেজাউল করিম, জুয়েল হোসেন, আহমেদ সানাউল করিম, আবদুল হান্নান, মামুন মিয়া, আবদুল মান্নান এবং মো. খোকন। শিক্ষকদের মধ্যে ছিলাম আমরা চার জন। রিয়াজ উদ্দিন মজুমদার, আমি ও ইসরাত জাহান এবং আমীর মোহাম্মদ খান। শিক্ষক হিসেবে এর দু’সপ্তাহ পরে যোগ দেন ধীমান শর্মা ও জাফর আহম্মদ এবং এক মাস পরে যোগ দেন গালিব চৌধুরী। প্রথম দিকে যোগ দেওয়া কর্মকর্তাদের অনেকে বর্তমানে ইউনিভার্সিটিতে কর্মরত থাকলেও শিক্ষকদের একমাত্র আমিই রয়ে গেছি। তাই ১৫ মে আমার জন্য অতি ভালোবাসার, ভালোলাগার নস্টালজিক একটি দিন। বাংলা বর্ষবরণে ইউনিভার্সিটির শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা।  চোখের সামনে একটি ইউনিভার্সিটিকে বড় হতে দেখছি আমি। কতোজন শিক্ষক এলেন-গেলেন; কতোজন কর্মকর্তা-কর্মচারী এলেন-গেলেন; এ আসা-যাওয়া সত্ত্বেও একটি ইউনিভার্সিটির মজবুত গাঁথুনি নির্মাণ হচ্ছে। ক্যাম্পাসে প্রবেশের ক্ষেত্রে একটি কাঁচা সরু গলিপথ থেকে বৃক্ষ সুশোভিত পাকা রাস্তা; দু’টি ভবন থেকে তিনটি ভবন; শূন্য পাঠাগার থেকে পরিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ পাঠাগার; পাশাপাশি কয়েকটি বিভাগীয় পাঠাগার; শূন্য ল্যাবরেটরি থেকে প্রায় দু’ডজন ল্যাবরেটরি; ৫৪ জন শিক্ষার্থী থেকে প্রায় হাজারের উপরে শিক্ষার্থী; চার জন শিক্ষক থেকে প্রায় ৩৫ জন পূর্ণকালীন শিক্ষক; প্রথম দিনের অনুষ্ঠানে শিক্ষকদের বসার আসন না থাকা থেকে প্রত্যেকের আধুনিক সুবিধাসম্বলিত অফিস-ইত্যাদি নানা মাপকাঠিতে অত্যন্ত সুদৃঢ়ভাবে অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখছে ফেনী ইউনিভার্সিটি।

আধ্যাত্মিক সাধক পাগলা মিয়া এবং কবি নবীনচন্দ্র সেনের স্মৃতি বিজড়িত জেলা ফেনী। ৯২৮ বর্গকিলোমিটারের এ জেলায় প্রায় ১৫ লাখ মানুষের বসবাস। যা ১৯৮৪ সালে মহকুমা থেকে জেলায় রূপান্তর হয়। এ জেলার রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস ও ঐতিহ্য। রয়েছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে উল্লেখযোগ্য অসংখ্য কৃতি ব্যক্তিত্ব। প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে তিন দিক থেকে সীমান্ত থাকা ফেনী জেলার রয়েছে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে গৌরবময় ভূমিকা। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিধন্য বিলোনিয়া দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থলবন্দর। শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অগ্রগামী ভূমিকা থাকা সত্ত্বেও উচ্চ শিক্ষার জন্য বহুদিন ধরে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অভাব অনুভূত হচ্ছিলো ফেনীতে। ইউনিভার্সিটির শুরুর দিকের সময়।  এ অভাব পূরণের লক্ষ্যে ফেনীর ২১ জন প্রতিষ্ঠিত, বিদ্যোৎসাহী ও কৃতি সন্তানের সমন্বয়ে ফেনী ইউনিভার্সিটি ট্রাস্টি বোর্ড গঠিত হয়। ফেনীর অন্যতম জনহিতৈষী ব্যক্তি আবদুস সাত্তারের সভাপতিত্বে এ ট্রাস্টি বোর্ড একটি ইউনিভার্সিটি স্থাপনের মহান স্বপ্নের গোড়াপত্তন করেন। ২০১০ সালের ৯ ডিসেম্বর হাতে নেওয়া প্রকল্প ২০১২ সালের নভেম্বর মাসে বাংলাদেশ সরকার ও বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অনুমোদন লাভ করে এবং ‘সেন্টার ফর লার্নিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’ স্লোগান নিয়ে এ প্রতিষ্ঠানের যাত্রা। এরই ধারাবাহিকতায়, বর্তমান সভাপতি বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিমের নেতৃত্বে এগিয়ে চলছে ইউনিভার্সিটির কার্যক্রম।

প্রতিষ্ঠার শুরুতেই ট্রাস্টি বোর্ড ফেনী শহরের উপকণ্ঠে মোহাম্মদ আলী বাজার সংলগ্ন সুন্দরপুর গ্রামে সাড়ে দশ একর জায়গা ইউনিভার্সিটির স্থায়ী ক্যাম্পাসের জন্য ক্রয় করে। বর্তমানে ফেনী শহরের বারাহীপুরে ট্রাংক রোড সংলগ্ন পাশাপাশি  প্রায় ৫০ হাজার বর্গ ফুটের তিনটি সাত তলা ভবন নিয়ে গঠিত ইউনিভার্সিটির অস্থায়ী ক্যাম্পাসে একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।

প্রতিষ্ঠার পর থেকে নিয়মিতভাবে রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের চ্যান্সেলর কর্তৃক নিয়োগকৃত ভাইস চ্যান্সেলর এবং ট্রেজারার দিয়ে এ ইউনিভার্সিটির কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়ে আসছে। ইউনিভার্সিটির প্রথম ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য অনুষদের সাবেক ডিন প্রফেসর ড. মো. ফসিউল আলম; যার সুযোগ্য উত্তরাধিকারী দ্বিতীয় ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে বর্তমানে দায়িত্ব পালন করছেন আন্তর্জাতিকভাবে স্বনামধন্য মৎস্য বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. মো. সাইফুদ্দিন শাহ্। আর ইউনিভার্সিটির দ্বিতীয় সেমিস্টার থেকেই ট্রেজারার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, ফেনী সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর তায়বুল হক। ইউনিভার্সিটির একটি অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিচ্ছেন বর্তমান ভিসি ড. মো. সাইফুদ্দিন শাহ্। ২০১৩ সালের ছোট প্রতিষ্ঠানটি ফেনীর আপামর জনগণের গর্ব এবং ভাবনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। তাইতো ফেনীর ভেতরের বাজারের একজন ব্যবসায়ীও আমাকে দেখে খোঁজ নেন, কেমন চলছে ইউনিভার্সিটি এবং ইউনিভার্সিটির উন্নয়নের জন্য আন্তরিকতার সঙ্গে পরামর্শ দেন। এ যেন গর্বের শেষ নেই। ফেনীর কেউ আমার পরিচয় জানতে চাইলে বলি ‘আপনাদের’ ইউনিভার্সিটির একজন শিক্ষক। প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি হওয়া সত্ত্বেও জেলার নামে নামকরণের মাধ্যমে ট্রাস্টি বোর্ডের উদার ও ধনাত্মক মানসিকতার পরিচয়ে ভৌগোলিক আভিজাত্য প্রকাশের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে সহজেই ফেনীর সাধারণ মানুষের আপন করার সুযোগ করে দেয়। ফেনীর জনসাধারণও অকৃত্রিম ভালোবাসায় ইউনিভার্সিটিকে নিজের করে নেন; ধারণ করেন ইউনিভার্সিটিকে। এ ইউনিভার্সিটির সফলতা ও ব্যর্থতা ছুঁয়ে যায় ফেনীর প্রতিটি মানুষকে।

এ ইউনিভার্সিটিকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে অনন্য করার জন্য বহুমুখি পদক্ষেপ প্রয়োজন, যার অনেকগুলোই দৃশ্যমান এবং সে লক্ষ্যে কর্তৃপক্ষ দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, আর্টস অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্সেস এবং বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন- এই তিনটি অনুষদে আটটি বিভাগ নিয়ে ফেনী ইউনিভার্সিটির বর্তমান কার্যক্রম। বিশ্বমানের শিক্ষা নিশ্চিতকরণে এখানে অনুসরণ করা হয় নর্থ আমেরিকান কারিকুলাম। পূর্ণকালীন শিক্ষকদের পাশাপাশি রয়েছেন পাবলিক ইউনিভার্সিটি হতে খণ্ডকালীন প্রফেসররা। একাডেমিক মানোন্নয়নের জন্য প্রতিটি বিভাগে উপদেষ্টা হিসেবে রয়েছেন একজন করে পাবলিক ইউনিভার্সিটি প্রফেসর। ইউনিভার্সিটিতে নিয়মিতভাবে আয়োজিত হয় সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ও ওয়ার্কশপ। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা অংশ নেয় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, সম্মেলন ও প্রতিযোগিতায়। ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় পিয়ার রিভিউড ফেনী ইউনিভার্সিটি জার্নাল। ২০১৮ সালে গঠন করা হয় ফেনী ইউনিভার্সিটি রিসার্স সেল। সম্প্রতি গঠন করা হয় ইনস্টিটিউশনাল কোয়ালিটি অ্যাসিউরেন্স সেল (আইকিউএসি)।

জাতীয় দিবসগুলো যথাযথ গুরুত্ব এবং ভাব গাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে ফেনী ইউনিভার্সিটি উদযাপন করে থাকে। নিয়মিতভাবে প্রকাশ করে দেয়ালিকা। পার্শ্ববর্তী পুলিশ লাইন্স মাঠে এবং শহীদ সালাম  স্টেডিয়ামে ইউনিভার্সিটির উদ্যোগে আয়োজিত হয় ক্রিকেট, ফুটবল, ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্টের পাশাপাশি বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা। এতে অংশ নেয় ক্লেমন ইনডোর ক্রিকেট টুর্নামেন্ট, ক্লিক ব্যাডমিন্টন এবং উইংস ইউনি ফুটসালে মতো আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় জাতীয় প্রতিযোগিতায়। সহশিক্ষা কার্যক্রমকে বেগবান করতে এবং শিক্ষার্থীদের নেতৃত্ব বিকাশের লক্ষ্যে গঠন করা হয়েছে ফেনী ইউনিভার্সিটি স্পোর্টস ক্লাব, কালচারাল ক্লাব, ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাব, ডিবেটিং ক্লাব এবং সোশ্যাল সার্ভিসেস ক্লাব।

সম্ভাবনাময় বাংলাদেশে দক্ষ মানব সম্পদের ঘাটতি পূরণের জন্য উচ্চ শিক্ষার একটি আদর্শ প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিস্ফুটনের স্বপ্নে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ফেনী ইউনিভার্সিটি। মান বজায় রাখতে পারলেই সফল হবে ট্রাস্টিদের স্বপ্ন। এ লক্ষ্যেই ফেনী ইউনিভার্সিটির নিরন্তর যাত্রা। এ প্রতিষ্ঠান জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সফল হলে এ ইউনিভার্সিটি দিয়েই পরিচিত হবে নানাভাবে উজ্জ্বল ও অগ্রগামী ফেনী জেলা।

১৫ মে ২০১৯। ষষ্ঠ ইউনিভার্সিটি দিবস। গৌরবের অর্ধ যুগ পূর্ণ করে সপ্তম বছরে প্রবেশ করলো এ ইউনিভার্সিটি। এ উপলক্ষে ট্রাস্টি বোর্ডের সব স্বপ্নবাজ সদস্যকে; ইউনিভার্সিটির সাবেক ও বর্তমান সব শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীকে; এবং ইউনিভার্সিটির সব শিক্ষার্থীকে ইউনিভার্সিটি দিবসের শুভেচ্ছা, অভিনন্দন ও আন্তরিক শুভ কামনা। ফেনীর সাধারণ মানুষ যারা এ ইউনিভার্সিটিরকে ধারণ করেন এবং ভালোবাসেন তাদের ধন্যবাদ।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক (মার্কেটিং) ও ছাত্র উপদেষ্টা, ফেনী ইউনিভার্সিটি। ইমেইল: [email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১০১৫ ঘণ্টা, ১৫ মে ২০১৯
এসএইচডি/আরআইএস/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।