ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

মুক্তমত

৮ বাংলাদেশির শিরোশ্ছেদ নিয়ে বিভক্তি বাড়াচ্ছি!

ফয়সাল কবীর শুভ, অতিথি কলামিস্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮১৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৮, ২০১১
৮ বাংলাদেশির শিরোশ্ছেদ নিয়ে বিভক্তি বাড়াচ্ছি!

গত ৭ অক্টোবর সৌদি আরবে এক মিসরীয় নাগরিককে খুন করার অপরাধে ৮ বাংলাদেশির সৌদি আইনে শিরোশ্ছেদ করা হয়। নিঃসন্দেহে দূঃখজনক এবং একইসাথে বাংলাদেশি হিসেবে লজ্জাজনক।

এর পরপরই দেখলাম বিভিন্ন ব্লগ, ফেসবুক অনলাইন মিডিয়াতে দুটি গ্রুপ হয়ে গেছে- একদল সৌদি আইনের (ইসলামিক শরিয়া আইন) কার্যকারিতা মেনে নিয়েছে এবং আরেকদল সৌদি সরকারের সমালোচনায় মুখর। দু’দলই বিভিন্ন ভাষাবাণে এমনভবে তর্ক চালিয়ে যাচ্ছে যা প্রাসঙ্গিক ইস্যু ছাড়িয়ে অন্য অনেক বিতর্কিত ইস্যুর জন্ম দিচ্ছে। একই, সেইসাথে মাঝখান থেকে যে ইস্যু নিয়ে আমাদের সচেতন হবার প্রয়োজন সে বিষয় থেকেই সরে আসছেন তারা। আমি একটা সহজ প্রশ্ন দিয়ে আমার এই লেখা শুরু করতে চাই-

প্রশ্ন, সৌদি আরবে শিরোচ্ছেদের বদলে যদি ফাঁসি বা যাবজ্জীবনেরও বিধান হয়, আপনি কি চাইবেন কোন বাংলাদেশি সেখানে কোন অপরাধে জড়িয়ে পড়ুক নাকি আপনার হাতে সৌদী প্রবাসী প্রায় ২০ লাখ (অসমর্থিত সুত্র) বাংলাদেশির জন্যে অন্য কোন শ্রম বাজার আছে যাতে তাদের তড়িৎ সেইজায়গায় সরিয়ে ফেলা যায়?

যারা সৌদি শরিয়াহ আইনের কার্যকারিতা সম্পর্কে উচ্চবাচ্য করছেন তারা হয়তো ইসলামিক মনোভাবাপন্ন বলেই তা করছেন। কিন্তু বাস্তব হলো সৌদি সরকারও এই আইনের নিজেদের স্বার্থে ব্যত্যয় ঘটিয়েছে বিভিন্ন সময়ে। তাই সে ব্যাপারে জোর দিয়ে বলার কিছু থাকেনা। কোনটা শরিয়াহ আইন, কোনটা শরিয়াহ আইনের আওতায় পড়বেনা এসব নিয়ে দেখছি বিস্তর কথাবার্তা। মুসলমান নামধারী যাদেরকে কোনদিন ইসলামের কোন কিছুই পালন করতে দেখিনা, তারাও এসে বলে আজকাল শরীয়াহ আইন চলে নাকি তাই? আবার অনেকেই পবিত্র কুরান শরিফ ও হাদিস শরিফ থেকে উদাহরণ দিচ্ছেন। তাদের সেই উদাহরণের সূত্র নিয়ে আবার প্রতিপক্ষ তাকে চ্যালেঞ্জ করছে। আমি নিজে ইসলাম নিয়ে কোনদিন গবেষণা করিনি, তাই চুপ থেকে আলোচনা দেখতেই পছন্দ করি। কিন্তু দেখলাম ইসলাম নিয়ে তর্ক আদতে দুই পক্ষের মধ্যে একে অপরের ব্যাপারে অবিশ্বাসই বাড়ছে। বাড়ছে যুদ্ধংদেহি মনোভাব। আর, মাঝে থেকে সৌদি প্রবাসী ওই আট জনের ভাগ্যে যা হলো তা যেন আবারো না হয় সেই ব্যাপারে কোন আলোচনাই নাই।
 
আবার, যারা ঐ ৮ জনের জন্যে ব্যথিত হয়ে সৌদি সরকারের সমালোচনা করে একের পর এক উদাহরণ টানছেন তা কেন করছেন তা আমার বোধগোম্য হচ্ছেনা। তারা আতিপাতি করে খুজে বের করতে লেগেছেন সৌদি রাজপরিবার কবে কি অনিয়ম করেছে। এতে করে যে আদতে বাংলাদেশিদের অপরাধের পক্ষে তাদের অবস্থান চলে যাচ্ছে সেটা কি তারা বুঝছেন না। সৌদি রাজপরিবারের অনিয়ম খুঁজে বাংলাদেশিদের অনিয়ম হালাল করার মধ্যে আমি ‘patriotism’ থেকে বেশি ‘jingoism’ দেখতে পারছি। ধরলাম, সৌদি আরবে তিন স্তরের আইন আছেঃ এক, সৌদি রাজপরিবারের জন্যে; দুই, পশ্চিমা দেশের জন্যে; তিন, অন্য সব দেশের জন্যে। সেইক্ষেত্রে, বাংলাদেশিরা কোন স্তরেরটা নিজেদের জন্যে আশা করতে পারে? নিশ্চয় তৃতীয় স্তরেরটা। এবং সেটা জেনেই কিন্তু আমাদের দেশের মানুষ সেখানে যেমন যায় তেমনি আমাদের সরকারও সেদেশে লোক পাঠানোর সর্বোচ্চ চেষ্টাই করে। আপনারা যদি একইরকম আতিপাতি করে খোজেন তাহলে দেখবেন- বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের শিরোশ্ছেদ করার ঘটনা সৌদি আরবে নতুন নয়। এমনও উদাহরণ আছে- বাংলাদেশিকে খুন করার জন্যে সৌদি নাগরিকের ‘শিরোশ্ছেদ’ করা হয়েছে।   অনেক উদাহরণই হয়তো আছে যে সৌদি রাজসরকার নিজেদের স্বার্থে আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়েছে কিন্তু সেটা তারা আট জন বাংলাদেশি প্রমানিত খুনি যারা কিনা আবার শ্রমিক শ্রেনির তাদের জন্যে কেন দেখাবে?

শুনতে খারাপ লাগবে এবং আমার নিজেরও জিজ্ঞেস করতে কুন্ঠাবোধ হয় তারপরও জিজ্ঞাসা করতে চাই  অন্য দেশের শাসকদের ঢালাও সমালোচনা করার আগে একটু নিজেদের নৈতিক বল আছে কিনা একটু পরখ করে দেখা উচিত কি? বাংলাদেশে খুনের আসামি এখানে পার পেয়ে যাচ্ছেনা প্রেসিডেন্টের অনুকম্পায়? নাটোরের বনপাড়ায় চেয়ারম্যান সানাউল্লাহ বাবুকে খুন করার দৃশ্য আমার মনে হয় সবাই দেখেছে, কি হয়েছে সে খুনীর এখন? আমিন-বাজারে ছয় জন তরতাজা যুবককে কিভাবে মারা হয়েছে? বি ডি আর এ সেনাদের মেরে ফেলে কিভাবে মাটি চাপা দেয়া হয়েছিলো? এইরকম ঘটনা অহরহ দেখে দেখে আসলে আসলে আমরা আশা করি আমাদের দেশের লোক আরেক দেশে গিয়া অপরাধ করার জন্যে সাজা পাবে, আর সেখানেও মওকুফ করা হবে। সৌদি রাজপরিবার বা সরকার যদি নিজেদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট ব্যাপারে তাদের নিয়মের ব্যাত্যয় ঘটায় তবে সেটাই অন্যায় এবং ব্যতিক্রম। কিন্তু বাংলাদেশি কোন অপরাধির জন্যে সেই ব্যতিক্রম আশা করব সেটা কতখানি বাস্তব সম্মত?

ঐ ৮ জনের শিরোশ্ছেদের জন্যে বাংলাদেশে বসবাসকারীরা যতটা আবেগে আপ্লুত ততটা কিন্তু সৌদি-প্রবাসী বাংলাদেশিরা হতে পারছেন না। কারন তারা ইতিমধ্যে কিছু বাংলাদেশির অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে কমিউনিটিতে তার প্রভাব অনুভব করছেন। অনেকেরই ব্যক্তিগত পরিচয় সূত্রে, ব্লগ এবং পেপার-পত্রিকা থেকে এ কথার সত্যতা পাওয়া যাবে। ৮ জন বাংলাদেশির শিরোশ্ছেদ হবার পরে সৌদি প্রবাসী আমার এক পরিচিত বড় ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম তিনি নিচের মেসেজ দিলেনঃ

"( ) There are a much of incidence, as i am living here. I know, i know also how much i am feeling shame to show my country of residence, show my passport, show my face to be a bangladeshi. Amader aikhane ami doctor bolle bole tomader deshe abar dactar hoi naki?? tomra to joto prokar 2 no er sathe asho... tobe saudi arobe age amader je form chilo tumi chintao korte parbe na...TC"

কিছু বাংলাদেশির কর্মকান্ডের জন্যে সৌদি আরবে যে পুরো বাংলাদেশের ইমেজ নষ্ট হবার পথে এইরকম কথা অনেকেই বলেছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো আরেক গ্রুপ বাংলাদেশি তাদের ‘সৌদি দালাল’ বলতেও ছাড়ছেন না। প্রকারান্তরে, সৌদিতে এতো স্ট্রিক্ট আইন কানুন থাকার পরও বাংলাদেশি বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ার প্রবনতা আগের চেয়ে বেড়ে গিয়েছে সেটা তারা মানতে চাচ্ছেন না। আর তাই তাদের আলোচনা থেকে বাদ পড়ে যাচ্ছে বাংলাদেশি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা সরকারের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা। চার বছর ধরে একটা মামলা চলার পরেও আমরা অনেকেই মনে করছি (হয়তো বাংলাদেশে দেখে অভ্যস্ত এইজন্যে) যে ঐ আট জনের ব্যাপারে সঠিক বিচার হয়নি। যদি সেটা সত্যও হয়- সেই দোষ কি সৌদি সরকারের না বাংলাদেশ সরকারের?

শুধু সৌদি আরব নয়, যে কোন দেশের প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্যেই এটা সত্য। বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের অপরাধের মাত্রা এতো এতো বেশি যে আমাদের গা-সহা হয়ে গেছে কিন্তু প্রবাসে বাংলাদেশিদের জন্যে তা না। সেখানে কয়েকজনের বাংলাদেশির জন্যে পুরা বাংলাদেশের ইমেজ খারাপ হয়-সেটাই স্বাভাবিক। আর যে কোন দেশেই নিজেদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ঠ ব্যাপার বা নাগরিক এবং প্রবাসীদের জন্যে দ্বিমুখি নীতি থাকাটাই স্বাভাবিক। আর তাই অন্য দেশের (এখানে সৌদি আরবের) বিচার ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করার আগে সবচেয়ে জরুরি সেটা হলো কিভাবে ‘বিচার’ পর্যন্ত না যাওয়া যায়। আবার বিচার পর্যন্তও যদি যেতেই হয় তার সুষ্ঠু সমাধান কিভাবে করা যায় তা বাংলাদেশ সরকারকেই করতে হবে। একটা কথা মনে রাখা দরকার যে যারা প্রবাসে বিশেষ করে ভাগ্য পরিবর্তনের জন্যে যায় তারা কিন্তু শুধু নিজেদের `দায়` বা `ঠেকায়` যায়, তাদের পাঠানো টাকায় আবার দেশের রিজার্ভ ভারী হয়। এবং যতই আমরা বলি আমাদের শ্রম না হলে তাদের চলবেনা, সত্য হলো তাদের বিকল্প আছে। আর এইজন্যেই মধ্যপ্রাচ্য দেশগুলোতে আমাদের শ্রম বাজার ক্রমক্ষয়িষ্ণু। তাই আমাদের ছাড়া চলবেনা এই ধরনের ভ্রান্ত ধারনা পোষণ করে যাচ্ছেতাই ভাবে সেখানে জীবন যাপন পরিহার করা যেমন জরুরি, তেমনি শ্রমিকরা যেন সেখানে অপরাধে জড়িয়ে না পড়ে সেইরকম কার্যক্রম জোরদার করার দায়িত্ব সরকারের। ।

সৌদি আরব নিয়ে অনেকের বিশেষ অনুরাগ/বিরাগ থাকতে পারে কিন্তু তার চেয়েও বড় ইস্যু হলো ঐদেশে বাংলাদেশিদের একটা বড় শ্রমবাজার ঐতিহাসিকভাবেই প্রতিষ্ঠিত- এবং এটাই বাস্তব। এবং অসমর্থিত সূত্রে এই বাজার ক্রমক্ষয়িষ্ণু হলেও ২০লাখের মত বাংলাদেশি আছে যাদের আয়ে কত পরিবার চলে এবং দেশের ফান্ডে কত টাকা আসে সেটা আশা করি অনুমানযোগ্য। এটা যেকোন শ্রমবাজারের জন্যেই প্রযোয্য।

বাংলাদেশি হিসেবে আমাদের কি চাওয়া উচিত- এই শ্রমবাজার আরো উন্নত হোক না অবনতি হোক?

সবশেষে, যে আইনই একটা দেশে থাকুক কিম্বা সেই আইনে তাদের নিয়মানুযায়ী শাস্তি হোক, তার সমালোচনা-আলোচনা করে করা যেতে পারে কিন্তু সব আলোচনা-সমালোচনার শেষে যেটা জরুরি সেটা হলো নিজেদের সংশোধন। শিরোশ্ছেদের বদলে যদি ফাঁসি বা যাবজ্জীবনেরও বিধান হয়, তাও নিশ্চয় আমাদের চাওয়া হবে কোন বাংলাদেশি প্রবাসে কোন অপরাধে জড়িয়ে না পড়ুক কিংবা কোনভাবে আমাদের শ্রমমাজার হাতছাড়া না হোক যতদিন তার উপযুক্ত বিকল্প আমাদের কাছে না আসে।
এই আট জনের শিরোশ্ছেদ ঘটনাকে কেন্দ্র করে যারা অনেক বাংলাদেশি আছেন তারা শুধু সৌদি সরকার আর তাদের আইন নিয়ে সমালোচনা করছেন, আবার সৌদিপ্রবাসী অনেক বাংলাদেশি যখন তাদের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এই বিচারের যথার্থতা প্রমান করতে চাইছেন আর তাতে আমাদের নিজেদের ভিতর বিদ্বেষই বাড়ছে। এভাবে কোন দেশের ভবিষ্যত উজ্জ্বল হতে পারেনা।

ফয়সাল কবীর শুভ, ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ সিঙ্গাপুরে উচ্চশিক্ষারত।
[email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।