ঢাকা, বুধবার, ১৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

বাংলাদেশ বদলে যাওয়ার ‘নতুন বার্তা’ দিচ্ছেন রিংকু

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫০৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ২, ২০১৭
বাংলাদেশ বদলে যাওয়ার ‘নতুন বার্তা’ দিচ্ছেন রিংকু জহিরুল ইসলাম রিংকু। ছবি: সোহেল সরওয়ার

সারা বিশ্বে প্রতিবছর ১ হাজার পুরনো জাহাজ স্ক্র্যাপ ঘোষণা করা হয়। ৬৫ লাখ টন ওজনের এসব জাহাজ কেনে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, চীন, তুরস্কসহ আরো কয়েকটি দেশ। এর মধ্যে গত বছর বাংলাদেশ কিনেছে ২৮ লাখ টন। পরের অবস্থান ভারতের, তারা কিনেছে ২২ লাখ টন। পাকিস্তান ১০ লাখ টন। পুরনো জাহাজের বিশ্ববাজারে উপমহাদেশের এই তিনটি দেশ ৮৫ শতাংশের ব্যবহারকারী।

প্রতিবছর বাংলাদেশে পুরনো জাহাজ শিল্পে লেনদেন হয় ১২ হাজার কোটি টাকা। এই খাত থেকে সরকার প্রতিবছর রাজস্ব পায় ৫০০ কোটি টাকার উপর।

৮০’র দশকে বাংলাদেশ যখন এই ব্যবসা বঙ্গোপসাগরের চট্টগ্রামের ভাটিয়ারি উপকূলে শুরু করে, তখন থেকেই নেতিবাচক প্রচারণা শুরু হতে থাকে। বিভিন্ন এনজিও এই শিল্পের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় বেকায়দায় পড়ে শিপইয়ার্ড মালিকরা। এইরকম একতরফা নেতিবাচক প্রচারণায় বিশ্ববাজারে বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় বাংলাদেশি জাহাজ ক্রেতাদের।

পুরনো জাহাজের আন্তর্জাতিক বাজারে এরকম নেতিবাচক প্রচারণার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেন অস্ট্রেলিয়া থেকে ইনফরমেশন টেকনোলজিতে (আইটি) উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়া জহিরুল ইসলাম রিংকু। গত ৯ বছর ধরে পিএইচপি ফ্যামিলির শিপইয়ার্ড নিয়ে কাজ করতে করতে তার যে অভিজ্ঞতা হয়েছে,সেটি প্রেজেন্টেশন আকারে তুলে ধরছেন বিদেশিদের কাছে। বিদেশ থেকে ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরে বড় ভাই পিএইচপি ফ্লোট গ্লাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমির হোসেন সোহেলের কাছ থেকে ব্যবসায়িক দীক্ষা নিতে থাকেন। সোহেল হলেন এমন এক মানুষ, যিনি হাজার কোটি টাকার ব্যবসা পরিচালনা করেন প্রতিবছর-অথচ মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন না এই আধুনিক যুগেও। মোবাইল কানেকটিভিটির সঙ্গে নিজেকে সার্বক্ষণিক যুক্ত না রেখেও তার গ্লাসের ব্যবসা রেখেছেন গতিশীল ও সাবলীল। কোন কাজ সফল করার জন্য তিনি সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেন অসংখ্যবার, মনে করিয়ে দেন বারে বারে।

পিএইচপি'’র গ্রিন শিপইয়ার্ড।  ছবি: সোহেল সরওয়ার বাংলাদেশের শিপব্রেকিং ব্যবসা নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণার বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করতে পিএইচপি শিপইয়ার্ডকে জহিরুল ইসলাম রিংকু পরিণত করেছেন আধুনিক এক ইয়ার্ডে। খরচ করেছেন ৩৫ কোটি টাকা। দেশি-বিদেশি অসংখ্য রাষ্ট্রদূত, সরকারি উর্দ্ধতন কর্মকর্তা, আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদের নিয়ে এসেছেন এই শিপইয়ার্ডে। গত মাসে পেয়েছেন গ্রিন শিপইয়ার্ডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। বাংলাদেশে এটাই প্রথম আন্তর্জাতিক মানের শিপইয়ার্ড এখন।

লন্ডন, সিঙ্গাপুর, নরওয়ে ও বেলজিয়ামসহ বিভিন্ন দেশের পুরনো জাহাজ নিয়ে অনুষ্ঠিত কনফারেন্স ও সেমিনারে নিয়মিত যোগ দিয়ে বাংলাদেশে এই শিল্পের প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্ব তুলে ধরেন রিংকু।

রিংকুর বয়স ৩৫ বছর। বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের শিল্পপতি। ১৭ কোটি মানুষ এখানে। জনসংখ্যার ঘনত্ব অস্বাভাবিক রকমের বেশি। মাথাপিছু গড় আয় প্রায় ১ লাখ। এইরকম এক উন্নয়নশীল দেশের প্রতিনিধিত্ব করে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশকে ও নিজেকে তুলে ধরার প্রাণপণ চেষ্টা করছেন। বাংলাদেশের আরেক চৌকস সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী ইন্টারন্যাশনাল পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। এই পদে তিনিই প্রথম বাংলাদেশি। এরা অন্যমাত্রায় বাংলাদেশকে তুলে ধরছেন বিশ্ববাসীর কাছে।

জহিরুল ইসলাম রিংকু বলেন, শুরুতেই যখন আন্তর্জাতিক কোন কনফারেন্সে যেতাম তখন আমাদের নিয়ে বিদেশিদের আগ্রাসী বক্তব্য শুনে মন খারাপ করতাম। এভাবে তিন বছর পর্যন্ত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেছি। নিজেকে প্রস্তুত করলাম। তারপর কথা বলতে শুরু করলাম। বিদেশিদের যুক্তি দিয়ে বোঝাতে চেয়েছি যে, আমাদেরকে যা বলা হচ্ছে বাস্তবতা ভিন্ন। গরীব দেশ,  জনসংখ্যার আধিক্য, কর্মসংস্থানের অভাব-একইসঙ্গে উন্নয়ন প্রবৃদ্ধির হার ৮ শতাংশের মতো। লোহার কোন খনিও নেই আমাদের। পুরনো জাহাজ থেকে লোহা না পেলে বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা যে ব্যাহত হবে সেটিও তুলে ধরেছি বিদেশিদের কাছে।

ভাটিয়ারিতে শিপইয়ার্ডের সংখ্যা প্রায় ১০০টি। এর মধ্যে গ্রিন শিপইয়ার্ডের স্বীকৃতি দেশের অন্যতম শিল্পপ্রতিষ্ঠান পিএইচপি ফ্যামিলির মালিকানাধীন। বিপুল টাকা খরচ করে পরিবেশবান্ধব ও আধুনিকায়নের মাধ্যমে এরকম আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার সুবিধা অনেক। ওই এলাকায় অবস্থিত অন্যান্য শিপইয়ার্ডও এখন অসুসরণ করবে পিএইচপিকে। অন্যান্য শিপইয়ার্ড আধুনিকায়ন না করলে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে। কারণ হল, গ্রিন শিপইয়ার্ডের বাড়তি সুবিধা পিএইচপি পাবে আন্তর্জাতিক বাজারে। বিদেশ থেকে তুলনামূলক কম দামে পুরনো জাহাজ কিনে বাংলাদেশের ইয়ার্ড মালিকদের থেকে কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে তারা।

বুদ্ধি, সাহস আর পরিশ্রম দিয়ে নিজের প্রতিষ্ঠানকে যেমন এগিয়ে নিয়েছেন রিংকু, তেমনি বাংলাদেশের এই শিল্পকে এগিয়ে যাওয়ার নতুন পথও দেখিয়ে দিলেন তিনি। ৩৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে চলছে পুরনো জাহাজ কাটার ব্যবসা। আগে এই ব্যবসায় যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন, বিপুল টাকা কামিয়েছেন, তারা আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশ সম্পর্কে যে নেতিবাচক ধারণা বা প্রচারণা ছিল, তার বিরুদ্ধে কখনো কথা বলেননি। এমনকি সেইসব সেমিনারে অংশগ্রহণও করেননি। পুরনো জাহাজ কেনাবেচার আন্তর্জাতিক বাজারে বিভিন্ন দেশের ক্রেতা-বিক্রেতা, এনজিও ও সরকারি প্রতিনিধি এবং ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশনের (আইএমও) ৫০০ জন প্রতিনিধি রয়েছেন। এই ৫০০ জন প্রতিনিধির মধ্যে রিংকুও একজন। যুক্তি, বাকযুদ্ধ ও হৃদয়গ্রাহী পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে পুরনো জাহাজ বেচাকেনার আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ বদলে যাওয়ার ‘নতুন বার্তা’ দিচ্ছেন এই জহিরুল ইসলাম রিংকু।

লেখক: আবাসিক সম্পাদক, একুশে টেলিভশন, [email protected]

বাংলাদেশ সময়: ২১০০ ঘণ্টা, নভেম্বর ২, ২০১৭
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।